বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঈদ সংখ্যা

সিঙ্গাপুরে তিন দিন

চে ম ন আ রা | প্রকাশের সময় : ২২ মে, ২০২০, ১২:০৫ এএম

আ মার স্বামী কথাশিল্পী অধ্যাপক শাহেদ আলী ইন্তেকাল করেন ২০০১ সালের ৬ নভেম্বর। বাড়িতে বিষাদের ছায়া! আত্মীয় পরিজন সবার মনে অসহায় শূণ্যতার রোনাজারি। আমার দ্বিতীয় ছেলে রুহী অধ্যাপনা করে অস্ট্রেলিয়ার মূল খন্ডের বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপে। নাম তাসমানিয়া। দেশটি অস্ট্রেলিয়ার সাতটি স্টেটের একটি। আয়তনে সবচেয়ে ছোট। তবে জনবসতির দিক থেকে এটি সমগ্র অস্ট্রেলিয়ায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এবং অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি। রুহী Ÿারবার তাগিদ দিচ্ছে তাসমানিয়া যাওয়ার জন্য। ঘরের মধ্যে যে মানুষটির অশরীরি ছায়া আমাকে ঘিরে আছে তাকে এখানে রেখে আমি কেমন করে যাই? কিছুদিন দ্বিধা-দ্ব›েদ্ব ভুগেও যাওয়ার জন্য মনস্থির করলাম।
ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্তর পাঠিয়ে দিয়েছে ছেলে। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি, ভিসা পেতে দেরি হলো না। ছয় মাসের ভিসা পেয়ে গেলাম।
এবার যাওয়ার প্রস্তুতি। আমি ভয় আর শঙ্কাতে ভুগছি। একা একা যাব কেমন করে। অস্ট্রেলিয়ার মূল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ। পথে দুইবার যাত্রাবিরতি। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসে যেতে হবে। থামতে হবে প্রথম সিঙ্গাপুরে ওখানে আট ঘণ্টা অপেক্ষা করে আবার উঠতে হবে মেলবোর্ণগামী প্লেনে। মেলবোর্ন থেকে আবার উড়সবংঃরপ ভষরমযঃ- এ তাসমনিয়ায় যেতে হবে। পথে ঝক্কি ঝামেলাও কম নয়। এসব চিন্তা করে যাত্রাটা সহজ করার ইচ্ছায় পথে সিঙ্গাপুর দেখে যাওয়ার জন্য তিন দিনের ভিসা নিয়ে রাখলাম। সিঙ্গাপুরে রুহীর বন্ধু পুত্রসম পারভেজের কর্মস্থল। তাকে আমার যাওয়ার তারিখ জানিয়ে দেয়া হলো।
১২ মে, ২০০৩ এ সিঙ্গাপুর এয়ার লাইনসের টিকিট কনফার্ম করলাম। রাত ১১টা ৫০ মিনিটে সিঙ্গাপুর এয়ার লাইনসের কর্মচারীদের তত্ত¡াবধানে সিঙ্গাপুরের পথে যাত্রা করলাম। আল্লাহর ওপর ভরসা করে শুরু হলো আকাশ পথে আমার একাকী যাত্রা।
পরিপাটি পোষাকের সিঙ্গাপুর এয়ার লাইনসের বিমানবালাদের অতিথিসুলভ যতœ-তদারকিতে আমি যেন নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে এক বিমানবালা এসে আমার হাতে তুলে দিল গরম পানিতে ভেজা ছোট একটা ন্যাপকিন। বললোÑ ডধংয ুড়ঁৎ ভধপব ্ নব ভৎবংয.
আসলেও ভেজা ন্যাপকিন দিয়ে মুখ হাত মুছে ফেলার পর নিজের মধ্যে একটা সতেজ, সজীব ভাব অনুভব করলাম।
হাত মুখ মুছে একটু ঝরঝরে হয়ে বসতে না বসতে সামনে এসে দাঁড়ালো এয়ার হোস্টেস, ট্রলিতে নানা জাতীয় পানীয় নিয়ে। ম্যানগো জুস, কোকাকোলা, মদ, বিয়ার, ¯প্রাইট, চা ইত্যাদি। ¯প্রাইটের একটা ছোট টিন আমার হাতে তুলে দিল। আমি কিছু খেয়ে রেখে দিলাম। এয়ার হোস্টেস বোধ হয় খেয়াল করলো, বললো- ুড়ঁ ধৎব ঃরৎবফ. ইঁঃ যিু ুড়ঁ ধৎব হড়ঃ ফৎরহশরহম? আমি ওর সহানুভুতিসূচক কথা শুনে হাসলাম। ততক্ষণে সে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। আমি চারদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। বাঙালি একদম কম। সবাই প্রায় চাইনিজ। দু’একজন পশ্চিমাও আছে। প্লেনের পরিসর অন্যান্য প্লেন থেকে কিছুটা প্রশস্ত। সিটের পাশ দিয়ে এয়ার হোস্টেসদের চলাফেরা বিরক্তিকর মনে হয় না। কিছুটা নিশ্চিন্ত মনে এসব দেখছি। আবার এলো বিমানবালা সুবিশাল খাবারের ট্রলিতে রাতের খাবার নিয়ে। বললো কি খাবেন? ফ্রাইড রাইস না রুটি, মাখন, পনির?
দূর দেশে যাব। পথে ঘাটে যদি পেটে গন্ডগোল ভেবে রুটি, মাখন নিলাম -সঙ্গে কয়েক টুকরো মিষ্টি আম। খাবারের পর্ব শেষ করলাম। এবার বিশ্রামের পালা। প্রতি সিটে একটা করে কম্বল ও একটা করে ছোট বালিশ। সিট ছোট তার ওপর কম্বল ও বালিশের বোঝা। বসতে কষ্ট হচ্ছিল। আমার পাশে বসেছিল এশিয়ান বিশ্বদ্যিালয়ের একটা ছেলে। সে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ পাস করে এমবিএ পড়তে যাচ্ছে মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আজকাল আর আগের মতো কেউ সুনজরে দেখে না। ছাত্র-ছাত্রীদের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে গোটা অভিভাবক সমাজ এখন আতঙ্কিত। বিশেষ করে একাত্তরের পর থেকে কিছু ছাত্রছাত্রীর ন্যাক্কারজনক কর্মকাÐে গোটা স্টুডেন্ট সমাজকে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এই ছেলেটিকে এইসব ছাত্র থেকে একটু স্বতন্ত্র মনে হলো।
বারবার প্লেনের করিডোর দিয়ে বিমানবালাদের আসা-যাওয়া ও তদারকিতে রাতের ঘুম প্রায় হলো না বললেই চলে।
রাতের আলো গা ঢাকা দিচ্ছে। একটু একটু সকাল বেলার আলোর পরশ অনুভব করছি। শিমন নামের এয়ার হোস্টেস মেয়েটি যে প্রথম থেকে আমাকে দেখাশুনা করছে, এসে বলে গেল- কিছুক্ষণের মধ্যে প্লেন সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে এসে যাবে। তুমি তো একা, তাই না? আমি মাথা নাড়লাম। সে বললো- প্লেন নামলে চুপচাপ বসে থাকবে। যাত্রীরা সব নেমে গেলে আমি এসে তোমাকে আমাদের লোকের হাতে পৌঁছে দেবো। তুমি কোন চিন্তা করো না। অল্পক্ষণের মধ্যে প্লেন এসে সিঙ্গাপুরের এয়ার পোর্টে ল্যান্ড করলো। যাত্রীরা সব নেমে গেছে। এয়ার হোস্টেস মেয়েটি আমাকে নিয়ে প্লেনের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াতেই দেখলাম এক চাইনিজ তরুণের হাতে আমার নাম লেখা একটা প্ল্যাকার্ড। পাশে আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে একটা ডযববষ ঈযধরৎ-এর পেছনের হাতা ধরে। শিমন আমাকে নিয়ে হুইল চেয়ার বরাবর এসে আমার ব্যাগটা চেয়ারের পা-দানিতে রাখতে রাখতে বললো- এখন থেকে ইনিই তোমার সব দায়িত্ব পালন করবেন। তোমাকে ইমিগ্রেশন পার করে লাগেজ নিয়ে তোমার লোকের কাছে পৌঁছে দেবেন। বাই, ডরংয ুড়ঁৎ যধঢ়ঢ়ু লড়ঁৎহবু -এই বলে মিষ্টি হেসে হাত নেড়ে চলে গেল।
আমি হুইল চেয়ারে বসতে না বসতে মাঝারি বয়সের একজন মুসলমান মহিলা [মাথায় কালো কাপড়ে ঢাকা] এসে যে ছেলেটি আমার ডযববষ ঈযধরৎ এর হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল তাকে কি যেন বলে চলে গেল। আমার দায়িত্ব নিল মহিলাটি। মহিলাটি চাইনিজ মুসলমান। খুব দ্রæত আমাকে নিয়ে এমবারকেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মালের জায়গায় এসে দাঁড়ালো। ইংরেজিতে আমাকে জিজ্ঞেস করলোÑ আমার ব্যাগের রঙ কি রকম। আমি বললাম বø্যাক। কিছুক্ষণ সে নজর রাখল মালগুলোর দিকে। এক সময় টেনে বের করে আনে আমার ব্যাগটি। ট্রলিতে মাল নিয়ে ডযববষ ঈযধরৎ সহ এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দাঁড়াল। বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখলাম রুহীর বন্ধু পারভেজ গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। সঙ্গে তার দশ বছরের মেয়ে। আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে বের করে এনে পারভেজের কাছে পৌঁছে দিয়ে ভদ্রমহিলা পারভেজকে কি যেন হাসতে হাসতে বলে চলে গেল। আমি ওদের ব্যবহার, কর্তব্যবোধ দেখে বিস্মিত হলাম। আমাদের দেশ হলে এই হুইল চেয়ারটার জন্য আমাকে কমপক্ষে একশত টাকা দিতে হতো।
একাকী প্লেনে ভ্রমণে বের হয়েছি বলে যে ভয় হচ্ছিল তা যেন আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। পারভেজ ও তার মেয়ে গাড়িতে ওঠার আগে রাস্তার মধ্যেই আমাকে সালাম করলো। আমি মেয়ে ও বাবার শিষ্টাচারে খুশি হলাম। যদিও অনেকে পা ধরে মুরব্বিদের সালাম জানানোকে সুনজরে দেখে না। আমার কাছে মনে হয় কেউ পা ধরে সালাম করলে মনের ভেতর থেকে যে শুভ কামনা উৎসারণ হয় সাধারণ সালামে তা হয় না। গাড়ির দরজা খুলে পারভেজ বলে, উঠেন খালাম্মা। সারারাত তো না ঘুমিয়ে আছেন। বাসায় গিয়ে গোসল করে একটু ঘুম দেন।
সিঙ্গাপুর বাংলাদেশের লোকজনের কাছে খুব পরিচিত নাম। এই শহরের পরিস্কার পরিচ্ছনতার কথা আমরা জানি।
এয়ারপোর্ট থেকে আধ ঘণ্টার পথ পারভেজের বাসা। প্রকৃতি ও পরিচ্ছন্নতা দুই-ই মন ও চোখকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে তুলছে। গাড়ি নিয়ে ওর বাড়ির সামনে পৌঁছে মনটা আরও খুশিতে ভরে গেল। গেটের মুখে একটা ফোয়ারা আপন খেয়ালে পানি নিয়ে খেলছে। ফোয়ারার দুই দিকে দুটি গেট একটা বের হবার আর একটা প্রবেশ করার। ভেতরের চেহারা ও ¯িœগ্ধতায় মনকে মোহাচ্ছন্ন করে তোলে। মনে হয় এই কোন ধুলামলিন বিবর্জিত অচিন দেশে এসে গেলাম। পারভেজকে জিজ্ঞেস করে জানলাম- এই জায়গাটির নাম অর্কিড পার্ক। জায়গাটি খুব সুন্দর বলে নামটি বেশ মানানসই, মনে হলো আমার। চারিদিক তাকালাম। নানা জাতের অর্কিড সুশোভিত মনোহর একখন্ড বেহেশত যেন। গাড়ি গিয়ে তার ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়ালো। দেখলাম লেখা রয়েছে টাওয়ার সেভেন। দশ তলায় তার এপার্টমেন্ট। পেছনে বয়ে চলেছে এক কৃত্রিম নদী। নদীর পাড়ে পাড়ে অসংখ্য সবুজ গাছের সমারোহ। সবগাছগুলো প্রায় একই মাপের। উচ্চতাও সমান। মনে হচ্ছে ওখানে যেন সবুজের ঢল নেমেছে।
সিঙ্গাপুর সুন্দর শহর, পরিস্কার শহর সবার কাছে অনেক দিন ধরে শুনে আসছি। কিন্তু এত সুন্দর, এত পরিস্কার বুঝতে পারি নি কখনো। গাছগুলোর পাতা দেখলে মনে হচ্ছে সদ্য বৃষ্টির পানিতে ধোয়া। কোথাও একটুও ধুলাবালি নাই। মালিন্য নাই পারভেজের কাছে জানলাম এই গাছগুলিকে বৃষ্টির দিন ছাড়া প্রতিদিন রাবারের নল দিয়ে ধুয়ে দেয়া হয়। নদীটাতে কৃত্রিম পানি ধরে রাখা হয়েছে। সিঙ্গাপুরে পানি নেই। মালয়েশিয়া থেকে পানি আনতে হয়। পানির অসুবিধে হলে এই নদীতে জমানো পানি ব্যবহার করা হয়। বিশেষ এক পদ্ধতিতে জমানো পানি পরিস্কার রাখা হয়।
এপার্টমেন্টের সামন-পেছন জুড়ে সবুজ আর রূপালি পানির তির তিরানী দেখতে দেখতে উঠে গেলাম তার এপার্টমেন্টে। ঘরে ঢুকতেই চারদিকে চোখ গেল। কোন কিছুতে চোখ ধাঁধানো জৌলুস নেই কিন্তু শিল্পী মনের ছোঁয়া আছে। যতœ ও পরিপাটিতে সুখময় গৃহপরিবেশ। বাংলাদেশের মেয়েরা দেশের বাইরে গেলে সেই দেশের রুচি অনুযায়ী কেমন যেন নিজকে খুব তাড়াতাড়ি বদলে ফেলতে পারে। ঘর গৃহস্থালির বাইরে কর্মস্থলেও তাদের চৌকস কর্মদক্ষতা দেখলে আমি মাঝে মাঝে বিস্মিত হই। পারভেজের ঘরের অন্দর মহলের চেহারা দেখে ওর বৌ সম্বন্ধেও এমন একটা ধারণা আমাকে মুগ্ধ করে।
পারভেজ বলে খালাম্মা! আপনি যে তিন দিন আমাদের সঙ্গে আছেন, আমাদের বেডরুমে থাকবেন। এখান থেকে গোটা সিঙ্গাপুরের দৃশ্য দেখা যায়। আমি আপত্তি জানাতে ওরা স্বামী-স্ত্রী দু’জন এক সঙ্গে হৈ-চৈ করে উঠলো। ওদের আন্তরিক দাবির কাছে আমি হার মানলাম। প্লেনে সারারাত ঘুম হয় নি। খুব ক্লান্ত বোধ করছি। তাড়াতাড়ি গোসল সেরে, নাস্তা খেয়ে ওদের ঘরে ওদের বিছানাতেই শুয়ে পড়লাম। কাঁচের জানালার ভেতর দিয়ে সবুজ গাছের সারি আর তরঙ্গায়িত পানি দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতেও পারি নি। [বাকি অংশ শুক্রবার সাহিত্য পাতায়]

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন