বাংলাদেশে প্রচলিত হিজরি বছরের হিসেবে, রবিউল আওয়াল মাস শুরু হয়ে গিয়েছে। ১২ রবিউল আওয়াল মহানবী (সা.)-এর জন্মদিবস তথা ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী পালিত হবে। কোনো কোনো পন্ডিত বা জ্ঞানী ব্যক্তি এই প্রসঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করে লেখালেখি করবেন, টেলিভিশনেও বলবেন। আমি এই কলামে এই বিষয়টির উপর আলোকপাত করছি না। আলোকপাত করছি, দিবসটিকে যেই নামেই অভিহিত করি না কেন অথবা যেই নিয়মেই পালন করি না কেন, দিবসটির প্রধান চরিত্র বা প্রধান উপলক্ষ্য কিন্তু অপরিবর্তনীয়। তিনি হলেন- মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.), তাঁর জীবন, তাঁর শিক্ষা, তাঁর প্রতি সম্মান, তাঁর প্রতি ভালোবাসা।
পৃথিবীতে বর্তমানে জনসংখ্যার দিক থেকে প্রধানতম ধর্ম হলো খ্রিস্ট-ধর্ম বা ক্রিসচিয়ানিটি; দ্বিতীয় প্রধান ধর্ম হলো- ইসলাম। তবে সর্বাধিক আলোচিত এবং সবচেয়ে গতিশীল ধর্ম হলো ইসলাম। দ্বীন ইসলামের শুরু হয় কলেমায়ে তৈয়বা বা পবিত্র ঘোষণা দিয়ে। ঘোষণাটি হলো আল্লাহ ব্যতিত কোনো মা’বুদ বা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) তাঁর প্রেরিত রাসুল। আজকের পৃথিবীর মুসলমানগণকে পবিত্র কোরআনের ভাষায় মিল্লাত-এ-ইবরাহিম বলা হচ্ছে। কিন্তু দ্বীন ইসলাম পরিপূর্ণ রূপ পেয়েছে আমাদের নবী তথা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে। অতএব, আমরা যারা নিজেদেরকে দ্বীন ইসলামের অনুসারি বলে ঘোষণা করি বা মনে করি, আমাদের জন্য অতি আবশ্যক যে, আমরা নবী (সা.) সম্বন্ধে জানি বা জানতে চেষ্টা করি। আমরা যেহেতু উনার উম্মত তাই আমাদের তো কোনো বিকল্পই নেই আমাদের নবীকে জানা ছাড়া। এই জানাজানির বিষয়টি কোনোমতেই শুধুমাত্র আলেম-ওলামা এবং মাদ্রাসার ছাত্রদের বিষয় নয়। যাবতীয় মুসলমানগণের দায়িত্ব নবীজী (সা.)কে জানা। জানতে হলে পড়তে হবে। জানার জন্য বিশেষ কোনো সময় নেই। জ্ঞান অর্জন সর্বাবস্থায় সম্ভব। কিন্তু কোনো কোনো সময় উপলক্ষ্যটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। যেহেতু রবিউল আওয়াল মাস এসেই গিয়েছে, সেহেতু এই সময়টিতে মহানবী (সা.)-এর জীবনকে জানার জন্য, তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা আহরণ করার জন্য, শিক্ষাগুলোকে প্রচার করার জন্য, এই মাস একটি উপলক্ষ্য হতেই পারে।
মহানবী (সা.) এর জীবনী নিয়ে বহু গ্রন্থ লেখক বা কলাম লেখক বা প্রবন্ধকারকেই দেখেছি একটি বইয়ের রেফারেন্স দিতে। বইটির নাম ‘দি হান্ড্রেড: এ র্যাংকিং অফ দি মোস্ট ইনফ্লুয়েনশিয়াল পারসনস ইন হিস্ট্রি’। এই বইয়ের লেখক পাশ্চাত্যের একজন অমুসলমান পন্ডিত যার নাম মাইকেল এইচ হার্ট। মাইকেল হার্ট পৃথিবীর ইতিহাসে বা মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বা সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী একশতজন ব্যক্তিত্বের তালিকা ও জীবনী প্রকাশ করেছেন তাঁর বইয়ে। মাইকেল হার্ট-এর মতে এবং তাঁর বইয়ে প্রকাশিত তালিকা মোতাবেক, এই একশতজনের মধ্যে ক্রমিক নম্বর ১ হচ্ছেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তথা মাইকেল হার্টের ভাষায় মুহাম্মদ (সা.) হচ্ছেন মানব সভ্যতার উপরে, মানব ইতিহাসের উপরে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তিত্ব অতএব সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। মাইকেল হার্ট জানতেন যে, তাঁর এই বিবেচনা বা সিদ্ধান্ত প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। তাই তিনি মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনী নিয়ে যেই অধ্যায় তাঁর পুস্তকের শুরুতেই আছে, সেই অধ্যায়ের শুরুতেই এই সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ব্যাখ্যাটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু এর মর্ম ব্যাপক। মাইকেল হার্ট লিখেছেন যে, “ইতিহাসে মুহাম্মদই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ধর্মীয় অঙ্গনে এবং জাগতিক অঙ্গনে তথা উভয় ক্ষেত্রে চরমভাবে সফল হয়েছিলেন। বাকি ৯৯ জনের মধ্যে বেশিরভাগই কোনো না কোনো সভ্যতার কেন্দ্রে বা জনপদে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং উৎসাহব্যঞ্জক বা জ্ঞান-বান্ধব পরিবেশে বড় হয়েছেন। কিন্তু ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে যখন মুহাম্মদ আরব উপদ্বীপের মক্কা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তখন চতুর্দিকের জনপদগুলো, তাদের লেখাপড়ার স্তর এবং তাদের ধর্মীয় চিন্তা-চেতনার স্তর তৎকালীন পৃথিবীর পরিচিত মানদন্ডে নিম্নস্তরে ছিল। সেইরূপ নিম্নস্তরে থেকেও তিনি একটি নতুন চিন্তা নতুন চেতনা নতুন সভ্যতার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন।” আমি (মেজর জেনারেল ইবরাহিম) মাইকেল হার্ট-এর সিদ্ধান্তের কারণেই মুহাম্মদ (সা.)কে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বলবো না বরং আমার নিজের করা বিশ্লেষণ ও আমার নিজের বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তেই আমি তাঁকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বলবো। এই কলামের পাঠকের প্রতিও বিনীত নিবেদন থাকবে, আসুন আমরা জানি এবং আমরা নিজেরাই মূল্যায়ন করি।
এর বাইরেও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনী বা তাঁর জীবনের কর্ম সম্বন্ধে জানার জন্য সুযোগের কোনো অভাব নেই। বই পুস্তকের অভাব নেই। যে ভাষায় মানুষের ইচ্ছা সেই ভাষাতেই যথেষ্ট বই পুস্তক এবং লেখাপড়ার উপাদান আছে। গত পাঁচ ছয় দশকে, বাংলা ভাষায় অনেক জ্ঞানী-গুণি ব্যক্তি কর্তৃক মহানবী (সা.) এর জীবনী লেখা হয়েছে বা কর্মাবলীর মূল্যায়নমূলক গ্রন্থ লেখা হয়েছে বা অন্যান্য ভাষা থেকে ঐরূপ পুস্তক বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জীবনী গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম যুগপৎ প্রাচীন ও নিভর্রযোগ্য গ্রন্থ হলো ইবনে হিশাম কর্তৃক লিখিত ‘সিরাত’। এই গ্রন্থটি বহু ভাষায় অনুদিত হয়েছে। অতি স¤প্রতি বাংলা ভাষায়ও অনুবাদ পুন:প্রকাশ করেছে ঢাকা মহানগরের ‘প্রথমা’ নামক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘মহানবীর জীবন চরিত’ নামক গ্রন্থটিও একটি অনুবাদ; আলোচ্য বইটি হলো মিশরের প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক ডক্টর মুহাম্মদ হোসাইন হায়কল কর্তৃক আরবি ভাষায় প্রণীত ‘হায়াতে মুহাম্মদ (সা.)’ নামক গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ; অনুবাদক হচ্ছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও ইসলামী চিন্তাবিদ মওলানা আব্দুল আউয়াল। আনুমানিক এক দশক পূর্বে, প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সঙ্গীত শিল্পী মোস্তফা জামান আব্বাসী কর্তৃক লিখিত জীবনী গ্রন্থ ‘মুহাম্মদ এর নাম’ এখনও অতি জনপ্রিয় একটি গ্রন্থ। বাকি আরও তিন ডজন বইয়ের নাম উপস্থাপন করছি না। ইন্টারনেট, মানুষের জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রশস্ত রাস্তা খুলে দিয়েছে। গুগল-এ মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনের কোনো ঘটনা নিয়ে সার্চ দিলে বা জীবনী গ্রন্থসমূহ তালিকার প্রসঙ্গে সার্চ দিলে, বিশাল তথ্য ভান্ডার উপস্থিত হবে। তবে এখানে একটি সংবেদনশীল সাবধানতা অবলম্বন করতেই হবে; অর্থাৎ ইন্টারনেটে প্রাপ্ত লেখাগুলোর লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সাবধান থাকা প্রয়োজন। অনেক সময় অনেক ইসলাম বিদ্বেষী অমুসলিম পন্ডিত, মুসলমান নাম নিয়ে সুকৌশলে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করেন।
এই সংঘাত-সংকুল একবিংশ শতাব্দীতে, পৃথিবীর চারটি প্রধান উপমহাদেশে বিপদগ্রস্ত মুসলমানগণের বিপদসংকুল পরিবেশ সম্বন্ধে যদি গভীর ধারণা পেতে হয়, তাহলে যে কোনো আগ্রহী ব্যক্তির জন্য এটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি কাজ যে, তিনি মহানবী (সা.) এর জীবনী পড়বেন এবং বুঝতে চেষ্টা করবেন। ইতিহাসে বর্ণিত আছে যে, মহানবী (সা.) এর ইন্তেকালের পর, একদিন একজন সাহাবী উপস্থিত হলেন মহানবী (সা.) এর সম্মানিতা স্ত্রী (তথা মুসলমানগণের মা) হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর সামনে। সম্মানিত সাহাবী, বিনীত আবেদন করলেন : “আমাদেরকে রাসুল (সা.) এর চরিত্র সম্পর্কে কিছু বলুন।” মা আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) উত্তর দিলেন: “আপনি কি কুরআন পড়েননি? পবিত্র কোরআনই তো তাঁর অনুপম চরিত্র।” অর্থাৎ পবিত্র কোরআনের আলোকেই রাসুলুল্লাহ (সা.) তথা নবীজীর পবিত্র জীবন গঠিত। পবিত্র কোরআনে, তাঁর প্রিয় বন্ধু রাসুল (সা.)কে সম্বোধন করে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: “আপনি তো মহান চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত।” মহান আল্লাহ তায়ালা, কোরআনের পাঠক এবং বিশ্বাসীগণের সামনে নবীজী (সা.)র পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন এইভাবে: “তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের নিকট এক রাসূল এসেছেন। তোমাদেরকে যা উদ্বিগ্ন করে সেগুলো তাঁর জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মোমিনদের প্রতি তিনি দয়ার্দ্র এবং পরম দয়ালু।” অনুসন্ধিৎসু বা অনুসন্ধানী মনসম্পন্ন যেকোনো সচেতন মুসলমানই জানতে চাওয়ার কথা, স্বাভাবিক যুক্তিতে, কী কারণে বা কী যুক্তিতে বা কী প্রেক্ষাপটে মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বন্ধু সম্বন্ধে এই সকল বাক্যসমূহ উপস্থাপন করেছিলেন। সম্মানিত পাঠক খেয়াল করুন, আমি পূর্ববর্তী বাক্যে লিখেছি দুইটি শব্দ: স্বাভাবিক যুক্তিতে। কিন্তু সা¤প্রতিক বিশ্বে মুসলমানদের সামনে স্বাভাবিক যুক্তিগুলোকে অস্বভাবিকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সহনীয় বিষয়গুলোকে অসহনীয় হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সুন্দর সুস্মিত বিষয়গুলোকে অসুন্দর ও কঠোর হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। কে করছে? পাশ্চাত্য বিশ্ব; বন্ধুবেশী শত্রæগণ এবং অল্প বিদ্যায় আপ্লুত অহংকারী মুসলমানগণ। আমি নিজে প্রার্থনা করি মহান আল্লাহ তায়ালা যেন আমাকে বা আমাদেরকে সঠিক উপস্থাপনার সম্মুখীন করেন।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন ব্যাপ্ত ছিল ৫৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দ, ৬৩ বছর। এর মধ্যে প্রথম ৪০ বছর তিনি জীবন যাপন করেছেন এবং ব্যস্ত ছিলেন মক্কা নগরীতে। তৎকালীন মক্কা নগরী গুরুত্বপূর্ণ নগরী ছিল। মক্কার মানুষ মূর্তি পূজা করতো এটা যেমন সত্য, তেমনই সত্য যে, সমগ্র আরবের উপাসনার কেন্দ্রীয় নগরী ছিল মক্কা। এটাও সত্য যে, মক্কার মানুষ সচেতন ইতিহাসপ্রেমিক এবং সাহিত্যপ্রেমিক ছিল। ৪০ বছর বয়সে তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হন এবং এর পরবর্তী ১৩ বছর মক্কাতেই কাটান। ইতিহাসবান্ধব পরিবেশে, সাহিত্যবান্ধব পরিবেশে মহানবী (সা.) এর জীবনের প্রথম ৫৩ বছর কাটে। তাই তাঁর মক্কা-জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ রেকর্ড বা বর্ণনা বা সাক্ষ্য শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জীবিত আছে। ৫৩ বছর বয়সে, নবুয়তের ১৩তম বছরে মহানবী (সা.) মদিনায় হিজরত করেন। এই ঘটনাটি ছিল ইতিহাসের মোড় ঘুরানো একটি ঘটনা। এই ঘটনাটিকে এবং এর পরবর্তী ঘটনাবলীকে দুইটি স¤প্রদায় আলাদা আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ড করেন; প্রথম স¤প্রদায় হলো মক্কাবাসী অবিশ্বাসীগণ এবং দ্বিতীয় স¤প্রদায় হলেন মদিনার অরিজিনাল অধিবাসীগণ, যাদের মধ্যে গিয়ে মহানবী (সা.) স্থিত হলেন। দুইটি স¤প্রদায়ের উদ্দেশ্য ভিন্ন। মক্কার মানুষদের উদ্দেশ্য ছিল মুহাম্মদ (সা.)কে এমনভাবে পর্যবেক্ষণ করা যেন তিনি মক্কার প্রতি হুমকি হতে না পারেন বা হুমকি হতে চেষ্টা করলেও তাঁকে দমন করা যায়। মদিনার অধিবাসীদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করেনি তাদের উদ্দেশ্য ছিল অনেকটা এরকম যে, মানুষটি ভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে এবং কী করে দেখি। মদিনা জীবনের চার-পাঁচ বছরের মাথায় তৎকালীন পারস্য সাম্রাজ্য এবং রোমান সাম্রাজ্য, মদিনায় বিকাশমান নতুন রাষ্ট্রের প্রতি দৃষ্টি দেয়। অতএব সেই সময় থেকে তিনটি ভিন্ন স¤প্রদায় ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাঁকে অনুসরণ করছিলেন। এইজন্যই বিনা দ্বিধায়, বিনা বিতর্কে কথাটি স্বীকৃত যে, মহানবী (সা.) এর জীবন ইতিহাসের পূর্ণাঙ্গ আলোকেই যাপিত হয়েছিল। তাই তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে, তাঁর জীবনী জানা ভীষণ কঠিন কোনো কাজ নয়। অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সচেতন বা শিক্ষিত মানুষ জানতে পারছেন বলেই, মানুষ সেই কর্মময় জীবন দ্বারা উৎসাহিত হচ্ছেন; সেই মহান ব্যক্তি দ্বারা প্রচারিত জীবন দর্শন দ্বারা প্রভাবান্বিত হচ্ছেন। সেইরূপ উৎসাহ এবং প্রভাবের কারণেই, প্রচুর সংখ্যক মানুষ দ্বীন ইসলামে ধর্মান্তরিত হচ্ছেন। অতএব, আমরা যারা অটোমেটিক্যালি দ্বীন ইসলামে প্রবিষ্ট আছি, আমাদের জন্য অপরিহার্য দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়, মহানবী (সা.) এর জীবন ও কর্ম জানতে চেষ্টা করা, তাঁর জীবনের কর্মগুলোকে মূল্যায়ন করা এবং সেখান থেকে শিক্ষা নেয়া।
আমরা নিজ প্রয়োজনে বহু রকমের বই পড়ি। আমি ব্যক্তিগতভাবে যেহেতু একজন সাবেক সৈনিক, তাই যুদ্ধ বিদ্যা সংক্রান্ত, যুদ্ধের ইতিহাস সংক্রান্ত, যুদ্ধের কৌশল সংক্রান্ত, বিভিন্ন যুদ্ধের বর্ণনা সংক্রান্ত এবং বিভিন্ন যুদ্ধের সেনাপতিদের জীবনী পড়াটা আমার জন্য স্বাভাবিক। আমি এখন একজন রাজনৈতিক কর্মী। অতএব রাজনীতি দর্শন, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি, বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাগণের জীবনী, আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস, আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাগণের জীবনী, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাÐের পর্যালোচনা ইত্যাদি সংক্রান্ত বই পড়া অতি স্বাভাবিক। বাংলাদেশের নিরাপত্তা তথা জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করি, বলি, লিখি, অতএব নিরাপত্তা সংক্রান্ত বই-পুস্তক পড়বো এটাই স্বাভাবিক। আপনি একজন চিকিৎসক, অতএব, আপনি চিকিৎসা বিদ্যার উপর বই পড়বেন। আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের একজন অধ্যাপক, আপনার আগ্রহ বেশি থাকবে ইতিহাসের বইয়ের উপরে। আপনি গলফ খেলেন, অতএব আপনি গলফ সংক্রান্ত বই পড়বেন। কিন্তু আমরা সবাই মানুষ, আমরা সবাই বিবেকবান প্রাণী বা রেশনাল এনিমেল। আমরা যেই মানব জাতির সদস্য, সেই মানব জাতির ইতিহাসের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বা প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তিত্বের জীবনী আমরা পড়বো না, জীবনকে জানবো না, এটা কি অস্বাভাবিক নয়? আমরা মুসলমান। আমাদের মধ্যে অনেকেই জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি। জ্ঞান অর্জনের জন্য আমরা শত প্রকারের বই পড়ি। সুতরাং আমরা কি “যাঁকে আমরা অনুসরণ করবো” সেই রাসূল (সা.)-এর জীবনী পড়বো না? তাঁর জীবনী যদি না পড়ি তাহলে আমরা তাঁকে জানবো কীভাবে? তাঁর জীবনী যদি না পড়ি তাহলে সমালোচকদের জবাব দিব কীভাবে?
পবিত্র কোরআনের ভিন্ন ভিন্ন দুইটি জায়গা থেকে মোট তিনটি আয়াতের অনুবাদ উদ্বৃত করছি। এক. তৃতীয় সুরার নাম সুরা আল ইমরান। এই সুরার ৩১ নম্বর আয়াতের বাংলা অনুবাদ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) নিম্নরূপ : “তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসো তবে আমাকে অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদিগকে ভালোবাসিবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করিবেন। দুই. পবিত্র কুরআনের ৩৩তম সূরার নাম সূরা আল আহযাব। এই সুরায় অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কথা বা নির্দেশ আছে। এই সূরার ৪৫ এবং ৪৬ নম্বর আয়াতের বাংলা অনুবাদ উদ্বৃত করছি: “হে নবী! আমি তো তোমাকে পাঠাইয়াছি সাক্ষী রূপে এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে। আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁহার দিকে আহŸানকারী রূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপ রূপে।” আমি প্রথমে ভালোবাসা ও অনুসরণ করা নিয়ে দুইটি কথা বলবো। আল্লাহকে ভালোবাসার সাথে সাথেই রাসূল (সা.)কে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। কথাটার অর্থ এরকমও দাঁড়ায় যে, আমরা যদি রাসুল (সা.)কে অনুসরণ না করি, তার মানে দাঁড়াবে আমরা আল্লাহকে ভালোবাসি না। এমন কোনো মুসলমান বা বিশ্ববাসী কি পৃথিবীতে আছে যিনি বলবেন বা ঘোষণা দিবেন যে, তিনি মহান আল্লাহকে ভালোবাসেন না বা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে ভালোবাসতে চান না? তাহলে যুক্তিসঙ্গতভাবেই আমাদেরকে অবশ্যই, পুনশ্চ: অবশ্যই, রাসূল (সা.)কে অনুসরণ করতে হবে। যাঁকে অনুসরণ করতে হবে বা যাঁকে অনুসরণ করবো, তাঁকে জানার প্রয়োজনীয়তা কত ব্যাপক এবং জরুরি, সেটা সম্মানিত পাঠক নিজেই মেহেরবানী করে কল্পনা করুন। মহান আল্লাহ তায়ালা নবী (সা.)কে পাঠিয়েছেন স্বাক্ষীরূপে। তিনি অনেক কিছুর সাক্ষী দিবেন; তার মধ্যে অন্যতম বিষয় হবে তাঁর উম্মতের কর্ম। অতএব আমরা ওই মহামানবকে জানা প্রয়োজন, যিনি আমাদের সম্বন্ধে স্বাক্ষী দিবেন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, নবীজী (সা.) সুসংবাদদাতা। তিনি আমাদেরকে সৎ কর্মের সুসংবাদ দিচ্ছেন, তিনি মহান আল্লাহর অস্তিত্ব এবং তাঁর সৃষ্টি জগতের সুসংবাদ দিচ্ছেন; তিনি সুকর্মের সুফলের সুংসবাদ দিচ্ছেন। যিনি আমাদেরকে এতগুলো সুসংবাদ দিচ্ছেন, তাঁকে জানা আমাদের জন্য অবশ্যই জরুরি; তাঁকে জানলেই আমরা সুসংবাদের প্রেক্ষাপট বুঝতে পারব। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) হচ্ছেন সতর্ককারী। তিনি আমাদেরকে সতর্ক করেছেন; তথা ওয়ার্নিং দিচ্ছেন তথা সাবধান করছেন অনেকগুলো বিষয়ে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, শয়তানের প্ররোচনা থেকে যেন আমরা দূরে থাকি, আল্লাহর স্মরণ থেকে যেন আমরা কখনই বিরত না থাকি। তিনি আমাদেরকে সাবধান করে দিচ্ছেন যে, আমরা যদি আল্লাহর হুকুম করা পথে না চলি, তাহলে আমরা কঠিন শাস্তিতে নিপতিত হবো। অতএব, যিনি আমাদেরকে সাবধান করে এত বড় উপকার করলেন, তাঁকে জানা আমাদের জন্য অত্যন্ত বেশি প্রয়োজন। তাঁকে না জানলে আমরা সাবধান বাণীগুলোর প্রেক্ষাপট বুঝবো না। সেই সুবাদেই আজকের এই কলামের মাধ্যমে আমরা আবেদন রাখছি আমরা সবাই যেন রাসূলুল্লাহ (সা.)কে জানতে চেষ্টা করি।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com.bd
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন