বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঈদ এ মিলাদুন্নবী

মানবতার মুক্তিসনদদাতা

অধ্যাপক আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ১০ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

মানব সভ্যতার ইতিহাসে মহানবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিস্ময়কর অবদান সম্যক উপলব্ধি করতে হলে প্রথমেই তৎকালীন বিশ্বপরিস্থিতির দিকে দৃষ্টি দিতে হয়। রসুলে করিমের আবির্ভাবের প্রাক্কালে মানবজাতির অবস্থা ছিল ঘোর তমসাচ্ছন্ন। হযরত ইবরাহীম (আ:) এবং তৎপরবতী মুসা-ঈসা প্রমুখ নবীদের প্রচারিত তওহীদের শাশ্বত আদর্শ তখন ধুলায় অবলুণ্ঠিত। সত্য ধর্মকে জলাঞ্জলি দিয়ে স্রষ্টায় অবিশ্বাসের মাধ্যমে কেউ তখন বদ্ধ নাস্তিকে পরিণত, কেউবা ধর্মের নামে পাথর বা মাটির গড়া অসংখ্য দেবতার আরাধনায় মত্ত- আবার কেউবা প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তি চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, সমুদ্র-পর্বত, অগ্নি, প্রস্তর প্রভৃতিকেই তাদের আরাধ্য দেবতা রপে স্রষ্টার আসনে বসিয়েছিল। এক দিকে স্রষ্টাকে অস্বীকার করার মতো অহমিকা, অন্যদিকে সৃষ্টিকেই স্রষ্টা ও প্রভু মনে করার মতো হীন মানসিকতার ফলে মানুষ হারিয়ে বসেছিল এ বিশ্ব-জগতে তার প্রকৃত মূল্য ও মর্যাদা। এই অস্বাভাবিকতার প্রভাবে সেদিনের সমাজে বিরাজ করছিল সীমাহীন নৈরাজ্য। ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে, বর্ণে-বর্ণে, গোত্রে-গোত্রে, জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষে বিরাম ছিল না। আধ্যাত্মিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অথনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে শোষণ, বঞ্চনা, বিচার, অত্যাচার, অনাচার, ব্যভিচার হয়ে উঠেছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এরই ফলশ্রুতিতে মানব-সমাজে মুক্তি, শান্তি, প্রগতির আশা হয়ে উঠেছিল সুদূরপরাহত।
মানব-ইতিহাসের এই ঘোর দুর্দিনেই হযরত মুহাম্মদ (সা:) আবির্ভূত হন মুক্তির মহাপয়গাম নিয়ে। রসুলে করিম মানব জাতির সামনে যে মহাসনদ তুলে ধরলেন তার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য- মানুষকে তার স্বকীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা। মানুষ যে খোদা নয়, তেমনি সে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো গোলামও নয়- অসংখ্য মিথ্যা খোদার গোলামিকে অস্বীকার করে মানুষ এভাবেই নতুনভাবে তার প্রকৃত পরিচয় লাভ করল। রসুলে করিমের এ মুক্তিসনদের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর প্রচারিত জীবনবিধানের সার্বজনীনতা ও পূর্ণাঙ্গতা। অতীতে বিভিন্ন নবী-রসুলের মারফৎ সমস্ত অবতীর্ণ জীবনবিধান ছিল বিশেষ কাল এবং বিশেষ গোত্র, স¤প্রদায় বা জাতির জন্য নির্দিষ্ট মানব জাতির ক্রমবিকাশের একটা বিশেষ স্তর অতিক্রম করার পরই মাত্র একটা সার্বজনীন ও পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান লাভের সৌভাগ্য অর্জন করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল; আর এ দিনটি যখন এলো আল্লাহ তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রসুলের মারফৎ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানিয়ে দিলেন- ‘আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম।’
হযরত মুহম্মদ মানবমুক্তির যে মহাসনদ দান করেন, তার ভিত্তি ছিল কলেমায়ে তৈয়বা- ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ। আল্লাহর সর্বশেষ বাণীবাহকরূপে মুহম্মদ মুস্তফার রিসালতে বিশ্বাস এর দ্বিতীয় স্তর। আর এর প্রথম স্তর এক আল্লাহয় বিশ্বাস। এক আল্লাহর প্রভুত্বে বিশ্বাস নিমেষে মানুষকে মুক্তি দিলো নাস্তিকতার অন্তঃসারশূন্যতা এবং বহুদেবত্ববাদের হীনম্মন্যতা থেকে। চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, সমুদ্র-পর্বত, বাদশাহ-পুরোহিত, মূর্তি-প্রস্তর এই অসংখ্য দেবতার দেবত্বের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে মানুষ এ ধরাধামে সৃষ্টির সেরা ‘আশরাফুল মখলুকাত’ এই অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত হলো।
মানুষের এই আধ্যাত্মিক মুক্তির ফলে তার আধিমানসিক মুক্তির পথও গেল সুগম হয়ে। বহুদেবত্ববাদের প্রভাবে প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিকে যে মানুষ গতকালও দেবতাজ্ঞানে পূজা করেছে, আল-কুরআনে তাদের সম্পর্কেই ঘোষণা করা হলো, ‘ওয়া সাখখারা লাকুম মা ফিল-আরদি জামীআ’। বিশ্ব-প্রকৃতির যাবতীয় বস্তুকে তোমাদের অধীনস্থ করে দেয়া হয়েছে। প্রকৃতি মানুষের পূজার বস্তু নয়- মানুষের সেবার জন্যেই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে- ইসলামের এ শিক্ষা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে প্রকৃতিকে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার-কর্মে। শুরু হলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক সাধনা ও অভিযান; যার ফলশ্রæতিতে পরবর্তীকালে সম্ভব হয়ে উঠল আধুনিক বিজ্ঞানের নয়া জয়যাত্রা।
মহানবী মুহম্মদের মুক্তিসনদ আরও ঘোষণা করল- এ বিশ্বচরাচরের প্রতিপালক এক আল্লাহ, সুতরাং সমগ্র মানবজাতিও এক ও অবিভাজ্য। রসুল ঘোষণা করলেন, মানবজাতি এক আল্লাহর পালন ব্যবস্থা বা রবুবিয়তের অধীন একটি পরিবার বিশেষ। সামাজিক ক্ষেত্রে বর্ণে-বর্ণে, গোত্রে-গোত্রে, স¤প্রদায়ে-স¤প্রদায়ে যে বৈষম্য এত দিন মানবজাতিকে শতধাবিভক্ত করে রেখেছিল, নিমেষে তার অবসান ঘটল। রক্ত, বর্ণ ও বংশগত আভিজাত্যের সমস্ত গরিমাকে চূর্ণ করে দিয়ে ইসলাম ঘোষণা করল- ‘ইন্না আকরামাকুম ইনদাল্লাহি আতকাকুম, অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই সর্বাপেক্ষা সম্মানী যে সবচাইতে নীতিপরায়ণ। রসুল ঘোষণা করলেন আরব-অনারবে, সাদা-কালোতে কোনো পার্থক্য নেই- সকলেই আদম থেকে এসেছে- আর আদমের সৃষ্টি মাটি থেকে।
যে যুগে পৃথিবীর বহু দেশে নারীকে সমস্ত পাপের আধার মনে করা হতো, নারীর মধ্যে আত্মা আছে কি না এই উদ্ভট গবেষণায় ব্যস্ত ছিল সারা ইউরোপ- সেই সময় মুহম্মদ প্রচার করলেন নারীর মুক্তিবার্তা। ঘোষণা করা হলো, নারী-পুরুষ কেউ কারো প্রভু বা দাস নয়। ঘোষণা করা হলো, নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ভূষণস্বরূপ। স্বীকার করা হলো নারীর স্বাধীন উত্তরাধিকার। মায়ের পায়ের নিচে নির্দিষ্ট হলো সন্তানের বেহেশত।
নারীর মতোই ক্রীতদাসের মুক্তিবিধানও রসুলের অন্যতম কৃতিত্ব। ক্রীতদাসের মুক্তিদান অসীম পুণ্যের কাজ বলে ঘোষণা করা হলো। দাসদের প্রতি মানবেতর আচরণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হয়ে গেল। রসুল ঘোষণা করলেন, যে খাদ্য নিজেরা খাবে দাসদেরও তা খেতে দেবে, যে বস্ত্র নিজেরা পরবে, দাসদেরও তা পরতে দিতে হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এ ঘোষণার ফলে তদানীন্তন আরবের সমাজব্যবস্থায় কী মহাবিপ্লবের সূচনা হয়েছিল।
রসুলে করিমের মুক্তি-আদর্শ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সৃষ্টি করল এক অভাবনীয় বিপ্লব। আল্লাহ আসমান-জমিনের মাঝে সবকিছুর মালিক, মানুষ তার সমূহ ভোগ করবে আমানতদার হিসেবে- সমাজের অভাবগ্রস্তদের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে। এই শিক্ষার আলোকে রসুল ঘোষণা করলেন, তোমাদের যার অতিরিক্ত কোনো সম্পদ আছে, সে ওটা তাকে দিয়ে দেবে যার একেবারেই নেই। মুনফাখোরী মজুদদারী নিষিদ্ধ ঘোষিত হলো, শোষণের হাতিয়ার সুদ প্রথার বিরুদ্ধে ঘোষিত হলো জিহাদ। সমাজের সম্পদ যাতে গুটিকতক ধনিকের হাতে পুঞ্জীভূত না হয়, যুগ-যুগান্তের ভুখা-নাঙ্গা মানব যাতে সমাজের সম্পদে তার বাঁচার অধিকার লাভ করে, তার নিশ্চয়তা বিধান করা হলো। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রসুলের মুক্তিসনদ এমন এক ব্যবস্থা গড়ে তুলল, যার ফলে একনায়কত্ব ও রাজতন্ত্রের সেই অন্ধকার যুগে মদিনায় এক নজিরবিহীন সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলো। এ সাধারণতন্ত্রে, আইনের চোখে সব মানুষ ছিল সমান। রাজতন্ত্রের সেই অন্ধ যুগে স্বয়ং রাষ্ট্রনায়ক বা গভর্নরের অন্যায়ের বিরুদ্ধেও বিচার বিভাগের কাছ থেকে সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু, নির্বিশেষে যে কোনো সাধারণ নাগরিক ইনসাফ আদায় করতে পারত। শাসক-শাসিতের ব্যবধান গেল ঘুচে, রাব্বুল আলামীনের প্রতিনিধিরূপে সমস্ত নাগরিককে সমভাবে প্রতিপালন করাই হলো এ সাধারণতন্ত্রের পরিচালকদের প্রধান চিন্তা। তাঁরা নিজেদেরকে জনসাধারণের প্রভু মনে করেন না, মনে করতেন সেবক আর তাই শাসক হয়েও নিজেদের জন্য সবহারার জীবন বেছে নিয়ে তারা সতত নিয়োজিত থাকতেন জনগণের কল্যাণ-চেষ্টায়। প্রগতিশীল চিন্তাবিদদের অনেকের ধারণা, ন্যূনতম শাসনের মাধ্যমে সর্বাধিক ইনসাফ কায়েম রাখা যায় যে সমাজে, সেটাই সর্বাধিক মুক্তি ও প্রগতির দাবিদার। রাষ্ট্রীয় শাসনবিহীন এরূপ সমাজের বাস্তব দৃষ্টান্ত জগতে কোথাও নেই। কিন্তু চৌদ্দশত বছর পরে মদীনায় রসুল এমন এক সমাজ কায়েম করেছিলেন, যেখানে ন্যূনতম শাসনের মাধ্যমে নজিরবিহীন ইনসাফ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল। পুলিশবিহীন এ সমাজে রসুলে করিম এমন এক উন্নত চরিত্রের নাগরিক সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন, যারা কোনো অপরাধ করে ফেলবার পরপরই পুলিশ-মিলিটারির ভয়ে নয়- নিজেদের বিবেকরূপী পুলিশের তাগিদে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে লোকসমক্ষে অপরাধ প্রকাশ করে তার শান্তি পাবার জন্য অধীর হয়ে উঠতেন। কোনো সমাজের শাসনমুক্তির এ নজির সভ্যতার ইতিহাসে একান্ত দুর্লভ।
মোটের উপর কী আধ্যাত্মিক, কী আধিমানসিক, কী সামাজিক, কী নৈতিক, কী রাজনৈতিক, কী অর্থনৈতিক-মানব জীবনের যে দিকেই তাকাই না কেন, রসুলে করিম মুক্তির এমন এক মহান অনন্য আদর্শ স্থাপন করে গেছেন- অদ্যাবধি জগতে তার সমকক্ষ কোনো মুক্তিসনদ কেউ দান করতে পারেনি। এখানেই মানবতার মুক্তসনদদাতা রূপে বিশ্বনবীর শ্রেষ্ঠত্ব।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন