মো. শরীফুর রহমান আদিল
সরকার শিক্ষার মান্নোয়নে শিক্ষা আইন-২০১৬ প্রণয়ন করে। এর আগে আরো দুবার এই আইনটি জনমত যাচাইয়ের জন্য পাঠানো হয়েছিল তখন আইনের কিছু ধারায় জনমানুষের আপত্তি থাকায় তা প্রত্যাহার করে পুনরায় গত ৩ এপ্রিল প্রকাশ করে এতে প্রতিবন্ধী, অস্টিটিক শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সমতার নীতি অবলম্বন, গাইড বই ও নোট বইকে নিষিদ্ধ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্র্র্র্থীদের চিকিৎসা নিশ্চিতকরণ এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলির সুযোগ করে দেয়ার বিষয়টি জনসাধারণের মাঝে বেশ প্রশংসনীয় হলেও এর কিছু ধারা নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষাবিদ কিংবা দেশের সাধারণ জনগণের রয়েছে দ্বিমত কিংবা আপত্তি যেমন-
এ শিক্ষা আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে শ্রেণীকক্ষে কোন শিক্ষার্থীকে শিক্ষক কর্তৃক কোন শারীরিক শাস্তি কিংবা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না। আর এ বিধান ভঙ্গকারীকে অনধিক ১০ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা তিনমাসের কারাদ- অথবা উভয়দ-ে দ-িত করা হবে! বর্তমানে সমাজে যেভাবে অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে কিংবা সমাজ যে কারণে আজ অনৈতিক হতে বাধ্য হচ্ছে তার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকার কর্তৃক বিভিন্ন আইন দায়ী। সরকার এসব অপরাধ দমনে শিক্ষকদের শক্তিশালী না করে শিক্ষার্থীদের হাতে কেন শিক্ষকদের অপমান করার হাতিয়ার তুলে দিচ্ছে? এ ধরনের আইনের ফলে শিক্ষককে কি আর কেউ সম্মান করবে? এই ধরনের আইনের দ্বারা শিক্ষক তার ছাত্রকে পড়াতে হবে না বরং ছাত্রদের দেয়া কথা সব শিক্ষককে মানতে হবে। কারণ না হলে যে শিক্ষকের এমপিও বন্ধ হয়ে যাবে।
বর্তমানে মফস্বল তথা গ্রামে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবকরাও অসচেতন থাকে। সেক্ষেত্রে এইসব অসচেতন শিক্ষার্থীদের কিভাবে পড়ায় মনোযোগী করা হবে? যেহেতু এটি একটি সমম্বিত শ্রেণীকক্ষ থাকে তাই এসব শ্রেণীকক্ষে দুষ্ট প্রকৃতির শিক্ষার্থীদের বুঝানোর চেষ্টা করবে কে? আর বুঝানোর পরও যদি সে শিক্ষার্থী না বুঝে এবং শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের সাথে বেয়াদপি কিংবা অন্যদের ডিস্টার্ব হয় এমন কিছু নোংরা আচরণ করতে থাকে তবে শিক্ষককে তবু চুপ থাকতে হবে
এটি নামে একটি শিক্ষা আইন হলেও মূলত শাস্তি প্রদান কিংবা বেতন বন্ধের জন্য কেবলমাত্র এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বুঝানো হয়েছে কিন্তু কোচিং বাণিজ্য কিংবা প্রাইভেট টিউশনী সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বন্ধ না করলে তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে সে সর্ম্পকে কিছু বলা হয়নি একইভাবে অন্যান্য যেকোন অপরাধের জন্য সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের দায় মুক্তি দেয়া হয়েছে। সুতরাং এটি একটি একপক্ষীয় আইন, সার্বজনীন নয়।
আজকের দিনে সমাজের চর্তুদিকে কেবল অনৈতিক কাজ কর্ম বেড়েই যাচ্ছে এইসব অনৈতিক কাজকর্ম প্রতিরোধে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা যেভাবে কাজ করে অন্য কোন আইন কিংবা আদালতের রায় এসব অপরাধকে থামাতে পারে না কিন্তু মাধ্যমিক শিক্ষার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি অংশে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে ধর্মীয় শিক্ষাকে রাখা হলো না! আবার, ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনার ক্ষেত্রে বাংলা ও বাংলাদেশ স্টাডিজকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আমাদের দাবি হলো এক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষাকেও বাধ্যতামূলক করা হোক। আমরা জানি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা কোন বয়সে পড়াশুনা করতে আসে আর সে বয়সে তার স্বাধীনতার প্রতি হস্তক্ষেপ না করলে যেকোন অনৈতিক কিংবা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে কিন্তু এবারের শিক্ষা আইনে শিক্ষার্থীদের সেই অনৈতিক স্বাধীনতাই দেয়া হলো! সরকার প্রায়ইশ নোট ও গাইড বইকে নিষিদ্ধের কথা জানালেও শিক্ষা আইন-১৬ তে তা নিষিদ্ধ করা হয়নি। প্রথম অধ্যায়ের ৭নং ধারার ৬নং উপধারা, ৩য় অধ্যায়ের ২১নং ধারার ৫, ৬নং উপধারায় নোট, গাইড বই সর্ম্পকে বরং অন্যনামে এটি চালানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে। আমাদের প্রশ্ন হলো-নোট বই বা গাইড সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে সমস্যা কোথায়?
এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ কিংবা ব্যবস্থাপনা পরিচালনা কমিটির দৌরাত্ম্যের কারণে শিক্ষকরা যে আজ নাজেহাল তা সকলের নিকট ওপেন সিক্রেট; যেমন বিভিন্ন শিক্ষার মলাটে রাজনৈতিক সমাবেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থীও থাকা বাধ্যতামূলক করা নতুবা শাস্তির হুমকি দেয়া প্রভৃতিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা আজ নাজেহাল অবস্থায় নিপতিত, সেক্ষেত্রে যদি এসব পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মধ্যে কোন বিরোধ সৃষ্টি হয় তবে তার দায় ভার শিক্ষক কেন বহন করবে? শিক্ষক কি এসব সদস্যদের মাঝে সমঝোতা করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারেন? এসব সদস্যের অধিকাংশই স্থানীয় ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা কিংবা ব্যক্তিত্ব। অন্যদিকে আর্থিক দায়ভার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে বলা হয়েছে কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান কোথায় থেকে এতো বিপুল অর্থের যোগান দিবে? আবার অন্যভাবে বলা যায় ব্যবস্থাপনা কমিটি কিংবা পরিচালনা কমিটির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত কমিটি তবে প্রশ্ন হলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কমিটি যদি কোন অসুষ্ঠু কাজ করে তবে তার দায় শিক্ষক সমাজ কেন নেবে?
প্রশ্নপত্র ফাঁস, বর্তমান বাংলাদেশে সাধারণ ও নিত্যনৈমিত্তিক এক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র থেকে শুরু হয়ে কোমলমতি শিশুদের ক্ষেত্রেও এটি বর্তমানে একটি তিক্ত ও নির্মম বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলা যায়, এটি বাংলাদেশের পরীক্ষা ব্যবস্থার এক নতুন সংস্কৃতি। যাই হোক, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৯ সালে প্রথম প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় এর পর ১৯৮০ সালে সরকার একে নিয়ন্ত্রণ করতে একটি পাবলিক পরীক্ষা আইন প্রণয়ন করে এবং প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের ১০ বছরের কারাদ-ের বিধান রাখা হয় যদিও তখন প্রশ্নপত্র ফাঁস ততোটা আলোচিত বা, ব্যাধিতে রূপ নেয়নি। বর্তমানে সবচাইতে আলোচিত ও সমালোচিত ব্যাধির নাম প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে যখন সবাই সোচ্চার, তখন ১৯৮০ সালের আইনের শাস্তি ১০ বছর থেকে নামিয়ে ৪ বছরে করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এই গুরু পাপে লঘু দ-ে সবাই সরকারের সমালোচনায় মুখর ছিলেন! আর এবার শিক্ষামন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে শিক্ষা আইন-২০১৬’র যে খসড়া প্রকাশ করছে সেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং এর দ- সর্ম্পকে কিছুই বলা হয়নি! প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে শিক্ষা আইনে কিছু উল্লেখ না করার ফলে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, এর মাধ্যমে সরকার কি প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের উৎসাহ দিচ্ছে?
এই আইনের শেষে সরকার সকল শিক্ষকের মর্যাদা প্রদান করবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু কিভাবে সে মর্যাদা সমুন্নত করা হবে সে সর্ম্পকে কিছু বলা হয়নি। শিক্ষার্থীদের বেলায় যেমন কতগুলো আইন করে দিয়ে তা লঙ্ঘনে শাস্তির কথা বলা হয়েছে শিক্ষকদের মর্যাদার ক্ষেত্রে কেন তা হলো না?
বর্তমানে শিক্ষকদের জন্য সবচাইতে কষ্টদায়ক কাজ হলো পরীক্ষার হলে পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা কেননা, কোন পর্যবেক্ষক হলে শিক্ষার্থীদের বিশৃঙ্খলা কিংবা পারস্পরিক সহযোগিতা করতে না দিতে চাইলে সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর রোষানলে পড়তে হয় এবং দায়িত্ব শেষে বাসায় ফেরার পথে অনেক শিক্ষককে লাঞ্ছিত হতে হয়। কেন না, শিক্ষক যে হল পর্যবেক্ষণ করে তাতে পরীক্ষা দেয় অন্য কলেজের শিক্ষার্থী হলে তারা এসব পর্যবেক্ষককে শিক্ষকের মর্যাদা দিতে চায় না আবার, শিক্ষার্থীদের রোষানল থেকে বাঁচতে যদি একটু উদার হয় তবে ম্যাজিস্ট্রেট এসে ওই শিক্ষককে বহিষ্কার করে। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষা আইনে এসব পর্যবেক্ষকদের তাদের পর্যবেক্ষণ ভালোভাবে দিতে গেলে যদি কোন সমস্যার সৃষ্টি হয় তবে তাতে কি ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা শিকক্ষক নিতে পারবে তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। এছাড়া আরও অনেক অসঙ্গতি রয়ে গেছে এই খসড়া আইনে। এসব অসঙ্গতি দূর না হলে এ আইন শিক্ষার মান উন্নয়নে সহায়ক না হয়ে বরং আরও জটিলতা সৃষ্টি করবে।
ষ লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন