বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ঋণখেলাপি রাষ্ট্রীয় করপোরেশন

| প্রকাশের সময় : ২০ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

রাষ্ট্রীয় কর্পোরেশনগুলোর কাছ থেকে জনগনের সেবা প্রাপ্তির মান এবং রাজস্ব খাতে এসব প্রতিষ্ঠানের অবদানের উপর নির্ভর করে জনকল্যান ও জনপ্রতিনিধিত্বশীল রাষ্ট্রের সামর্থ্য ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। আমরা যখন উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার সক্ষমতা কথা বলছি তখন রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অবক্ষয়, অস্বচ্ছতা ও ব্যর্থতার চিত্র দেখছি। যদিও অর্থনৈতিক সূচক ও জিডিপি প্রবৃদ্ধিই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান অভীষ্ঠ নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে জনগনের আস্থায় আনা, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনকল্যানে নিয়োজিত করার পাশাপাশি আইনের শাসন তথা সুশাসন নিশ্চিত করাই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। সে অর্থে আমাদের দেশ ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছে। প্রতিটি রাষ্ট্রীয়-সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যেমন জনগনের আস্থাহীনতার সংকটে পড়েছে, একইভাবে সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিটি খাতে বিশৃঙ্খলা, নিয়ন্ত্রণহীনতা ও লুটপাটের চিত্র দৃশ্যমান। জননিরাপত্তা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করতে যেমন সরকারী বাহিনীগুলো ব্যর্থ হচ্ছে, পাশাপাশি ব্যাংকিং খাত, রাজস্ব খাত, বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন খাতসহ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পড়েছে। যে সব সরকারী কর্পোরেশন রাজস্ব আয়ের সবচে বড় ভিত্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারত, সে সব প্রতিষ্ঠানই এখন হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। গতকাল একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, রাষ্ট্রীয় ৩০টি করপোরেশনের কাছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পাওনা ৩১ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। শুধুমাত্র বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছেই বাণিজ্যিক ব্যাংকের পাওনা প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা।
অর্থনীতির আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে বার্ষিক অর্থবাজেটের আকারও বেড়ে চলেছে। বিশাল আকারের ঘাটতি বাজেট নিয়ে লক্ষকোটি টাকার উন্নয়ন বাজেটের বাস্তবায়ন করতে প্রায় প্রতি বছরই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে লেজেগোবরে অবস্থায় পড়তে হয়। সরকারের আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের বোঝা মূলত জনগনকেই বহন করতে হয়। সরকারী ঋণ পরিশোধ করতে জাতীয় বাজেটে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। পাশাপাশি যে সব রাষ্ট্রীয় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান জনগনের পক্ষে সরকারের সাথে দেনদরবার করার কথা সে সব প্রতিষ্ঠানকেও নানাভাবে অকার্যকর করে ফেলছে সরকার। জনগনের অর্থায়ন ও বিনিয়োগে গড়ে তোলা রাষ্ট্রীয় কর্পোরেশনগুলোকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানের পরিনত করা মোটেও অসম্ভব নয়, নীতিনির্ধারণ ও নিয়োগে সরকারের সংশ্লিষ্টরা দুর্নীতিমুক্ত থাকলে এবং প্রয়োজনীয় তদারকি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলেই তা সম্ভব। কিন্তু প্রতিটা ক্ষেত্রেই সর্ষের ভেতর ভুতের উপস্থিতি রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে অকার্যকর ও বিশৃঙ্খল করে তুলেছে। ব্যাংকিং সেক্টর, পুঁজিবাজার, বিচারব্যবস্থা, গণপরিবহন, বন্দর ব্যবস্থাপনা, খাদ্য নিরাপত্তা, রাজস্ব খাত পর্যন্ত বিদ্যমান অব্যবস্থপনার জন্য মূলত: সরকারের সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতি ও অদক্ষতাই দায়ী। আইন প্রণেতারা যদি আইন না মানেন, রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা যদি রাষ্ট্রীয় বিধি বিধানের তোয়াক্কা না করেন তাহলে সাধারণ মানুষ আইন মানার উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে, এটাই স্বাভাবিক।
দীর্ঘদিন ধরেই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ গতিহীন হয়ে আছে। বিনিয়োগে গতি আনতে ব্যাংকিং সেক্টরসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা পালন করতে পারতো। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, লুটপাট ও অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সরকারী করপোরেশনের খেলাপী ঋণ এবং বাজেট বাস্তবায়নে ব্যাংকিং সেক্টরের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা বেসরকারী বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এ সে সেক্টরের সম্ভাবনাকে খর্ব করে ফেলা হয়েছে। দেশ থেকে লক্ষকোটি টাকা পাচার এবং ব্যাংকিং সেক্টরে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্র্নীতির সাথেও সরকারের প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশের অভিযোগ আছে। যে প্রতিষ্ঠান জাতীয় বাজেটে রাজস্ব সংস্থানের অন্যতম যোগানদাতা হতে পারত দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনায় অদক্ষ ও দুর্নীতিবাজ লোকদের নিয়োগ দিয়ে সে সব প্রতিষ্ঠানগুলোকে লোকসানি ও ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানে পরিনত করা হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় সম্ভাবনাময় ব্যাংকিং সেক্টরকেও এখন অর্থব ও দায়গ্রস্ত করে ফেলা হয়েছে। সরকারী দলের একদল প্রভাবশালী লোকের দুর্নীতির কারণে ফার্মার্স ব্যাংক এতটাই দেউলিয়া হয়ে পড়েছে যে গত ৬ মাস ধরে গ্রাহকদের আমানতও ফেরত দিতে পারছেনা। অন্তত ৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংককে এখন মূলধন ভেঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতে হচ্ছে বলে গতকাল প্রকাশিত একটি রির্পোটে জানা যায়। জনগনের টাকায় গড়ে তোলা রাষ্ট্রীয় করপোরেশনগুলোই যখন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেনা, তখন ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর হওয়ার নীতি একটি আইনগত বৈষম্যের উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে। সরকারী করপোরেশনগুলোই যদি বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানত ও মূলধন খেয়ে ফেলে তাহলে বেসরকারী বিনিয়োগের ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ হয়ে পড়তে বাধ্য।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন