আজ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী। মানব ইতিহাসে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এ দিন এমন এক মহামানবের আবির্ভাবের দিন, যে কোনো বিচারেই যাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কারোর আবির্ভাব ঘটেনি এই পৃথিবীগ্রহে। যাঁর প্রভাব তাঁর কর্মকালে, জীবদ্দশায় যেমন তৎকালীন দুনিয়া অনুভব করেছে তেমনি ১৪শ’ বছর পরেও বিশ্বব্যাপী অনুভূত হচ্ছে। প্রলয়দিন পর্যন্ত সম গুরুত্বের সঙ্গে তা অনুভূত হতে থাকবে। যুগের পরিবর্তন হয়, কালের বিবর্তন ঘটে, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক চাহিদার ধরন বদলায়, নব নব সমস্যার উদ্ভব হয়, তা সমাধানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, কাল যা অপরিহার্য ছিল আজ তার উপযোগিতা নিঃশেষ হয়ে যায় কিন্তু এমন এক মহামানব যিনি কখনো পুরাতন হন না, যাঁর আবেদন কখনো নিঃশেষ হয় না, যাঁর প্রয়োজন কখনো ফুরায় না, যিনি স্থান-কাল-পাত্রের ঊর্ধ্বে; চিন্তায়, কর্মে, অনুভবে, বিশ্বাসে, সর্বত্র-সর্বব্যাপী সকল ক্ষেত্রে যাঁর উপস্থিতি, প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়; অপরিহার্য, অনিবার্য হয়ে যিনি সতত বিরাজ করেন; কী দর্শনে, কী বিজ্ঞানে, কী সাহিত্যে, কী কলায়, কী ইবাদত-বন্দেগীতে, ব্যষ্টি থেকে সমষ্টিতে, ব্যক্তি পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ে, সেখানে থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পর্যন্ত যাঁর উপস্থিতি চেতনে-অচেতনে সমভাবে অনুভূত, প্রত্যাশিত, কাক্সিক্ষত- তিনি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম, সুন্দরতম, মহোত্তম, মাহবুবে খোদা, রাহমাতুল্লিল আলামীন, হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এমন যুগ-বিজয়ী, কাল-বিজয়ী, মহাবিজয়ী, বিশ্ববিজয়ী, এমন পরিপূর্ণ, এমন সর্বগুণের আকর এই পৃথিবীগ্রহে আর কেউ আসেননি, তাঁর সমকক্ষ আর কেউ হননি, ভবিষ্যতেও কেউ হবেন না। তিনি অতুলনীয়, তিনি অনুপম, তিনি বে-মিসাল।
মহাকবি ইমাম বুসীরীর ভাষায়:
‘মুনাজ্জাহুন আন শারীকিন ফি মুহাসিনিহী
ফা জাওহারুল হুসনি ফি হি গায়রু মুনকাসিমী।’
সকল গুণের মৌল আদিম
উৎসধারা রূপ-সুষমার
শরীক বিহীন ভাজ্য বিহীন
অদ্বিতীয় সত্তা যে তাঁর।
আল্লাহ রূপ-সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছেন, গুণ সৃষ্টি করেছেন, যোগ্যতা সৃষ্টি করেছেন- সেই রূপ-সৌন্দর্যের সার নির্যাস, সেই গুণাবলীর একই ক্ষেত্রে বিকাশ, সেই যোগ্যতার একই পাত্রে সমাহার, আর এসবের একীভূত সমন্বিত উদ্ভাস একই সত্তায় ঘটিয়ে যাকে এই গ্রহে প্রেরণ করেছেন তিনি শামসুদ্দোহা, বদরুদ্দোজা, নূরুল হুদা, খায়রুল ওয়ারা, হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
মহাকবি শেখ সাদীর ভাষায়:
‘বালাগাল উলা বি কামালিহি
কাশাফাত দুজা বি জামালিহি
হাসুনাত জামিউ খিসালিহি
সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি’
সবার ঊর্ধ্বে সবার শীর্ষে পূর্ণতায়
তিমির আঁধার বিদূরিত যার জ্যোতি-আভায়
পূত অনুপম মধুময় চারু স্বভাব যার
সালাম সালাম সে নবী এবং স্বজনে তাঁর।
কবির কল্পনা যে সীমা অতিক্রম করতে অক্ষম, দার্শনিকের চিন্তার গতি যেখানে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়, সাহিত্যিকের লেখনি যেখানে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়, সুরকারের সুর যে মঞ্জিল অতিক্রমে অসমর্থ, তারও উপরে যাঁর অবস্থান; সকল ভাষায় সকল শ্রেষ্ঠ শব্দসম্ভার একত্রিত করে, সকল মনিমুক্তা আহরণ করে, সে সবের শ্রেষ্ঠতমের সমাহার ঘটিয়েও যার রূপ-সৌন্দর্য, যোগ্যতা-দক্ষতা, গুণাবলীর যথার্থ প্রকাশ ঘটানো যায় না, তিনি মহাশিল্পীর শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম, মহান স্রষ্টার শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। মধু পূর্ণিমারি সে কী আন্দোলিত চাঁদ? সে কী নব উষার কোলে রাঙ্গা রবি? সে কী কুল মাখলুকাতের গুলবাগে একটি ফোটা ফুল? কী-সে? কোন উপমা দিয়ে তাঁর রূপ ফুটিয়ে তোলা যায়? কোন তুলির আঁচড় দিয়ে সেরূপ উপস্থাপন করা যায়? না- কোন কল্পনাই সে সীমায় পৌঁছতে পারে না। এ ব্যাপারে সবাই অসমর্থ, অক্ষম, অপারগ। ‘লা ইমকিনু সানাউহু কামা কানা হাক্কুহু/ বাদ আয খোদা বুজুর্গ তুই কেসসা মুখতাসার- ‘খোদার পরেই ওগো হাবীব খোদার, তোমার উচ্চ মাকাম।’
আল্লাহ যার মধ্য দিয়ে নিজের সৃজন ব্যগ্রতার প্রথম স্ফুরণ ঘটিয়েছেন, নিজ নামের সাথে যার নাম সংযোজন করেছেন; নিজ প্রেমাস্পদের মহিমায় যাকে মহিমান্বিত করেছেন; আকাশে-বাতাসে যার গুণ-গান ছড়িয়ে দিয়েছেন; যার স্মরণকে সমুন্নত করেছেন; নিজ বাণী আল-কোরআন দিয়ে যাকে নন্দিত করেছেন; আরশে আজীমে আমন্ত্রণ করে নিয়ে দিদার দানে তাঁকে ধন্য করেছেন; সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত দিয়ে গৌরবান্বিত করেছেন; কবরে চিরঞ্জীব রেখেছেন; হাশরে শাফায়াতের চাবিকাঠি অর্পণ করেছেন; তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিল তাবত আসমানী কিতাবে যার প্রশংসা-স্তুতি গীত হয়েছে, জগতের প্রখ্যাত ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মগুরুরা যাঁর আগমন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, যার শহরের ধূলিকণা চোখে মাখার জন্য আশিকদের হৃদয় ব্যাকুল করেছেন; নিস্প্রাণ পাথর যার ইঙ্গিতে কালেমা পড়েছে; আসমানের চাঁদ যার হাতের ইশারায় দ্বিখন্ডিত হয়েছে; যাঁর শরীরের ঘাম মিশক আম্বরের চেয়ে সুরভিত, যার ভেতর-বাহির নূরে নূরান্বিত ‘নীল গগন নিরালা’ যে ফুল চুমতে ব্যাকুল, ‘আম্বিয়া আউলিয়া যাঁকে ধ্যানে না পায়’ তিনি খাতেমুন্নাবিয়্যিন, সাইয়্যেদুল মুরসালীন, শাফিউল মুজনিবীন, আনিসুল গারেবীন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
যেই সৃষ্টির সম্রাটের সংবর্ধনার জন্য সুনীল গগন সুসজ্জিত করা হয়েছে নিহারিকাপুঞ্জে, নক্ষত্ররাজিতে; হাসছে সূর্য, ছড়াচ্ছে আলোক রশ্মি; হাসছে চাঁদ, রূপালি জোছনায় প্লাবিত করছে ভূমন্ডল; রূপ-বৈচিত্র্যে ভরপুর করা হয়েছে এই বসুন্ধরা; কোথাও অভ্রভেদি পর্বতমালা, কোথাও বালু-কঙ্কর পূর্ণ মরুবিয়াবান, কোথাও ঘনকুঞ্জ অরণ্যানি, কোথাও বরফাচ্ছাদিত তুন্দ্রাঞ্চল, কোথাও তৃণশোভিত স্তেপভূমি, কোথাও পারাপারহীন নীল সমুদ্র, কোথাও শস্য-শ্যামলা, সুজলা-সুফলা মাঠ; কোথাও ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা-নদী মেখলা জনপদ; যাঁকে সাদর সম্ভাষণ জানানোর জন্য এতো আয়োজন, এতো এন্তেজাম; যাঁকে স্বাগত সংবর্ধনা জ্ঞাপনের জন্য সকলের এমন ব্যাকুল এন্তেজার, যাঁকে বরণ করার জন্য, ধারণ করার জন্য এবং যার দিদারে ধন্য হওয়ার জন্য কুল মাখলুকাত অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষমান; যাঁর আগমনের সংবাদ বাবা হযরত আদম পরিবেশন করেছেন, সকল নবী-রাসূল ঘোষণা করেছেন, হযরত ইব্রাহীম যাঁর জন্য প্রার্থনা করেছেন, হযরত মূসা যাঁর আগমনী বার্তা শুনিয়েছেন, হযরত ঈসা যাঁর সুসংবাদ প্রচার করেছেন সেই দোজাহানের বাদশা এলেন, নবীকুল সম্রাট এলেন। আকাশে-বাতাসে তাই আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেল; বৃক্ষের কিশলয়ে কিশলয়ে, পত্রপুস্প, পল্লবে পল্লবে পুলক শিহরণ জাগল, নদীর ঊর্মিতে ঊর্মিতে জয়ধ্বনি নিনাদিত হলো; বাতিলের ভিত প্রকম্পিত হলো; নওশেরোয়ার সুউচ্চ রাজপ্রসাদ-চূড়া ধসে পড়ল, কাবার নকল খোদারা ভূলণ্ঠিত হলো; আনন্দ ও পুলকের দোলায় আলোড়িত, মুখরিত, স্পন্দিত হলো বিশ্বনিখিল: মারহাবা ইয়া রাসূলুল্লাহ। মারহাবা ইয়া হাবিবাল্লাহ। মারহাবা।
‘মানুষে মানুষের অধিকার দিল যে-জন
এক আল্লাহ ছাড়া প্রভূ নাহি কহিল যে-জন
মানুষের লাগি চির দীন হীন বেশ ধরিল যে-জন
বাদশা-ফকিরে এক শামিল করিল যে-জন
এলো ধরায় ধরা দিতে সেই সে নবী
ব্যথিত মানবের ধ্যানের ছবি
আজি মাতিল বিশ্ব নিখিল তাই মুক্তির কলরোলে।’
হ্যাঁ, সেই বিশ্বনিখিল মুক্তির কলরোলে মাতার দিনই ঈদে মিলাদুন্নবী।
তিনি তো খুলুকুন আজীম: ‘ইন্নাকা লা আলা খুলুকুন আজীম’-চারিত্রিক মাধুর্যে আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ (আল-কোরআন)। তিনি তো রাহমাতুল্লিল আলামীন: ‘অমা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতাল্লিল আলামীন’- আপনাকে প্রেরণ করেছি আমি বিশ্বজগতের কল্যাণের প্রতীক রূপে (আল-কোরআন)। তিনি তো খাতামুন্নাবিয়্যিন ‘রাসূলাল্লাহি ওয়া খাতামুন্নাবিয়্যিন’- সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল এবং সর্বশেষ নবী (আল-কোরআন)। তিনি তো উসওয়ায়ে হাসানা: ‘লাকাদ কানা লাকুম ফী রাসূলিল্লাহি উসআতুন হাসানাহ’- রাসূলুল্লাহ তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ (আল-কোরআন)।
তিনি নবী, তিনি সাক্ষী, তিনি সুসংবাদদাতা, তিনি সতর্ককারী, তিনি আল্লাহর দিকে আহবানকারী, তিনি উজ্জ্বল প্রদীপ-জোতিষ্মান সূর্য: ‘ইয়া আইয়্যুহান নাবীউ ইন্না আরসালনাকা শাহিদাওঁ ওয়া মুবাশ্শিরাও ওয়া নাযিরা, ওয়া দায়িআন ইলাল্লাহি বিইজনিহী ওয়া সিরাজাম মুনীরা’ (আল-কোরআন)। তিনি তো নূর: কাদ জাআকুম মিনাল্লাহি নূরুন (আল-কোরআন)। তিনি তো জীবন্ত কোরআন: কানা খুলুকুহুল কুরআন (আল-হাদীস)। তাঁর কথা স্বয়ং আল্লাহর বাণী: ‘অমা ইয়ানতিকু আনিল হাওয়া ইন হুয়া ইল্লা ওয়াহইউ ইউহা’- তিনি নিজ থেকে কিছু বলেন না, যা ওহী হিসেবে নাজিল হয় তাই বলেন (আল-কোরআন)। (‘গোফতায়ে উ গোফতায়ে আল্লাহ বাওয়াদ/গারচে আজ হুলকুমে আবদুল্লাহ বাওয়াদ- তাঁর কথা আল্লাহর কথা, যদিও আল্লাহর বান্দার মুখ থেকে তা নিঃসৃত হয়- মুখ তাঁর, কথা আল্লাহর)। তাঁর হাতে হাত দেওয়া মানে আল্লাহর কুদরতি হাতে হাত দেয়া: ইয়াদুল্লাহি ফাওকা আইদিহিম (আল-কোরআন)। তাঁর নিক্ষেপণ স্বয়ং আল্লাহর নিক্ষেপণ: ‘অমা রামাইতা ইজ রামাইতা অলাকিন্নাল্লাহা রামা’- যখন আপনি নিক্ষেপ করলেন প্রকৃতপক্ষে তাতো আপনি নিক্ষেপ করেননি, আপনার হাতের মাধ্যমে স্বয়ং আল্লাহ নিক্ষেপ করেছেন (আল-কোরআন)। তাঁর অনুসরণের নামই আল্লাহ প্রেম- ‘কুল ইন কুনতুম তুহিব্বুনাল্লাহা ফাত্তাবিউনী ইউবিব কুমুল্লাহ’ (আল-কোরআন)। তাঁর স্মরণ আল্লাহরই স্মরণ: ‘হাবীবী জিকরুকা জিকরী’ (হাদীসে কুদসী)। উম্মতের নিজ সত্তার চেয়ে, আত্মার চেয়েও তিনি অধিক নিকটবর্তী, অধিক প্রিয়; ‘আন্নাবীউ আওলা বিল মুমিনিনা মিন আনফুসিহিম’ (আল-কোরআন)। তিনি সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ অভিভাবক, সবার চেয়ে অধিক দরদী: ‘বিল মুমিনীনা রাউফুর রাহীম’ (আল-কোরআন)।
এলো জগতে খোদার সে প্রিয় রাসূল
দরদে নাই কেহ যার সমতুল
পড় দরুদ তাঁর, সারা মন হৃদয় দিয়া
সাল্লেআলা নবী সাল্লেআলা।
তাঁর উপমা তিনি নিজেই। মাতৃক্রোড়ে দুগ্ধপানকালেই তিনি ইনসাফের অবিস্মরণীয় নজির স্থাপন করেছেন। সেই শুরু। তারপর থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কেটেছে তাঁর মানবকল্যাণে। তিনি জনকল্যাণ, সমাজসেবার অনুপম আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছেন। দুস্থ, দুর্গত, নিরন্ন, বুভুক্ষ, এতিম, অনাথ অসহায়, অত্যাচারিত, নিপীড়িত, নিগৃহীত মানুষের পাশে গিয়ে তিনি দাঁড়িয়েছেন। বুকে টেনে নিয়েছেন। অশ্রু মুছিয়েছেন, দুঃখ দূর করেছেন, আশ্রয় প্রদান করেছেন। দলিত মথিত পঞ্জরে পঞ্জরে মহাকল্যাণের অযুত জয়ধ্বনি নিনাদিত করেছেন। আশরাফ-আতরাফ, উচ্চ-নীচ, ছোট-বড়র দুর্লংঘ্য প্রাচীর তিনি ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছেন। বর্ণ-গোত্র-ভাষার দেয়াল খান খান করে দিয়ে মানুষকে মানুষের পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দাসীত্বের কলঙ্ক মুছে দিয়ে নারীকে রাণীর আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তার অর্থনৈতিক সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন, নিশ্চিত করেছেন। মানুষদের সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব, স্নেহ-মমতা, ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। সমাজ থেকে শোষণ বঞ্চনার অবসান ঘটিয়েছেন। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, রক্তপাতের, কলহ-কোন্দলের উচ্ছেদ ঘটিয়েছেন। পশু খাসলত দূর করে পাতক-পতিতদের ফেরেশতার খাসলতে উন্নীত করেছেন। বদলে দিয়েছেন ব্যক্তি-জীবন, পারিবারিক জীবন, সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন, জাতির চরিত্র। শান্তি, নিরাপত্তা- আমান ও সালামতের প্লাবন বইয়ে দিয়েছেন। শতধাবিভক্ত জাতিকে সিসাঢালা প্রাচীরের মতো ঐক্যবদ্ধ করেছেন। সম্রাটের সম্রাট হয়েও ফকীরী জিন্দেগী ইখতিয়ার করেছেন। শত্রুকে হাতের মুঠোয় পেয়েও তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন। প্রতিশোধ গ্রহণের মহাসুযোগ লাভ করেও তিনি মাফ করে দিয়েছেন। যারা তাঁর পবিত্র বদনে প্রস্তর নিক্ষেপ করে রক্তের স্রােত বইয়ে দিয়েছে, যারা মাতৃভূমি থেকে তাঁকে নির্বাসিত করেছে, অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়েছে, নির্যাতন-নিপীড়নের একশেষ করেছে, হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে, দেশ থেকে বিতাড়িত করার পরও যারা অস্তিত্ব বিনাশী তৎপরতা চালিয়েছে, অভিযানের পর অভিযান, আক্রমণের পর আক্রমণ, যুদ্ধের পর যুদ্ধ চালিয়ে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছে, দান্দান মোবারক শহীদ করেছে, আঘাতে আঘাতে দেহ ক্ষতবিক্ষত করেছে, রক্তে প্লাবিত করেছে- তাদের কব্জায় পেয়েও, তাদের দন্ডমুন্ডের একচ্ছত্র অধিপতি হয়েও, বদলা না নিয়ে তিনি তাদের বুকে টেনে নিয়েছেন। তাঁর তুলনা কী হতে পারে! কুফরী, শিরকী, কুসংস্কার, অজ্ঞতা, অজ্ঞানতা, অশ্লীলতা, চরিত্রহীনতার পঙ্কে যে জনগোষ্ঠী আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিল সেই জনগোষ্ঠীকে তৌহিদের মৃতসঞ্জিবনী পান করিয়ে সঞ্জিবিত করে, জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত করে, ঐক্যের বলে বলীয়ান করে, বিস্ময়কর শৃংখলায় ঐক্যবদ্ধ করে একটি বিশ্বজয়ী জাতিতে পরিণত করেছেন- এমন সংগঠক, এমন সংস্কারক, দুনিয়ার আর কোথাও কি মিলতে পারে! যাঁর অনুসারীরা একদা চুপিসারে জন্মভূমি থেকে পালিয়ে অস্তিত্ব রক্ষা করেছিল, তারাই স্বল্পকালের ব্যবধানে অজেয় শক্তিতে পরিণত হলো। যুদ্ধের পর যুদ্ধে বিজয়ী হলো। সেই পালিয়ে যাওয়া ভূমিতে মহাবিজয়ী বেশে প্রবেশ করল। তারাই দিকে দিকে বিজয় অভিযান পরিচালিত করল, তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ রাজশক্তি, পরাশক্তিকে পরাজিত করল। এরচেয়ে সফল নেতৃত্ব, এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ সমর-নায়ক আর কে হতে পারে! তিনি আইয়ামে জাহিলিয়াত বা অন্ধকার যুগকে স্বর্ণযুগে রূপান্তরিত করলেন, মরুচারী বেদুইন জাতিকে বিশ্ববিজয়ী করলেন। দুনিয়ার ইতিহাস-ভূগোল পাল্টে দিলেন। এক নব সভ্যতা, সংস্কৃতির জন্ম দিলেন। নির্বাসিত আল্লাহকে পুনর্বাসিত করলেন। তাঁর সার্বভৌমত্ব পুনঃ প্রতিষ্ঠা করলেন। তাঁর জয়গানে আকাশ বাতাস মুখরিত করলেন। এমন বিপ্লব ইতিহাসে আর কবে কোন দিন সংঘটিত হয়েছে! এমন মহাবিপ্লবের মহানায়ক আর কবে কোথায় আবির্ভূত হয়েছে! হয়নি, হবেও না কোনো দিন। কারণ, তিনি বেমিসাল, অদ্বিতীয়, অনুপম। তাঁর আবির্ভাবের দিন তাই মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ দিন। মহাবিপ্লবের দিন। পরম প্রাপ্তির দিন, পরম পুলকের দিন। মানবতার পূর্ণতা লাভের দিন, মহা উৎসবের দিন-ঈদে মিলাদুন্নবী।
হায় আফসোস! যিনি তৌহিদের মশাল নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁর অনুসারী হওয়ার দাবিদার হয়েও তাদের অধিকাংশ আজ শিরক কুফরীতে নিমগ্ন। যিনি জ্ঞানের আলোকবর্তিকা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাঁর অনুসারীরা আজ অজ্ঞানতার, কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত। যিনি সাম্য মৈত্রীর পয়গাম নিয়ে এসেছিলেন তাঁর অনুসারীরা আজ বিভেদের বেড়াজালে আবদ্ধ। যিনি ঐক্যের অগ্রদূত হয়ে এসেছিলেন, তাঁর অনুসারীরা আজ শতধা বিচ্ছিন্ন, রক্তারক্তি, হানাহানি, যুদ্ধ বিগ্রহ, আত্মঘাতি সংঘাতে লিপ্ত। যার অনুসারীরা এককালে দুনিয়ার মানুষকে জুলুম-অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন, তাদের উত্তরসুরিরা আজ নির্যাতনের, নিপীড়নের শিকার, দিশেহারা মজলুম। যাদের সারা দুনিয়া শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাত তারা আজ অবহেলিত, অপমানিত, অপদস্ত। যারা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, আদল-ইনসাফে, শৌর্য-বীর্যে, সভ্যতা-সংস্কৃতিতে বিশ্বে বিস্ময় উৎপাদান করেছিল তারা আজ পশ্চাতে, সকলের করুণা-ভিখারী। অথচ সংখ্যা তাদের প্রায় দু’শ কোটি, দেশ তাদের ষাটটি, সম্পদ তাদের অঢেল, অফুরন্ত। আর এই অধঃপতনের কারণ একটাই- তাঁর শিক্ষা, আদর্শ থেকে আমরা বহুদূরে সরে গেছি। সেই আদর্শে প্রত্যাবর্তন ছাড়া আমাদের মুক্তি নাই, কল্যাণ নাই। একমাত্র তাঁর নির্দেশিত পথে চলে, তাঁর আদর্শ ধারণ করেই সেই হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। কবি ইকবাল মহান আল্লাহর ওয়াদা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন:
‘কি মুহাম্মদ সে ওয়াফা তুনে তু হাম তেরে হ্যায়/ইয়েহ জমিন চিজ হ্যায় কেয়া লওহে কলম তেরে হ্যাঁয়’।
মুহাম্মদের (সা.) সাথে সম্পর্ক পুনঃ স্থাপন করলে ভূমন্ডল কোন ছার, লওহে কলম তথা নভোমন্ডলের কর্তৃত্বও এসে যাবে তোমার কব্জায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন