এতোদিনের ঠান্ডায় শীতল হয়ে যাওয়া ভালোবাসাটা এবার বোধহয় আরো খানিকটা জমে ওঠবে। সিনড্রোম সেরকমই মনে হচ্ছে। বহু বছর পর সেঁজুতি ফিরে এসেছে। হ্যাঁ, আমার হারিয়ে যাওয়া সেঁজুতির কথাই বলছিলাম...। বহু ঘাটপাট পেরিয়ে আবার তাকে খুঁজে পাব ভাবিনি। যদিও আমার স্বভাব চরিত্র অতটা ভালো নয়। সমাজে এই নিয়ে লোকমুখে নানান কথা চাউর রয়েছে। অবশ্য এসব ভাবার মতো আমার খুব একটা বাতিকও নেই। হায়া লজ্জা আমাকে দেখে হেসে কুটিকুটি হয়। বরং এসব আমার থেকে কমসে কম ১০০ হাত দূরে থাকে। থোড়াই কেয়ার। সেদিন বড় রাস্তার নির্জন মাঝপথে সেঁজুতিকে একঝলক দেখা। সেঁজুতিকে মুগ্ধতা নিয়ে দেখতে লাগলাম। আহ! চোখ দু’টো সেই আগের মতই রয়েছে। জাদুময়ী নিষ্পাপ ও স্বচ্ছ। শরীরটা শুধু নেই আগের মতো। শুকিয়ে লিকলিকে ও প্যাঁক প্যাঁকে হয়ে গেছে। বাতাসে দোল খাওয়া ঝলমলে দীঘল কালো রেশমি ঘনচুুলগুলোও তেলহীন রুক্ষ, অবিন্যস্ত, উসকো খুসকো ও বিধ্বস্ত। রূপ, যৌবনেও ভাটা পড়েছে। আগের মতো নেই ভোরের স্নিগ্ধতা মাখা সুুুুবাস সুুষমাটুুুকুও। কথায় কথায় যে গালে লাস্যময়ী টোল পড়ত, সেখানে এখন কথা বললে বিচ্ছুরি লাগে। গায়ের কাপড়টাও ছিঁড়েফুড়ে রয়েছে বেশ কয়েক জায়গায়। কতোদিন ধরে নেই নাওয়া খাওয়া ও যতœআত্তিটুকুও। নাকে একটা নোলক পড়ে আছে। সেও অনেককাল আগের। হাতে শাঁখা চুড়ি কিচ্ছু নেই।
: ‘আমাকে চিনতে পেরেছ সেঁজুতি?’
আচমকা প্রশ্ন শুনে থমকে দাঁড়ায় সে। নববধূর মতন শাড়ির অংশবিশেষ টেনেটুনে দ্রæত ঘোমটা দেয়। পরক্ষণে ঠিক কী মনে করে ঝুঁকে পড়ে আমার মুখের ওপর। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করে দেখে।
: ‘ওওওহহো... তুুুমি? আস্ত নিমকি শয়তান একটা? তোমাকে চিনবো না? এতোদিন পরে আবার আমার পিছন লাগছ ক্যান? নিশ্চয়ই কোন বদমতলব বুঝি, অ্যাঁ? হি হি হি।’
: ‘চিনেছ তাহলে?’
: ‘তোমার মাশাল্লাহ যে একখান চরিত্র! তোমাকে চিনবো নাগো সাহেব? তোমার মতো একটা হাঁড় নিমকি শয়তানকে অতসহজে ভুলে যাই, কী করে? হি হি হি...।’
হাসি থামে না সেঁজুতির। কথার পিঠে কথায় হাসে। পুরনো অভ্যেস। হাসিটা কিন্তু মন কাড়া ও মনোলোভা। হৃদয় তোলপাড় করা। এখনো সেই আগের মতই রয়ে গেছে। যেন স্বচ্ছ মুক্তোদানা ঝরে। আমাকে সে আজও ‘সাহেব’ বলে সম্বোধন করে। আমি ওর প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারিনি। যদিও সেঁজুতি আমাকে অক্ষমতা ও নেতিবাচক চরিত্রগুণে কখনো ‘কেঁচো’ কখনো ‘নিমকি শয়তান’ বলে ডাকে। আদতে আমি একটা কেঁচো-ই। কেঁচোর মতই গতিপ্রকৃতি ও চলাফেরা। পচা গলা ও কদমাক্ত নোংরা-আবর্জনাতে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কেঁচোদের কিছু বলার শক্তি থাকে না। মানুষ হিসেবে আমার রেটিং সর্বনিম্ন পর্যায়ের। হাত-পা, চোখ ও মাথা থাকলেই মানুষ হয়ে যায় না। বরং আমি পশুর চেয়েও অধম। নতমস্তকে আমি বাজারের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিই। পেছন থেকে আচমকা প্রশ্ন ছুঁড়ে সেঁজুতি।
: ‘কিগো কেঁচো মশাই? আজও চুপটি মেরে রইলে? কিছু বলার মতো মুরোদ নেই বুঝি? সাহসে হাঁটু কাঁপে?’
আমি চুপ করে থাকি। আসলেই মুরোদ নেই আমার। আমার শিরদাঁড়া পুরোটাই ভাঙ্গা। কেঁচোদের আবার প্রেম-ভালোবাসা। এই সত্যিটা সেঁজুুুতির চেয়ে জীবনে আর কেউ বেশি জানে না। ও জীবনে হাড়ে হাড়ে বুঝেছে। সোনার অঙ্গ পুুুড়ে তামাটে করেছে। কাপুরুষের মতো আমি লম্বা কদমে এড়িয়ে চলি। সেঁজুুতিও পেছন পেছন সমানতালে পাল্লা দেয়। একটু পরপর পাশ ফিরে তাকায়।
: ‘অ্যাই, চোরের মতো পালিয়ে যাচ্ছ কোথায়? আমাকে
বিয়ে করবে না? আমার জীবনটাকে তো খেয়ে নিঃশেষ করেছো। এখন আমাকেও খাও। কুকুরের মতো হামলে পড় আমার দেহটার ওপর। ফালি ফালি করে ছিঁড়েফুড়ে খাও। ওহ্, তুমিতো আবার চিবোতে পছন্দ কর। এই নাও এগুলো খাও। থরে থরে সাজিয়ে দিচ্ছি। টসটসে রসালো শরীর, হাড়, অস্থি-মজ্জা সবি খাও। চেটেপুটে খাও। খাবলিয়ে খাবলিয়েও খেতে পারো। দ্যাখো আমার বক্ষদেশ ও ওল্টানো কলসির মতো নিতম্বখানা এখনো কতো উন্নত। পেলব ও নরম। খেয়ে মজাই পাবে তুমি। কিন্তু খবরদার! একদম পালানোর চেষ্টা করবে না।’
সেঁজুতি কামদেবী’র মতো অর্ধনগ্ন অবস্থায় চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। শরীরের ওপরিভাগে কোনো কাপড় নেই। এক ঝটকায় বক্ষদেশ থেকে সবটুকু কাপড় ফেলে দিয়েছে। মাতাল দমকা বাতাসে পতপত করে দোল খাচ্ছে শাড়ির আঁচলখানা। মুহূর্তে কামে ফেটে পড়ি আমি। প্যান্টের নিচে শক্ত শাবলের মতো হিংস্র কিছুর অস্তিত্ব টের পাচ্ছি। আমার একমন বলছে, ‘হতচ্ছারা সুযোগটা এক্ষুণি কাজে লাগা, আশপাশে কেউ নেই। পাগলিকে নিয়ে ঝোঁপে আড়াল হ’। আবার আরেক মন বলছে, ‘অ্যাই কুত্তার বাচ্চা, নিজেকে আর কতো নিচে নামাবি? আগুনে হাত দিস না। পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাবি। কাম নিবৃত্ত কর।দৃষ্টিকেও আরো একটু সংযত কর!!’ আমি চোখ তুলে সরাসরি সেঁজুতিকে দেখি। সেঁজুতিও তখন কামে রীতিমতো চটপট করছে। তার দীর্ঘ অভুক্ত দেহে কাঁপন সৃষ্টি হয়েছে। সমুদ্রের উন্মত্ত ঝড় মুহুর্মুহু গর্জন তুলে আছড়ে পড়ছে তার নগ্ন বুকে। কোনোমতে হিংস্র পশুটাকে দমন করি আমি। রঙ পাল্টিয়ে ভেজা বেড়ালের মতো প্রশ্ন করি।
: ‘ছিঃ চুপ করো সেঁজুতি! কী সব আবোলতাবোল বকছো?’
: ‘ওহহো কেঁচো মশাইতো দেখি লজ্জাও পাচ্ছে! এখন আর ওসবে কোনো লাভ নেই। কেউ বাঁচাতে পারবে না তোমাকে। আমার অতৃপ্ত আত্মা এমনি এমনি ছেড়ে দিবে ভেবেছ?’
ক্ষোভে ফেটে পড়ে সেঁজুতি। আমি এবার ভয়ে শিউরে ওঠি। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকি। ধিক্কার দিতে থাকি নিজের জন্মদাতা পিতাকেও। যিনি শুধুমাত্র জাতের কারণে সেঁজুতিকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। যার কাছে মানুষ নয়, জাতগোত্রই আসল। যদিও এই জীবনে তাকে কোনো মানুষকে কখনো মনিষ্যি বলে গণনা করতে দেখিনি। লোকে সেঁজুতিকে পাগলী বলে গালমন্দ করে। কেউ কেউ ত্যক্ত-বিরক্ত ও খ্যাপায়ও। কিন্তু আমি বেশ ভালো করেই জানি সেঁজুতির কথাগুলো কতটা সঠিক। বরং সে সমাজের অন্য দশজনের চেয়েও দিব্যি সুস্থ ও স্বাভাবিক। তার সুন্দর জীবনটাকে দু’হাতে তছনছ করে দিয়েছি আমি। তার নিষ্পাপ ভালোবাসা ও বিশ্বাসকে গলাটিপে হত্যা করেছি। আমি হন্তারক। মস্তবড় কালপ্রিট। নিদেনপক্ষে আমার প্রকাশ্য দিবালোকে তিন-তিনবার ফাঁসি হওয়া উচিত। পলায়নপর মনোবৃত্তি আমার রক্তমাংসে ও অস্থিমজ্জাতে মিশে আছে। আজও ব্যত্যয় ঘটেনি। আমি আজও সহসা দ্রæত দিক পরিবর্তন করি। কেঁচোদের ‘মুখ আর পাছা’ বুঝার উপায় নেই। দু›টোই একই রকম। বিচ্ছিরি, নোংরা ও ঝাঁজালো গন্ধযুক্ত। বেচারি সেঁজুতিও বুঝতে পারেনি আমাকে। ওল্টো বাড়িমুখো হই আমি। কোনোক্রমে সেঁজুতিকে ফাঁকি দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে পালিয়ে চলে আসি। সেঁজুতির প্রশ্নগুলো আমাকে ফালিফালি ও রক্তাক্ত করেছে। আর কিছুক্ষণ থাকলে সেঁজুতির তপ্ত নিঃশ্বাসে পুড়ে ছাইভস্ম হয়ে যেতাম। ওকে আমি হজম করতে পারিনি। পারবও না। আগুনকে হজম করা যায় না। জীবনে ওকে একটুও শান্তি দিতে পারিনি। ওর থেকে পালিয়েও আমার খুব একটা নিস্তার নেই। ওর অতৃপ্ত আত্মার আগুনের লেলিহান শিখা প্রতিনিয়ত আমাকে পাগলা কুকুরের মতো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সবকিছুকে পুড়িয়ে ছাইভস্ম করে দিতে চায়।
অনেকটা দৌঁড়ের ওপর এসে বাসায় ঢুকি। ঘরের কপাট দরজা-জানালাগুলোও দ্রæত সপাটে বন্ধ করে দিই। দাঁড়িয়ে রয়েছি একটি বড়সড় আয়নার সম্মুখে। নিজেকে এপাশ-ওপাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি। আমি মানুষ নাকি কেঁচো- এই প্রার্থকটুকু বুঝার চেষ্টা করছি। কিন্তু একি (!) একটু পর আয়নায় আরো একটি ছায়ামূর্তি ভেসে ওঠে। সেঁজুতির ছায়ামূর্তি! ভয়ে চমকে ওঠি আমি। ও এখানে এলো কীভাবে!! আমারি ঠিক পেছনে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিছুটা গা ঘেঁষে। ঘোমটা টেনে। চোখ দু’টো দিয়ে ক্রমশ অগ্নি নির্গত হচ্ছে। প্রতিশোধের তীব্র স্পৃহা ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে। ওর অতৃপ্ত আত্মার গাঢ়তপ্ত নিঃশ্বাস আমার ঘাড়ে এসে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। আমি ক্রমাগত ঘর্মাক্ত হয়ে পড়ি। বাহিরেও মারাত্মকভাবে শোরগোল শোনা যাচ্ছে। বহু মানুষের কন্ঠে সমস্বরে কোরাস ধ্বনি। সকলের একটাই শ্লোগান একটাই দাবি- ‘ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই, কেঁচোর ফাঁসি চাই।’ আচমকা পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে সেঁজুতি।
: ‘এবার কোথায় পালাবে গো, কেঁচো মশাই?’
দমবন্ধ অবস্থা আমার। শরীরের চামড়াগুলো পুড়ে খসে খসে পড়ছে। আবার নতুন করে গজাচ্ছে। আমি চিৎকার মেরে হঠাৎ ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠি! সেকি (!) এতক্ষণ ধরে তাহলে দীর্ঘ স্বপ্ন দেখছিলাম? এসবি স্বপ্ন ছিল? স্বপ্নও এত ভয়ঙ্কর হয়? এবার বিছানা ছেড়ে আস্তে আস্তে ওঠে দাঁড়াই। ঢকঢক করে টেবিলে রাখা গøাসের সবটুকু পানি নিমিষে সাবাড় করে ফেলি। কিন্তু এতটুকুন তৃষ্ণাও নিবারণ হয়নি। হঠাৎ দেয়ালে ঝুলানো ক্যালেন্ডারের পাতার ওপর গিয়ে দৃষ্টি পড়ে। মোটা লাল কালিতে বৃত্তবন্দী করা রয়েছে আজকের তারিখটাতে। চার বছর আগে এই দিনটিতে সেঁজুতি ভালোবাসার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছিল। নারীত্বের অবমাননা ও গøানি সহ্য করতে পারেনি। এই পরিবর্তিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সেঁজুতিকে আত্মহননের পথে একটু একটু করে ঠেলে দিয়েছিল। সেঁজুতি›র আত্মমর্যাদা বোধ প্রখর। আমার মতো কেঁচো থেকেও বেশী। এই সমাজ সেঁজুতির নিষ্পাপ ভালোবাসায় কালিমা লেপণ করেছিল। কলঙ্কের দাগ সেঁটে দিয়েছিল সেঁজুতির নির্মল কোমল চরিত্রে। অথচ ঘটনার নেপথ্যে থেকে দ্বিগুণ দোষ করেও শুধুমাত্র পুরুষ পরিচয়ে বেঁচে গেছি আমি। একটা আস্ত অক্ষম অথর্ব কেঁচো হয়েও। বাহ! কী দারুণ বেঁচে থাকা!! আসলেই সত্যি বেঁচে গেছি? না, বরং আগুনের চেয়েও আরো ভয়ঙ্কর অনুতাপের অনলে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছি। কেঁচোদের অনুতাপ কথাটা কেমন জানি হাস্যকর শোনাচ্ছে। সেঁজুতির আত্মার অট্টহাসি শোনা যাচ্ছে। আরো কঠিনতর শাস্তি হওয়া উচিত আমার। ঘুম নিদ্রা ও তন্দ্রা দু’চোখের পাপড়ি থেকে কবেই ছুটি নিয়েছে। সেঁজুতির অতৃপ্ত আত্মা এসে যখন তখন হানা দিচ্ছে। পুড়িয়ে ভস্ম করে দিতে চায় সবকিছু। চিরতরে সাঙ্গ করে দিতে চায় আমার সমস্ত রকমের ছলাকলা ও শয়তানি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন