মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

বাংলাদেশে ইতিহাস বিতর্ক ও সত্য উন্মোচনের দায়

প্রকাশের সময় : ১৩ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী

কোনো জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য সে জাতির অমূল্য সম্পদ, এগিয়ে চলার পাথেয় ও প্রেরণা। জাতি গঠনের হাজার বছরের ধারাবাহিক পথযাত্রা যুদ্ধ, রাষ্ট্রবিপ্লব, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিবর্তন বিকাশের পথ ধরে এগোয়। ইতিহাসের সেসব গতিপথের পাত্র-পাত্রী বা কুশীলবদের মধ্যে একাধিক রাজনৈতিক মতাদর্শের সংশ্লেষ থাকায় কখনো কখনো পপুলার হিস্ট্রি নিয়ে দ্বন্দ্ব ও মতপার্থক্য তৈরি হতে দেখা যায়। তবে দেশের জনগণ সেসব রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও মতপার্থক্য অতিক্রম করেই এক সময় ইতিহাসে নিজেদের সত্যিকারের প্রতিনিধি ও নেতৃত্বের স্থান সুনির্দিষ্ট করে দিতে সক্ষম হয়। রাজনৈতিক ক্ষমতাসীনদের আদর্শিক দ্বন্দ্ব অতিক্রমণের সে পথ অনেক দীর্ঘ হতে পারে। তবে জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে যত দ্রুত একটি সর্বজনীন জাতীয় ঐক্যে পৌঁছতে পারবে জাতি তত দ্রুত তার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়।
স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পেরিয়ে এসেও বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ ইতিহাসের রাজনৈতিক বিকৃতির ঘূর্ণাবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিদেশি বন্ধুরা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেমন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, একইভাবে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে চলার পথেও তারা উন্নয়ন সহযোগীর ভূমিকা পালন করে চলেছে। এমনকি যেসব দেশ একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে অখ- পাকিস্তানের পক্ষে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছিল সেসব দেশও স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। কর্পোরেট পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক শোষণ এবং সা¤্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক এজেন্ডার বিষয়গুলো বাদ দিলে পশ্চিমা উন্নয়ন সহযোগীরা দৃশ্যত বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে একটি স্থিতিশীল পরিবেশ দেখতে চায়। আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হয়। ভৌগোলিক ও ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানগত কারণে শুরু থেকেই বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং অস্থিতিশীলতার কারণেই বাংলাদেশ তার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্ভাবনার অর্ধেকও কাজে লাগাতে পারছে না। বিদ্যমান রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও মতপার্থক্যে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বণ্টন ব্যবস্থার চেয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ ও ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগারগুলোর অস্বচ্ছতাই এখন বড় ধরনের ফাটল সৃষ্টি করে চলেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার রাজনৈতিক প্রচারণা-প্রোপাগান্ডা ও পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বক্তৃতা-বিবৃতি অথবা বিভিন্ন সূত্রে প্রচারিত তথ্যাবলী ইতিহাসের আলোচ্য বিষয় হলেও এর সবকিছুই ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত সত্য নয়। ঐতিহাসিক সত্য হতে হয় যুক্তি ও বাস্তবতার পাথরে খোদাই করা শিল্প, যা প্রামাণ্য দালিলিক। যদিও এ সত্য রাজনৈতিকভাবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। যদি কোনো বড় রাজনৈতিক শক্তির অনুসারীরা মনে করেন, সত্য উন্মোচিত হলে ব্যাপক রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণায় প্রতিষ্ঠিত নিজেদের অনুকূল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলতে পারে, সেখানেই ইতিহাসকে অস্বচ্ছ ও হাইপোথেটিক্যাল পপুলার ইস্যুতে সীমাবদ্ধ রাখার প্রয়াস দেখা যায়। বাংলাদেশের ইতিহাসিক বিতর্কগুলো সে ধরনের বিরোধপূর্ণ অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে কিনা তা এখন বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে।
কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে যখন চরম রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিশৃঙ্খলা এবং রাজনৈতিক হানাহানি চলছিল, তখন কোনো কোনো বিদেশি মিডিয়ায় বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস, বিশেষত স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিভক্তি ও তিক্ততা কমিয়ে ফেলার আহ্বান জানানো হয়েছিল। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত কোনো সংবাদ নিবন্ধের শিরোনাম ছিলÑ ‘বাংলাদেশ মাস্ট বারি দেয়ার পাস্ট’। অর্থাৎ বাংলাদেশকে তার অতীতকে কবর দিয়ে সামনে এগোতে হবে। গত কয়েক দশকে বিশ্বের অনেক দেশই দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ও জাতিগত সংঘাত থেকে বেরিয়ে জাতীয় সমঝোতায় পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। ‘ফরগেট অ্যান্ড ফরগিভ’ অথবা ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশনের মধ্য দিয়ে এসব দেশ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাক্সিক্ষত সোপানে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা, কানাডা, যুগোশ্লাভিয়া, কেনিয়া, কঙ্গো, লাইবেরিয়া এবং শ্রীলঙ্কার নিকট ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দেয়। অতীতকে ভুলে যাওয়া এবং অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে চলার মধ্যে যে পার্থক্য আছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ঊনবিংশ শতকের ব্রিটিশ অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ আনর্ল্ড টয়েনবি লিখেছিলেন, ‘হিস্টরি ইজ অ্যা গ্রিক ওয়ার্ড হুইচ মিনস, লিটার‌্যালি, জাস্ট ইনভেস্টিগশেন’। অর্থাৎ ইতিহাস মানেই ‘অনুসন্ধান’। ইতিহাসের চলার পথ অনুসন্ধান অবিরাম। রাজনৈতিক বক্তৃতাবাজি ও কল্পকথার ভেতর থেকে প্রকৃত সত্যের আলো ফেলে ইতিহাসকে তুলে আনতে হয়। ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম- সে কখনো করে না বঞ্চনা’ ইতিহাসের সত্যকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে রবীন্দ্র্রনাথের এই উক্তি দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য সহায়ক হতে পারে। ইতিহাসের নির্মাণ ও নির্মাণের সাক্ষী প্রত্যেক রাজনৈতিক নেতৃত্ব অথবা মুক্তিকামী মানুষের প্রতিনিধির জন্য ইতিহাসে নিজস্ব স্থান নির্ধারিত হয়ে যায়। জনগণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই ইতিহাসিক সত্যের মূল উপাদান। যুদ্ধ বিজয়ী রাজা বা স¤্রাটরা ভাড়াটে লোক দিয়ে ইতিহাস লিখিয়ে নিজেদের গ্লোরিফাই করার চেষ্টা করেছিলেন, তাও পরবর্তীতে ইতিহাসে লিখিত হয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় এভাবেই ইতিহাস পরিণতি লাভ করে।
সম্প্রতি লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ধারাবাহিক ইতিহাস নিয়ে প্রকারান্তরে আরো গবেষণা এবং মতভিন্নতাকে গ্রহণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশ যে কিনা স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি দেশ থেকে ভেঙে আরেকটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে তার জন্য ইতিহাসের এই অভিযোজন আরো বেশি জরুরি বলে মনে করে গার্ডিয়ান। বর্তমান সরকারের প্রস্তাবিত ‘মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ বিল’ আইনের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করেছে গার্ডিয়ান। ‘বাংলাদেশ হিস্টোরি ডিবেট : ডিস্টোর্টেড বাই পলিটিক্স’ শিরোনামের এই সম্পাদকীয় নিবন্ধের শুরুতেই পরিণত দেশগুলোর নিজেদের ইতিহাস নিয়ে গবেষণায় প্রস্তুত থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরা হয়েছে। পরিস্থিতির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে যুদ্ধের সময়কার প্রোপাগান্ডা ও বিদ্বেষমূলক অপপ্রচার পরিহার করে পারস্পরিক শত্রুতা ভুলে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। সাড়ে চার দশক আগে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনকারী বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এখনো ইতিহাস নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। এখনো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক ফ্যাক্টস মীমাংসিত নয়। এহেন বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ভিন্নমত পোষণকারীদের শাস্তি দেয়ার আইন হিসেবে ‘মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ’ আইনকে ইনেকোরেট বা ভ্রমাত্মক হিসেবে অভিহিত করেছে গার্ডিয়ান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিহতের সংখ্যা তিন লাখ থেকে তিরিশ লাখে ওঠানামা করছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ অথবা নিহতদের সংখ্যা নিয়ে সরকারি-বেসরকারিভাবে এখনো ফলপ্রসূ কোনো জরিপ না হওয়ায় ব্যক্তিগত আগ্রহে গবেষণার আলোকে নানাজন ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যা উপস্থাপন করছে। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখিকা শর্মিলা বসু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত ও হতাহতের সংখ্যাসহ আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। ২০১১ সালে সি হার্স্ট অ্যান্ড কোং থেকে প্রকাশিত ‘ডেড রেকনিং : মেমোরিজ অব দ্য ১৯৭১ বাংলাদেশ ওয়ার’ (ডেড রেকনিং ১৯৭১-এর বাংলাদেশ যুদ্ধের স্মৃতি) নামক গ্রন্থের লেখিকা ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ঘুরে সংগৃহীত তথ্যের আলোকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত অবাঙালিসহ নিহতদের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ বলে অভিহিত করেছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর হাতে জেনোসাইড বা গণহত্যা একটি প্রমাণিত বিষয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের জরিপভিত্তিক তালিকা না থাকায় ‘তিরিশ লাখ শহীদ’ নিয়ে বিতর্ক উঠতে পারে। তাই বলে এ সংখ্যা ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ মাত্র। তবে স্বাধীনতার জন্য মাত্র ৯ মাসে ১ লাখ মানুষ প্রাণ দেয়ার নজিরও বিশ্বে খুব কম দেশের আছে। শর্মিলা বসুর বইয়ের বিপরীত চিত্রও আছে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনৈক কালিদাস বৈদ্যের লেখা ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ : অন্তরালের শেখ মুজিব’ শিরোনামের গ্রন্থে কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের বিকৃত উপস্থাপনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আলেম সমাজকে প্রবল প্রতিবাদে ফেটে পড়তে দেখা গেছে। এই গ্রন্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ হিন্দুুকে হত্যা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যক্তিগত ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে লেখা এসব ‘বিতর্কিত’ গ্রন্থের কোনোটাই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশি সংবাদকর্মী এবং ডিপ্লোম্যাটদের অনেকে বিশ্ব জনমত গঠনের পাশাপাশি সে সময়কার ইতিহাসকে নিজেদের মতো তুলে ধরে ইতিহাসের পথকে কিছুটা সহজ করে দিয়েছিলেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ সংগঠক, সেক্টর কমান্ডারসহ অনেকের প্রামাণ্য গ্রন্থ রয়েছে। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর আমরা যখন যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করে সর্বোচ্চ দ- নিশ্চিত করতে পারছি। শহীদের সংখ্যাসহ আমাদের ইতিহাসের বিতর্কিত ও অস্বচ্ছ বিষয়গুলো অপনোদন করা কি এর চেয়েও কঠিন? মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কমান্ডার লে. জেনারেল জেকবের লেখাÑ সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা, পাকিস্তানি সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাসের লেখা দ্য রেপ অব বাংলাদেশ, কুতুবুদ্দিন আজিজের লেখা ব্লাড অ্যান্ড টিয়ার্স-এর মতো গ্রন্থগুলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনেক বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে সহায়ক হতে পারে। বিদেশিরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে নিজেদের মতো গবেষণা করে গ্রন্থ রচনা করছে আর আমরা যার যার সুবিধামতো রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করছি অথবা ভিন্নমতের হলে ‘বিতর্কিত’ বলে একবাক্যে উড়িয়ে দিচ্ছি। অথচ আমরা ইতিহাসের অসত্যগুলোকে রেক্টিফাই করার কোনো জাতীয় উদ্যোগ দেখছি না। জাতীয় ইতিহাস নিয়ে বিদেশিদের অব্যাহত নসিহত ও বিভ্রান্তিকর তথ্য মুক্তিযুদ্ধের ইহিতাস সম্পর্কে জাতিকে আরো বিভক্ত করে তোললেও আমাদের সরকার এবং অ্যাকাডেনিসিয়ানদের নীরবতা বিস্ময়কর। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইতিহাস পড়ানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষকরা বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ গঠন করেছেন। গত বছর ইতিহাস পরিষদের ৪৫তম বার্ষিক সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক দেশের ইতিহাসবিদদের উদ্দেশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সঠিক ইতিহাস রচনার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রজ্ঞাবান সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সেমিনারে উপস্থিত সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। প্রসঙ্গক্রমে তিনি এও বলেন, এদেশের ইতিহাসকে উপহাসে পরিণত করা হয়েছে। ইতিহাস সত্য না হলে তা ইতিহাস নয়। ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যক্তিগত সাক্ষী এবং খবরের কাগজে প্রকাশিত রিপোর্ট ইতিহাসের খ-িত অংশমাত্র উপস্থাপন করতে পারে। সামগ্রিক ও প্রকৃত সত্যকে তুলে আনতে হলে রাজনৈতিক ক্ষমতার পালা বদলের মধ্যেও শাসকদের রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন থাকতে হয়। ইতিহাসের নায়ক, মহানায়কদের অবস্থান ইতিহাসই নির্ধারণ করে দেয়। কোনো সাময়িক আবেগ, তথ্যের অতিরঞ্জন অথবা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ তাদেরকে খাটো বা বড় করে তোলতে পারে না। আইনগত বিধিনিষেধ আরোপ করে ইতিহাসের সত্যকে দীর্ঘদিন আড়াল করে রাখা যায় না। আর আইনের হাত যতই লম্বা হোক, কোনো দেশের নিবর্তনমূলক বা অসৎ উদ্দেশ্যে প্রণোদিত আইন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গ্রাহ্যে রাখে না। প্রস্তাবিত ‘মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ’ আইন সম্পর্কে গত শনিবার ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত নিউজ অ্যানালিসিসে এই আইনকে বাক-স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আরেকটি হুমকি হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। লন্ডনের গার্ডিয়ানে একই দিনেই এই আইনের বিরূপ দিকগুলো উল্লেখের পাশাপাশি ইতিহাসের সত্য উন্মোচন এবং মতভিন্নতা কমিয়ে আনার বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ দেয়া হয়েছে। আমাদের ইতিহাসের অমীমাংসিত ইস্যুগুলোতে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার বদলে জাতিকে নতুনভাবে বিভক্ত করে ফেলার সব ধরনের আয়োজন ও তৎপরতাই বেশি দেখা যাচ্ছে। তথ্যপ্রবাহ ও তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বায়নের এই যুগে এখন কোনো জাতির কোনো গুরুত্বপূর্ণ অপ্রকাশিত বিষয়কে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জোরে চেপে রাখা সম্ভব নয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্যের স্বাভাবিক আইনসিদ্ধ প্রবাহ বন্ধ রাখা হলে প্রোপাগান্ডা, গুজব ও মিথ্যা তথ্যের দ্বারা জনগণ বিভ্রান্ত হতে পারে। অতীতের তিক্ততা পরিহার করে যখন নতুন উদ্যমে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা, তখন আমরা অপাঙ্তেয় আইন করে বিশ্বের কাছে ভিন্ন মেসেজ দিচ্ছি। জাতির ইতিহাস ¯্রফে লিখিত গ্রন্থমাত্র নয়, জনগণের সম্মিলিত প্রয়াসে দীর্ঘদিনে জাতির ইতিহাস গড়ে ওঠে। ইতিহাসকে পরিবর্তন করা যায় না, তবে পুনর্মূল্যায়ন করা যায়। ইতিহাসের সত্য উন্মোচন আগামী প্রজন্মের কাছে এই প্রজন্মের দায়বদ্ধতার অংশ। এই দায় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন