বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ব্যাংকিং খাতকে সিস্টেমের মধ্যে আনতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৬ জুলাই, ২০১৮, ১২:০২ এএম

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকের কার্যক্রমে মানুষের মধ্যে কিছুটা সন্দেহ বা অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষনে তিনি তার এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে আরো বলেছেন, ব্যাংকের কার্যক্রম মানুষের মধ্যে যে অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে ব্যাংকগুলোর জন্য তা অশনিসংকেত। পরিস্থিতি উত্তরণে সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সঠিক জায়গায় সঠিক ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবে। সেইসঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক অবস্থা যে অত্যন্ত শোচনীয়, সেটা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ব্যাংকিং খাত অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি হিসাবে কাজ করে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমাদের গোটা ব্যাংকিং খাত অনিয়ম-দুর্নীতি, অর্থলোপাট, অর্থপাচার ইত্যাদির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এই পটপ্রেক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের বক্তব্য যে সঠিক ও অত্যন্ত প্রনিধানযোগ্য তা বলতেই হবে। ব্যাংকিং খাতে আস্থা ও বিশ্বাসই প্রধান পুঁজি। সেই পুঁজিতে টান পড়েছে। এটা ব্যাংকগুলোর জন্য অশনিসংকেত ছাড়া আর কি হতে পারে? বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাংকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অথচ বিনিয়োগে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছেনা ব্যাংকগুলো। প্রকৃত উদ্যোক্তা কমই সহযোগিতা পাচ্ছে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে। সরকারী ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারের লোকদের ঋণ দিচ্ছে। বেসরকারী ব্যাংকগুলোর অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে মালিক-পরিচালকরা। দু’তরফেই দেয় ঋণের অধিকাংশই অনাদায়ে খেলাপী ঋণে পরিণত হচ্ছে। দৃশ্যগ্রাহ্য বিনিয়োগ ও তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতি বছরই খেলাপী ঋণের পাহাড় স্ফীত হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কাড়ি কাড়ি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে সন্দেহজনক লেনদেনও ক্রমবর্ধমান।
একদিকে ব্যাংকগুলোতে বেশুমার বিনিয়োগযোগ্য অর্থের অবস্থিতির কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না। কিছুদিন ধরে বলা হচ্ছে, শিল্পঋণের সুদহার যদি সিঙ্গেল ডিজিটে আনা হয় তাহলে বিনিয়োগ উজ্জীবিত হবে। সে অনুযায়ী সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাস্তবে দেখা গেছে, গৃহীত সিদ্ধান্ত কোনো কোনো ব্যাংকে কার্যকর হয়েছে, কোনো কোনো ব্যাংকে হয়নি। ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ এবং আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ করা হয়েছে। ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ করা হলেও আসলে নানা ফি ও চার্জ সংযুক্ত করায় তা আর ৯ শতাংশে থাকছে না। ১০-১২ শতাংশ বা তারও বেশী হয়ে যাচ্ছে। এতে আগের মতোই বিনিয়োগ নিরূৎসাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে আমানতের সুদহার আগের চেয়ে কমে যাওয়ায় গ্রাহকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলোতে আমানতের পরিমাণ কমে যেতে শুরু করেছে। গ্রাহকদের অনেকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ঝুঁকে পড়েছে। অনেকে ঢুকে পড়েছে শেয়ার বাজারে। সঞ্চয়পত্রের বিক্রী এবং শেয়ারবাজারে অর্থের সমাগম বৃদ্ধিই এর প্রমাণ বহন করে। ব্যাংকিং খাতকে কোনোভাবেই সুনির্দিষ্ট সিস্টেমের মধ্যে আনা সম্ভব হচ্ছে না। এর অনিবার্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া সংশ্লিষ্ট সকল ক্ষেত্রেই পড়ছে। বাণিজ্য ঘাটতি পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে। প্রকাশিত তথ্য মতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৯৩৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আর সদ্য সমাপ্ত অর্থ বছরের ১১ মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭২২ কোটি ৮০ লাখ ডলার। টাকার অংকে এর পরিমাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। খাদ্য ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি এবং রফতানি আয় কমার কারণে এই বিপুল ঘাটতি হয়েছে বলে দাবি করা হলেও প্রকৃত আমদানি কতটা হয়েছে রফতানিই বা কতটা হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ আছে সংশ্লিষ্টদের অনেকেরই। যারা সন্দেহ করেন তাদের মতে, আমদানি-রফতানির অনিয়মে মোটা অংকের অর্থ বাইরে চলে গেছে। এখানে ব্যাংকগুলোর স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। টাকার মূল্যমান হ্রাস ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস ইত্যাদি সব মিলে দেশের অর্থনীতির যে চিত্রটি সামনে এসে দাঁড়ায় তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং তাকে একটি সিস্টেমের মধ্যে আনা সম্ভব না হলে আগামীতে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে উঠতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের স্বার্থে এবং অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে ব্যাংকিং খাতকে মানুষের কাছে আস্থাশীল ও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার বিকল্প নেই। এবার নির্বাচনের বছর হওয়ায় অর্থের প্রয়োজন খুব বেশী হবে। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হবে। অনুৎপাদনশীল খাতে অর্থের একটা বড় অংশ চলে যাবে। আগের সব নির্বাচনের বছরের মতো এবারও অধিক পরিমাণে অর্থ পাচার হতে পারে। প্রবাসী আয় ও রফতানি আয় কমারও আশংকা রয়েছে। এমতাবস্থায়, ব্যাংকিং খাতকে যে কোনো মূল্যে সুশাসনের আওতায় আনতে হবে, এই হযবরল অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন