শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

আশার কথা : মাদকের গডফাদারদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান হচ্ছে

আতিক সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ২৩ জুন, ২০১৮, ৯:৫৪ পিএম

মাদকে ডুবতে বসেছে দেশের যুবসমাজ। ভয়াল রূপ নিয়েছে এ সমস্যা। সমস্যা যাই হোক না কেন যদি স্থায়ী রূপ ধারণ করে, তাহলে একটা সময় তা যেন গা সওয়া ব্যাপারে পরিণত হয়ে যায়। আমাদের দেশে মাদকসমস্যা তেমনই এক সমস্যা, যা সমাধানের তেমন কোন উদ্যোগ ছিল বলে মনে হয় না। তরুণ্যের গতিময় পথচলা মাদক যেন অক্টোপাস হয়ে টেনে ধরেছে। ঠেলে দিচ্ছে পুঁতিগন্ধময় অন্ধকার জীবনে। অকাল মৃত্যু হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওই সব বিপদগামী সন্তানের অসহায় পিতামাতাকে। দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের বড় একটা অংশ এই আত্মঘাতি আসক্তির শিকার। যেকোন মূল্যে একে রুখতেই হবে। তবে মাদকাসক্তি শুধু এ বয়সিদের মধ্যেই যে সীমাবদ্ধ তা নয়, প্রাপ্তবয়স্ক, এমনকি শিশু-কিশোরদের মধ্যেও ভয়ঙ্কর পরিণতি নিয়ে মাদকাসক্তি ছড়িয়ে পড়েছে। মাদকাসক্তির কোন নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ নেই শহরের পাড়া-মহল্লা থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত তা ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপকহারে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টি সঠিক কোন তথ্য বা পরিসিংখ্যান পাওয়া যায় না কোন মন্ত্রণালয় অধিদপ্তর পরিদপ্তর বা বিভাগে। যতদূর জানা যায়, দেশে কত মানুষ মাদকাসক্ত এর কোনো হিসাব মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কিংবা সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। পরিসংখ্যান না থাকায় কোনো মাথা ব্যথাও নেই সংশ্লিষ্টদের। এ থেকে বোঝা যায় সমস্যাটি সরকারের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে কতটুকু। না মোটেও গুরুত্ব পায়নি। সংখ্যার হিসাব প্রকাশ পেলে সমস্যাটা কতো তা থেকে তথ্য-উপাত্ত যাচাাই এবং করণীয় সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে একটি দিকনির্দেশনা পাওয়া যেতো। দেরিতে হলেও পরিস্থিতি ভয়াবহ বলেই এ ধরনের একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়েছে। এ উদ্যোগকে সাধুবাদ না জানিয়ে উপায় নেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০ জুন বুধবার সংসদে বলেছেন, ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন আরও কঠোর করতে মাদক ব্যবসার পৃষ্টপোষক গডফাদারসহ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ প্রণয়ন করা হচ্ছে। মাদক ব্যবসায়ীদের বিচারহীনতা এবং প্রচলিত আইন এবং সাজার ধরন ও পরিমাণ যথেষ্ট না হওয়ার কারণে দেশে মাদকদ্রব্য কেনাবেচা চলছে অবাধে। বিদ্যমান আইনে কোন ব্যক্তির দখলে কর্তৃত্বে বা অধিকারে মাদক দ্রব্য পাওয়া না গেলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ না থাকায় মাদকব্যবসায় জড়িত মাস্টারমাইন্ডরা অধরা থেকে যায়। পুলিশ সদস্য ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের একাংশের সাথে যোগসাজশেই মাদকের এমন রমরমা ব্যবসা চলে আসছে অবাধে দীর্ঘদিন ধরে। অবৈধ পথে বিদেশ থেকে এসব মাদকদ্রব্য আসছে এটা নিশ্চিত বলা যায়। আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি’র সদস্যদের অনেকেই সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না বলেই এত অনায়াসে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য আসছে। তারা দায়িত্ববান হলে মাদকের এতটা বিস্তার সম্ভব ছিল না সে কথা কাউকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। সীমান্তপথে মাদক চোরাচালান বন্ধে এবং দেশের ভিতরে মাদকদ্রব্যের অবাধ কেনাবেচা কঠোর হাতে বন্ধ করতে স্থায়ী চিন্তা করতে হবে। আর এ জন্যে তদারকি কাজে নিয়োজিত ব্যাক্তিদের মূল্যায়ণ-সমীক্ষা নিয়মিত দায়িত্বের মধ্যে আনতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে বাড়াতে হবে প্রয়োজনীয় জনবল। বিজিবি, পুলিশ, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে জবাবদিহিতার আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব নিয়ন্ত্রণে আনা একান্ত জরুরি। অপ্রিয় হলেও সত্য, তাদের একাংশের সহযোগিতা ছাড়া এ মাত্রায় মাদকের ব্যবসা চলা কিছুতেই সম্ভব নয়।
আমাদের দেশে বীভৎস আর পৈশাচিক হত্যা নির্যাতন দিনদিন যেন বেড়েই চলেছে। এসব হত্যা নির্যাতনের কোন কোনটির সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনে প্রচারিত সচিত্র প্রতিবেদন, ভিডিওি কিংবা অডিও প্রকাশ হওয়ায় এসব নৃসংশতার সাক্ষী হচ্ছি আমরা প্রতিনিয়ত। এর মধ্যে টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হত্যার অডিও টেপ দেশবাসীকে বেদনার্ত করেছে। অমানবিক এসব ঘটনা দেখতে দেখতে আমরা পাথরে বুক বেঁধেছি। যেন এসব মৃত্যু বা হত্যাকাÐ আমাদের পাষাণ হৃদয়কে নাড়া দেয় না। তবে একরামুলের অডিও ক্লিপটি কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমাদের সেই পাষাণ হৃদয়কে প্রচÐ ঝাঁকিয়েছে! ঘুম হারাম করে দিয়েছে দেশের অগুনতি মানুষের। আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইছে সামাজিক মাধ্যমেও। ঝড় উঠেছিল সরকারদলীয় এক সংসদ সদস্যেকে নিয়েও। গত ১ জুন ওই সংসদ সদস্য ওমরাহ পালনের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন। অবশ্য তার ঘনিষ্ঠজনদের বিরুদ্ধে মাদক কারবারে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। তিনি নিজে এ কারবারে জড়িত নেই বলে বারবার বলে আসছেন। ইতোমধ্যেই তিনি দেশে ফিরেছেন এবং তার নির্বাচনী এলাকা উখিয়া উপজেলায় তাকে সংবর্ধনা দিয়েছে সেখানকার নেতাকর্মীরা।
চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে মাদকসেবীদের সাথে বন্দুক যুদ্ধে অনেক মানুষ নিহত হয়ছেন। এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন জানিয়েছেন, ৪ মে থেেক ৩১ মে পর্যন্ত এই অভিযানে ১২৭ জন নিহত হয়েছেন। তবে এ সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম। শুরু থেকেই বিচার বহির্ভূত এইসব হত্যাকাÐ নিয়ে প্রশ্ন ছিলো। আজও রয়ে গেছে। সচেতন সমাজ সবসময় এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ এবং বিরোধিতা করবে এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। এ ধরনের ঘটনা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে আসছেন মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং নাগরিক সমাজ। একরাম হত্যার অডিও প্রকাশের পর চলমান মাদক বিরোধী অভিযান সর্ম্পকে প্রশ্ন তুলে অবিলম্বে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ছেন দেশের শীর্ষ দশ বুদ্ধিজীবী। তারা বলেছেন, এই অভিযানে প্রতিদিন অনেক মানুষ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাÐের শিকার হচ্ছেন। যা পুলিশ বন্দুক যুদ্ধে নিহত বলে বর্ণনা করে চলেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যবস্থায় এমন মৃত্যু কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। তারা আরও বলেন, সংবিধানে প্রদত্ত জীবনের অধিকার এভাবে কেড়ে নেয়া যায় না।
মাদক মানুষের জীবন সংহারি বস্তু। আমাদের জাতীয় অগ্রগতির প্রতিবিন্ধকও এটি। তাই এটাকে নির্মূল করার বিকল্প নেই। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু চলমান অভিযানে বিচার বহির্ভূত হত্যার ঘটনা এই অভিযানকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধই করবে না এর সাফল্যকেও ¤øান করে দিতে পারে। তাই সরকারের উচিৎ, মাদকের সাথে জড়িত সকল শ্রেণির লোকদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। সে ব্যক্তি চুনোপুটি না রুই কাতলা যেটাই হোক বিচারের মুখোমুখি তাকে হতেই হবে।
যে সকল দ্রব্য সামগ্রী সেবন বা ব্যাবহার করলে আসক্ত হয় সে সব দ্রব্যই মাদকদ্রব্য। এক কথায় বলা যেতে পারে যে সব দ্রব্য মস্তিষ্কের উপর বিরূপ ক্রিয়া করে আচরণে পরিবর্তন আনে এমন নেশা সৃষ্টিকারী বা চিত্তবিভ্রমকারী দ্রব্যগুলোই মাদকদ্রব্য। মাদকদ্রব্য দুইভাবে বাজারে পাওয়া যায়। যার একটি প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মাদকদ্রব্য ও অপরটি রাসায়নিক উপায়ে তৈরি মাদকদ্রব্য। প্রাকৃতিক উপায়ে যে সমস্ত মাদকদ্রব্য উৎপন্ন হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে গাছ-গাছড়া থেকে পাওয়া আফিম, তাড়ি, গাঁজা। রাসায়নিক পক্রিয়ার মাধ্যমে যে মাদকদ্রব্য উৎপন্ন করা হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে প্যাথেডিন, মরফিন, ডায়াজিপাম বা চেতনানাশক ইনজেকশন, মদ, এলএসডি, হিরোইন। রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় পাওয়া মাদকদ্রব্য প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপন্ন মাদকদ্রব্যের চেয়ে অনেক বেশি নেশা সৃষ্টি করে। প্রাকৃতিক উপায়ে পাওয়া মাদকদ্রব্যের চেয়ে রাসায়নিকভাবে তৈরি মাদকদ্রব্য মানবদেহের জন্য অনেকবেশি ক্ষতিকর। মাদকদ্রব্য নিয়মিত কিম্বা অনিয়মিত সেবন বা গ্রহণের ফলে যেসব মানসিক ও শারীরীক নির্ভরতা সৃষ্টি হয় এবং তা ক্রমাগত গ্রহণের বা সেবনের মাত্রা যাকে আমরা ডোজ বলতে পারি তা যদি বৃদ্ধি পেতে থাকে সেই অবস্থা মাদকাসক্তের জন্য প্রাণহানির কারণ হতে পারে। মাদকাসক্তি যে কত তীব্রভাবে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি, ব্যক্তিত্ব ও ইচ্ছাশক্তির ক্ষতি সাধন করতে পারে সে ছবি মনে করলে শিউরে উঠতে হয়। মাদকাসক্তি সম্ভাবনাময় সৃজনশীল কর্মচঞ্চল মেধাবী তারুণ্যকে আংশিক নয় পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। গোটা জাতিকে এক ঘন কালো অন্ধকারে নিয়ে যায়। মাদকে যেমন খারাপ চরিত্রের মানুষ মাদকাসক্ত হয় সহজেই। তেমনি ভালো মানুষও এর কবলে পড়তে পারে। মানসিক কারণে, সামাজিক কারণে ও জৈবিক কারণে সাধারণভাবে একজন মানুষ মাদকে আকৃষ্ট হয়ে অমানুষ হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়াও অন্য অনেক কারণ রয়েছে যেসব কারণের মধ্যে রয়েছে অপরিণত মন, ওষুধ গ্রহণের ফলাফল বুঝতে না পারা, ব্যক্তিত্বের অভাব, অবহেলা সন্তানের প্রতি মা-বাবার মায়া-মমতার অভাব, জীবনের উদ্দেশ্যহীনতা, মাদকের প্রতি কৌতূহল, ধূমপানের বদভ্যাস, পরিবার ও ব্যক্তি জীবনে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব। পারিপার্শ্বিক চাপ, বন্ধু বান্ধবের প্রলোভন ও প্ররোচনা, রোমান্সকর অভিজ্ঞতা পাওয়ার তীব্র বাসনা, প্রেমে বিচ্ছেদ, প্রিয়জনের সাথে বিচ্ছেদ বা ভালোবাসায় ব্যর্থ হলে, মাত্রাতিরিক্ত অনুকরণ প্রবণতা, বেকারত্ব, আর্থসামাজিক অস্থিরতা এবং মাদকের কুফল সম্বন্ধে অজ্ঞতা, চিত্তবিনোদন, শৈশবের অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে যথেষ্ঠ প্রভাব বিস্তারের কারণে, সন্তানের সামনে মা-বাবার উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ও ঝগড়াঝাটি করা, সন্তানের দায়িত্ব তৃতীয় কোন ব্যক্তির কাছে দিয়ে বাবা-মায়েদের স্বেচ্ছাচারীতা এবং সন্তানকে তার প্রাপ্য আদর সোহাগ, ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করা, পরিবারের সাথে কোন মাদকাসক্ত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠতা বা যাতায়াত থাকা, মাতা-পিতার মাত্রাতিরিক্ত আদর-আস্কারাও মাদকাসক্ত হতে সহায়তা করে থাকে। মাদক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সরকারকে নিরাময় বা সংশোধন কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ রাষ্ট্রের অর্জনকে ভূলুন্ঠিত করে চলেছে। মাদকাসক্ত ব্যক্তি নিজেকে পরিবার প্রিয়জন সমাজ দেশ ও জাতিকে নিয়ে যায় এক কঠিন অথচ অচল ক্ষয়িঞ্চু জীবনে।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন