মোহাম্মদ আবু নোমান : হিজরি সালের ইতিকথা : ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালে আবু মুছা আশয়ারি (রা.) ছিলেন ইরাক ও কুফার গভর্নর। তিনি খলিফার কাছে আবেদন পাঠালেন, রাষ্ট্রীয় ফরমান এবং দিকনির্দেশনায় কোনো সাল-তারিখ উল্লেখ না থাকায় এটা কোন দিনের আদেশনামা অবগত হওয়া যায় না। ফলে তা কার্যকর করতে জটিলতায় পড়তে হয়। খলিফার দরবারে পত্র পৌঁছলে তিনি তা পড়ে অনুধাবন করলেন, আবু মুছা আশয়ারি আসলেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। ওমর (রা.) বিলম্ব না করে বিশিষ্ট সাহাবিদের নিয়ে মুসলিম জাতির সুবিধার্থে একটি ইসলামী সাল-তারিখ নির্ধারণ করার প্রয়োজনের বিষয়টি উত্থাপন করলেন। সবাই এতে সম্মতি দিলেন এবং দিন, তারিখ ও সাল নির্ধারণের ব্যাপারে নিজ নিজ অভিমত ব্যক্ত করলেন। কেউ বললেন, প্রিয় নবী (সা.) আবির্ভাবের মাস থেকে, কেউ ইন্তেকালের মাস থেকে, কারো কারো মত ছিল নবুওয়াত প্রাপ্তির মাস থেকে হিজরি সাল গণনা শুরু হোক। হজরত ওসমান ও আলি (রা.) হজরত ওমর (রা.) কথার প্রতি সমর্থন করে বললেন, আমাদের হিজরি সাল স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া জরুরি। তাই ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ মহিমান্বিত ও ঐতিহাসিক ঘটনা হিজরতের সময় থেকে এর গণনা শুরু হোক। হজরত ওমর (রা.)সহ সবার কাছে প্রস্তাবটি গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় এবং ব্যাপক সাড়া পায়।
রাসূল (সা.) নবুওত পরবর্তী ১৩ বৎসর মক্কায় ইসলামের প্রতি মানুষকে ডেকে যান। প্রাথমিকভাবে নিজ পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবকে ইসলামের পথে আহ্বান করার জন্য নির্দেশিত হন। সে মতে স্ত্রী খাদিজা, ভাতিজা আলী, সেবক জায়েদ, বন্ধু আবু বকর (রা.) এবং পরে আরো অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মুসলমানদের সংখ্যা যত বাড়তে থাকে তাদের প্রতি কাফির-মুশরিকদের নির্যাতনও বেড়ে যেতে থাকে। নবীজী (সা.) নিজেও অনেকবার নির্যাতিত হন, কিন্তু উম্মতের প্রতি তাঁর প্রবল মমতার কারণে তিনি সবকিছু সয়ে গিয়েছিলেন। তায়েফে সারা শরীর রক্তে রঞ্জিত হওয়ার পর জিব্রাইল (আ.) যখন তায়েফকে উল্টিয়ে ধ্বংস করে ফেলার অনুমতি চেয়েছিলেন, তখন নবীজী (সা.) তাঁকে বলেছিলেন, ‘ওরা তো অবুঝ। বুঝলে নিশ্চয় তারা এমনটি করত না আল্লাহ আমার জাতিকে ক্ষমা করে দিন।’ কিন্তু তাঁর সহচরবৃন্দের প্রতি অমানবিক নির্যাতন তার জন্য মহাকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে আল্লাহর অনুমতিতে প্রথমে হাবশায় এবং পরে মদিনায় সাহাবীদের হিজরত করার নির্দেশ দেন।
মহান আল্লাহর ইচ্ছায় নবীজী (সা.) তাঁর সহচরবৃন্দকে মদিনায় হিজরত করার অনুমতি দেন। এভাবেই মদিনায় হিজরতের সূচনা হয়। সাহাবায়ে কিরাম (রা.) একজন-দু’জন করে মদিনায় চলে যেতে থাকেন। এরই ভেতর আরো অনেক নির্যাতনের খবর আসতে থাকে। কাফিররা দাওয়াতকে অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং আল্লাহর এই প্রিয় বান্দাদেরকে নানাভাবে অত্যাচার ও নিপীড়ন করেছে। তাদের ইবাদতে-দাওয়াতে বাধা-বিঘœ সৃষ্টি করেছে। তাদেরকে মাতৃভূমি থেকে উৎখাত করার, এমনকি হত্যা করার চক্রান্ত করা হয়েছে। সুহায়ব (রা.)সহ অনেক সাহাবাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। কাফিররা অনেককে সমস্ত সম্পদের বিনিময়ে মক্কা ত্যাগ করার অনুমতি দেয়। এভাবে বহু সাহাবী নিজ ঘর, এলাকা, সম্পদ, আত্মীয়স্বজন ও পরিবার-পরিজনের মায়া-বন্ধন ছিন্ন করে সবকিছু ছেড়ে কেবল আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য মক্কা ত্যাগ করেন।
মদিনায় তখন কেবল নবীজী (সা.), আবু বকর ও আলী (রা.) অবশিষ্ট ছিলেন। কাফিররা যখন সবকিছু টের পেয়ে যায়, তখন রাসূল (সা.)কে মেরে ফেলার ব্যাপারে তারা নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কুরাইশদের উন্মত্ততা সীমাহীন আক্রোশে ফেঁটে পড়ল। এদিকে আল্লাহতায়ালা ওহির মাধ্যমে নবীজী (সা.) কে সব জানিয়ে দেন। নবীজী (সা.) আবু বকর (রা.)-এর ঘরে চলে যান এবং একসাথে রওয়ানা হন। রওয়ানা হওয়ার মুহূর্তে বাইতুল্লাহর দিকে করুণ দৃষ্টি ফেলে নবীজী বললেন, ‘হে মক্কা! খোদার কসম, তুমি আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় শহর, আমার মাওলার কাছেও বেশি পছন্দের শহর তুমি। যদি তোমার অধিবাসীরা আমাকে বের করে না দিতো, আমি কখনো বের হতাম না (তিরমিযী)।
রাসূলকে (সা.) জীবিত বা মৃত ধরে আনার জন্য ১০০টি উট পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। মক্কার দুর্দান্ত কাফের ঘোড়সওয়াররা বেরিয়ে পড়ে রক্তের নেশায়। রাসূল (সা.) ও আবু বকর (রা.) কাফেরদের গতিবিধি লক্ষ্য করে সাওর গুহার আশ্রয় নেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় গুহার কাছে গিয়েও না পেয়ে ফিরে আসে কাফেররা। গুহা থেকে মদিনার পথে রওয়ানা হওয়ার সময় সুরাকা বিন মালেক অনেক কাছে চলে আসে। আবু বকর (রা.) ভয় পেয়ে যান। কিন্তু নবীজী (সা.) নির্ভয়ে বলেন, ‘ভয় পেও না, আমাদের সাথে আল্লাহ আছেন’। সুরাকা কয়েকবার ঘোড়া থেকে পড়ে যায়। কাছে এসে সে নবীজীকে (সা.) ধরার পরিবর্তে তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে ফিরে যায়। পরবর্তীকালে হুনায়ন যুদ্ধের পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
আশুরার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য : অতীতের ঘটনাবহুল ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও কারবালা প্রান্তরের সংঘটিত ৬১ হিজরির হযরত ইমাম হুসাইন (রা:)কে সপরিবারে শাহাদাত লাভের ঘটনার ও তার সঙ্গী-সাথীদের মহান আত্মত্যাগ ও মর্মন্তুদ পরিণতি নিশ্চিতভাবেই আমাদের অধিকতর অভিভূত ও মøান করে তোলে।
ইতিহাসের জঘন্য, লোকহর্ষক, হৃদয় বিদারক ও নিষ্ঠুরতম ঘটনা হলো, নবী দৈহিত্র সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক ইমাম হুসাইন (রা.)-এর মর্মান্তিক শাহাদাত বরণ। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কারবালায় সপরিবারে শাহাদাতবরণ করেছিলেন মহান আল্লাহর প্রিয় হাবীব, নবী কুলের সর্দার, উভয় জগতের সুলতান নবী মুস্তফা (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র, মা ফাতিমার (রা.) কলিজার টুকরা, হযরত আলী (রা.) নয়নমনি প্রাণপ্রিয় সন্তান, অন্যায় ও অসত্যের ব্যাপারে আপোষহীন, সহজাত সত্যনিষ্ঠা ও অবিচল সততাধারী ইমাম হোসাইন (রা.)।
হযরত আলী (রা.) শাহাদতের মধ্য দিয়ে খোলাফায়ে রাশেদীন যুগের অবসান ঘটে। বিশিষ্ট সাহাবী এবং ওহী লেখক মু’আবিয়া (রা.) খলীফা হন। মু’আবিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ইয়াযিদ মসনদে আরোহণ করে। ইসলামের সূচনাকাল থেকে যে মুনাফিক ও ইয়াহুদী চক্র ইসলামের ধ্বংস সাধনে লিপ্ত ছিল সেই চক্রের প্রেতাত্মারা ভর করে ইয়াযিদের উপর। সে একে একে স্বৈরাচারী কা-কারখানা করতে থাকে। এরই প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসেন ইমাম হুসাইন (রা.)। তিনি সত্য, ন্যায়, সুন্দর এবং গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও হক, ইনসাফ চলমান রাখার লক্ষ্যে কারবালা প্রান্তরে জান কোরবান করার যে অপূর্ব দৃষ্টান্ত রেখেছেন তা যুগযুগ ধরে স্বাধীনতাকামী মানুষকে ন্যায় ও সত্য সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা জুগিয়ে থাকবে।
এই মহান আশুরা সত্যিকার অর্থে উদযাপন করতে হলে প্রয়োজন হয় না কোনো মর্সিয়া, মাতম, দুলদুল, তাজিয়া বা জানজিরার। জাতীয় কবি নজরুলের ভাষায়- ‘ফিরে এল আজ সেই মহররম মাহিনা/ ত্যাগ চাই, মর্সিয়া, ক্রন্দন চাহি না’। এই অনন্য সাধারণ দিবসকে মাহাত্ম্যশোভিত করার জন্য প্রয়োজন আছে ত্যাগ-তিতিক্ষা, সততা ও চেতনার। এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ওপর অবিচল বিশ্বাসের। অসত্যের বিরুদ্ধে আমরণ জিহাদের।
মহররম মাসে বিশ্ব ইতিহাসে এমন সব ঘটনার অবতারণা ঘটেছে যার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে অবাক বিস্ময়ে হতবাক না হয়ে পারা যায় না। এ মাসের ১৬ তারিখে বাইতুল মুকাদ্দাসকে কিবলা মনোনয়ন করা হয়েছিল। ১৭ তারিখ আবরাহার হস্তিবাহিনী মক্কার উপকণ্ঠে ছাউনি গেড়েছিল। ১০ তারিখে আশুরা বা কারবালাবার্ষিকী পালিত হয়। মুসা (আ.) এ দিনে তাওরাত কিতাব লাভ করেন এবং অভিশপ্ত ফেরাউন স্বীয় দলবলসহ সাগরবক্ষে ধ্বংস হয়। ইব্রাহীম (আ.) পাপিষ্ঠ নমরূদের অনলকু- হতে নিষ্কৃতি লাভ করেন। ইউসুফ (আ.) অন্ধকার কূপ হতে উদ্ধার পান। ঈসা (আ.)কে আল্লাহপাক চতুর্থ আসমানে উঠিয়ে নেন। আইয়ুব (আ.)-এর আরোগ্য লাভ। ইউনুছ (আ.) মাছের পেট হতে মুক্তি পান। ইদ্রিস (আ.) সশরীরে জান্নাতে প্রবেশ করেন। আবার আশুরার দিন শুক্রবারেই কেয়ামত সংঘটিত হবে। এতসব ঘটনার চিত্র যে মাসটি স্বীয় বুকে ধারণ করে আছে এর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য যে অপরিসীম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আল্লাহপাক বিশ্বজগত সৃষ্টির সূচনা করেন আশুরাতে। আদি পিতা আদম (আ.)কে সৃষ্টি এবং তাঁর স্ত্রী হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে অবতরণ ও মেহেরবান আল্লাহ তাঁদের তওবা কবুল করেন আশুরাতে। পৃথিবীতে প্রথম বৃষ্টি বর্ষিত হয় আশুরাতে। এমনি আরো অসংখ্য ঘটনার নীরব সাক্ষী আশুরা।
হজরত ইমাম হোসেনের অতুলনীয় শাহাদাত কোনো পরাজয়ের প্রতিফলন নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর জন্য পরম বিজয়ের সংকেত। মাওলানা মোহাম্মদ আলী জওহরের অনুপম ভাষায় : ‘কতলে হুসাইন আসলমে মরগে ইয়াজিদ হ্যায়/ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হর কারবালাকে বাদ’। হযরত ইমাম হোসেনের (রা.) শাহাদাত বস্তুত ইয়াজিদের মৃত্যু, প্রতিটি কারবালা দিবসের পর ইসলাম উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।
পবিত্র আশুরার আমল : হজরত মুহাম্মদ (সা.) হিজরত করে মদিনায় আগমন করার পর মদিনার ইহুদিদের নিকট হতে জানতে পারলেন যে, এই আশুরার দিন হজরত মুসা (আ.) ফিরআউনের বন্দিদশা হতে ইসরাইল সন্তানদের উদ্ধার করেছিলেন এবং ফেরাউন সসৈন্যে ডুবে মরেছিল। সেই কারণে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ হজরত মুসা (আ.) এ দিনে রোজা পালন করেছিলেন এবং একই কারণে ইহুদিরা আশুরার রোজা রাখে। তখন রাসূল (সা.) বললেন, ‘তোমাদের অপেক্ষা হজরত মুসা (আ.)-এর সাথে আমাদের সম্পর্ক অগ্রাধিকারমূলক এবং নিকটতম। রাসূল (সা.) তখন হতে নিজে আশুরার রোজা রাখলেন এবং উম্মতকে এ দিনে রোজা পালনের নির্দেশ দিলেন। যা আমাদের জন্য মুস্তাহাব হিসেবে স্বীকৃত। এ রোজা হলো ইয়াওমুল আশুরা তথা মহররমের দশ তারিখের রোজা। তবে যেহেতু ইহুদিরা দশ তারিখ রোজা রাখে, সে জন্য প্রিয়নবী (সা.) ১০ তারিখের রোজার সাথে মিলিয়ে আরো একটি অর্থাৎ ৯ ও ১০ তারিখ দু’টি রোজা রাখার জন্য বলেছেন। রাসূল (সা.) বলেছেন, রমজানের রোজার পর সর্বাপেক্ষা আফজল হচ্ছে মহররমের দশ তারিখের রোজা।
ধনঁহড়সধহ৭২@ুসধরষ.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন