বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঈদ এ মিলাদুন্নবী

আসুন, আহলি বাইয়াতের অন্তর্ভুক্ত হই

ড. আবদুল ওয়াহিদ | প্রকাশের সময় : ৩০ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০১ এএম

ইসলাম হচ্ছে মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহতায়ালার মনোনীত পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। ইসলাম শব্দের অর্থই হচ্ছে আনুগত্য, আল্লাহর ইচ্ছার কাছে বান্দার সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ। আবহমান কাল থেকেই পরম সত্তাকে জানার বাসনা মানব হৃদয়ে বিদ্যমান। শান্তি প্রত্যাশী মানুষ শান্তির অন্বেষায় পাগলপারা। আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা মানুষ কেবল দেহসর্বস্ব নয়; তার একটি বাতিনী দিকও আছে। আর তা হচ্ছে আত্মা। আত্মা ঠিক হলেই সব কিছু ঠিক হয়ে যায় বলে হাদীসে বর্ণনা রয়েছে। আত্মার শান্তি আর প্রশান্তির অন্বেষায় মানবাত্মা যুগে যুগে জড়বাদ, বস্তুবাদ ও বুদ্ধিবাদের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু কোনো কূল-কিনারা পায়নি, জীবনের সত্য-সঠিক মূল্যবোধ কী তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়নি। জড়বাদ মানুষের যে অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে, বুদ্ধিবাদ তা পারেনি। একমাত্র ইসলাম প্রদর্শিত আধ্যাত্মিকতাই সে অধিকার দিয়েছে এবং শূন্যতা পূরণ করতে সম্পূর্ণ রূপে সক্ষম হয়েছে। 

যুগে যুগে দেশে দেশে অগণিত মানুষ জন্মগ্রহণ করেছে। অনেকে যুগের নবী-রাসূলের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ধন্য হয়েছেন। আবার অনেকে আল্লাহর দেয়া বিধান লঙ্ঘন করে হয়েছে লাঞ্ছিত, অপমানিত। প্রিয় নবী সা. বিশ্বের শেষ এবং শ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল। রব্বুল আলামীন তাঁকে রাহমাতুল্লিল আলামীন অভিধায় অভিহিত করেছেন। যে বা যারা আল্লাহকে ভালোবাসবে তাদের অকৃত্রিমভাবে নবীকেও ভালোবাসতে হবে। এটাই কুরআনের নির্দেশ। এই নির্দেশ পালন করতে পারলেই মানুষ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টি লাভ করে দুনিয়া-আখেরাতে শান্তির আশা করতে পারে। মুসলিমের অপরিহার্য কর্তব্য হচ্ছে রাসূল সা.-কে নিজের জীবন থেকেও বেশি ভালোবাসা। যে বা যারা এ নিঁখাদ ভালোবাসাটা আয়ত্ত করতে পারবে সে বা তারাই রাসূল সা.-এর সন্তুষ্টি লাভে ধন্য হবে। হবে তাঁর আহলি বাইয়াতভুক্ত।
পবিত্র কুরআনের সুরা আল আাহযাব-এর ৩৩নং আয়াতটি উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালমা রা.-এর ঘরে অবতীর্ণ হয়। মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহতায়ালা বলেন: নিজেদের ঘরে অবস্থান কর আর পূর্ববর্তী জাহিলী যুগের ন্যায় সাজগোজ দেখিয়ে বেড়িও না। নামায কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। আল্লাহ এটাই চান যে, তোমাদের- নবীর ঘরের লোকদের- হতে অপরিচ্ছন্নতা দূর করে দেবেন আর তোমাদেরকে পরিপূর্ণরূপে পবিত্র করে দেবেন। এখানে আহলে বাইয়াতের উদ্দেশ্য উম্মে সালমা রা.। এরপর অন্যদেরও হযরত রাসূলুল্লাহ সা. আহলি বাইয়াতভুক্ত করার জন্য আল্লাহর শাহী দরবারে দোয়া করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর দোয়া কবুল করেছেন। অতএব, তিনি হযরত আলী, হযরত ফাতিমা, হযরত হাসান ও হযরত হুসাইন রা.-কে কাছে ডেকে এনে দোয়া করেছেন এভাবে: হে আল্লাহ! এই চারজনকেও আমার আহলে বাইয়াতের মধ্যে পরিগণিত করুন। আল্লাহতায়ালা তাঁর এ দোয়া কবুল করেন। হযরত উম্মে সালমা রা. মনে করতে থাকেন, সম্ভবত আমি আহলে বাইয়াত থেকে বাদ পড়ে যাবো। তাই, তিনি আরজ করলেন: হে আল্লাহর রাসূল সা.! আমিও তো আপনার আহলে বাইয়াতেরই নগণ্য সদস্য। তখন তিনি ইরশাদ করলেন! কেন নয়, তুমি তো আহলে বাইয়াতের মধ্যেই রয়েছো। তোমার এ ধরনের প্রশ্নের মোটেও আবশ্যকতা নেই।
আরেকটি বর্ণনায় আছে, তিনি ইরশাদ করেন: তুমি তো তোমার জায়গায় রয়েছোই। অর্থাৎ, তোমার ওপর তো আহলে বাইয়াতের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি যথার্থ এবং যথাস্থানেই রয়েছে। আর এ চারজনের ওপর আহলে বাইয়াতের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি যথাস্থানে নয়, বরং মাজাযী যা রূপক। আর আমার আরাধনাও আল্লাহতায়ালা দয়াপরবশ হয়ে কবুল করে নিয়েছেন। তাদেরকেও আহলে বাইয়াতের মধ্যে পরিগণিত করে নিয়েছেন। যেমনি হযরত জিব্রাঈল আ.-কেও হুজুর সা. তাঁর আহলে বাইয়াতের মধ্যকার বলে ইরশাদ করেছেন (হায়াতুল কুলুব, খন্ড ২, পৃ, ২০৫)। অনুরূপ উম্মুল মুমিনীন হযরত মারিয়া কিবতিয়াকেও রা. আহলি বাইয়াতের সদস্য বলে অভিহিত করেছেন। (হায়াতুল কুলুব, খন্ড ২, পৃ. ৫৬৫ ফার্সী, খন্ড ২, পৃ. ৯১৬ উর্দু, তাফসীরে উমদাতুল বায়ান, খন্ড ২, পৃ. ২৮২।) হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা.-কেও আহলি বাইয়াতের মধ্যে পরিগণিত করেছেন। (ইবনে জারীর, পারা ২২, পৃ. ৫)। হযরত সালমান ফার্সী রা.-এর আহলি বাইয়াতে রাসূল হওয়ার মর্যাদা ভাগ্য লিখন হয়েছে। (জামেয়ে ছগীর, খন্ড ২, পৃ. ৩২, হায়াতুল কুলুব, খন্ড ২, পৃ. ৭৬৫, আবদুল হাকীম-আবদুল গফুর, পৃ. ৩)।) হযরত জারীর ইবন আবদুল্লাহ রা.-এর সম্পর্কেও বলেছেন, ও আহলি বাইয়াতের মধ্যে রয়েছে (জামেয়ে ছগীর, খন্ড ১, পৃ. ১৪২), হযরত উসামা ইবন যায়দ রা.-ও বলেছেন আহলি বাইয়াত, মিশকাত পৃ. ৫৬৯), হযরত যায়দ ইবনে হারিসাকেও রা. আহলে বাইয়াতের মধ্যকার বলেছেন (মিশকাত, পৃ. ৫৬৯), উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা রা.-কে আহলে বাইয়াত বলেছেন (বুখারী, পৃ. ৭০৭, মুসলিম, খন্ড ২, পৃ. ৪৬০), হযরত ইব্রাহীম রা. ইবনে রাসূলুল্লাহ সা. আহলে বাইয়াতের মধ্যে রয়েছেন (মিশকাত, পৃ. ৫৬৮), হযরত জাফর ত্বইয়্যার রা.-কেও হুজুর সা. আহলি বাইয়াত বলে আখ্যায়িত করেছেন। (মিশকাত, পৃ. ৫৭০), হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.)-কে আহলি বাইয়াত বলেছেন (মিশকাত, পৃ. ৫৬৯), হযরত আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিবও রা. আহলি বাইয়াতের সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন (মিশকাত, পৃ. ৫৭০), এছাড়া হযরত ওয়াছিলাহ ইবন আসকা রা.-কেও হযরত রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর আহলি বাইয়াতের মধ্যকার বলেছেন, (ইবনে জারীর, পারা ২২, পৃ. ৬), হযরত নবী করীম (সা.) তাঁর দৌহিত্রদেরও আহলে বাইয়াতের মধ্যে পরিগণিত করেছেন (জামেয়ে ছগীর, খন্ড ১, পৃ. ১০)। সমগ্র উম্মাতে মুহাম্মাদিয়া সা.-কেই আহলি বাইয়াত বলা হয়ে থাকে, যেমনি হযরত হাসান বসরী র. থেকে হযরত ইমাম আবু হানীফা র. বর্ণনা করেছেন (কিতাবুল আছার, ইমাম আবু ইউসুফ প্রণীত, পৃ. ১২৮)।
এ বিবেচনায় তো উম্মাতে মুহাম্মাদীর সা. সব পুণ্যাত্মাই আহলে নবীর পর্যায়ভুক্ত। আল কুরআনের নিরিখেও উম্মাতের মধ্যকার পুণ্যবানরা আহলি নবীর সা. পর্যায়ভুক্ত। তাই মুমিন-মুসলিম সব পুণ্যাত্মাই আহলি নবী ও আহলি মুহাম্মাদ সা. বৈ কি! আর যে বা যারা পুণ্যাত্মা হবে না, তারা আহলি নবী বহির্ভূত, যেমন সূরা হুদে হযরত নূহ আ.-কে তাঁর পুণ্যাত্মা নয়, এমন ছেলে সম্পর্কে আল্লাহর ঘোষণা: ওর আমল সৎ নয়। এরপর নবীর আহাল না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে ঘোষণা দিয়েছেন: অবশ্যই ও আপনার পরিবারভুক্ত নয়। এছাড়া আল মুহকামু ওয়াল মুহীতুল আজাম, খন্ড ৪, পৃ. ২৫৬-তে ইবনে সাইয়্যেদাহ বলেছেন, নবীর সব উম্মতই তাঁর পরিবারভুক্ত।
আজ উম্মাহ তাগুতের হাতে যেভাবে বন্দি হয়ে আছে তা থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে কুরআন এবং নির্ভেজাল হাদীসের কাছে। আর আমলটা করতে হবে শিরক ও বিদআত মুক্ত হয়ে। এমনটি যে বা যারা করতে পারবে সে বা তারাই হবে প্রিয় নবী সা.-এর আহলি বাইয়াতের অন্তর্ভুক্ত। আসুন, আমরা নবী দিবসে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে নিখুঁতভাবে আমলটা করি। ইহ এবং পর জীবনের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করে আহলি বাইয়াতের মিছিলে শরীক হয়ে আল্লাহর দিদারের আশায় বুক বেঁধে থাকি।
লেখক: গবেষক, অনুবাদক, সংগঠক ও সম্পাদক, আল্লামা ইকবাল সংসদ পত্রিকা

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন