শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

বেপরোয়া ছাত্রলীগ, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং রক্তাক্ত মাহমুদুর রহমান

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৫ জুলাই, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

কুষ্টিয়ায় আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশের উপস্থিতিতে মেরে রক্তাক্ত করা হল আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইয়াসির আরাফাত তুষারের করা একটি মানহানী মামলায় জামিন নিতে গিয়েছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে মাহমুদুর রহমানের দেয়া একটি বক্তব্যে মানহানী হয়েছে মর্র্মে গত বছরের শেষদিকে করা এই মামলাসহ সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে আরো ১২৫ মামলা রয়েছে বলে জানা যায়। এসব মামলায় জামিন নিতে এবং হাজিরা দিতে তাকে দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চষে বেড়াতে হচ্ছে। মামলার অভিযোগের সত্যাসত্য, বস্তুনিষ্ঠতা বা বিচারের রায় যা’ই হোক, একজন মানুষকে শত শত মামলায় হাজিরা দিতে হলে এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে হলে তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও পেশাগত জীবনের কাজ করার আর কোন সুযোগ থাকেনা। মাহমুদুর রহমানসহ বিএনপি ও ২০দলীয় জোটের শত শত নেতা-কর্মীর ক্ষেত্রে এমনটিই ঘটছে। মাহমুদুর রহমান গতানুগতিক ধারার রাজনৈতিক নেতা নন। তিনি বুয়েট থেকে পাশ করা একজন ইঞ্জিনিয়ার, সেই সাথে সফল ব্যবসায়ী এবং বিএনপি শাসনামলে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানী উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এটি প্রতিমন্ত্রীর সমান মর্যাদাসম্পন্ন একটি পদ। পরবর্তিতে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা নির্বাচিত হওয়ায় তিনি বিএনপি সমর্থক রাজনীতিক বলে গণ্য হতে পারেন। তবে গতানুগতিক রাজনৈতিক তৎপরতা ও ক্ষমতা ভোগ তার ধাঁতে নেই। তিনি তার মেধা ও কলমকে একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পক্ষে পরিচালিত করতে চাইছেন। বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইসলামের ইতিবাচক প্রভাব এবং তার মতে দাসত্বের শৃঙ্খল ভাঙ্গার লক্ষ্যে বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে একটি ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক চেতনা ও জনমত গড়ে তোলা তার কলম যুদ্ধের মূল প্রতিপাদ্য। প্রায় ৫বছর আগে আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করার প্রক্রিয়াটি ছিল বেশ নাটকীয় ও প্রলম্বিত। গ্রেফতার এড়াতে মাহমুদুর রহমান মাসাধিককাল ধরে কারওয়ান বাজারে আমারদেশ অফিসে সহকর্মী সাংবাদিকদের নিয়ে অবস্থান করছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাকে গ্রেফতার বরণ করতেই হয়েছিল। মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার এবং আদালতে নিজের আইনজীবী নিয়োগ না করে আত্মপক্ষ সমর্থন, যুক্তিউপস্থাপন এবং প্রতিপক্ষের যুক্তিখন্ডনের পাশাপাশি আদালতের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন তুলে জামিন না চাওয়ার মধ্য দিয়ে অত্যন্ত দৃঢ় মনোবল ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। মাহমুদুর রহমান ও তার সমর্থকদের দাবী অনুসারে বিনা অপরাধে তাকে গ্রেফতার ও বিচারিক হয়রানির মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। মাহমুদুর রহমান কখনো ভোটের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেননা। সরকারের বিরুদ্ধে তার সাহসী ও ক্ষুরধার কলাম, পাঠকপ্রিয়তা ও প্রচারসংখ্যায় আমারদেশ পত্রিকার বাড়বাড়ন্তই সরকারের পক্ষ থেকে তার বিপদের মূল কারণ বলে মনে করেন তাঁর সমর্থকরা। একজন সম্মানীত পেশাজীবী, সিনিয়র সিটিজেন, সাবেক জ্বালানী উপদেষ্টা এবং বহুল প্রচারিত একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক হওয়ার এই দীর্ঘ সময়ে মাহমুদুর রহমান কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, ব্যাংকে ঋণখেলাফের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন কিংবা লুটপাট-দখলবাজির মত কোন অভিযোগ শোনা যায়নি। এমনকি বিএনপি ও জোটের ভুল রাজনীতি এবং দলীয় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধেও তাঁকে কলম ধরতে দেখা গেছে। 

একজন মেধাবী পেশাজীবী ও ব্যবসায়ী হিসেবে এবং বৈবাহিক সুত্রে একটি বড় শিল্পগ্রুপের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সুবাদে মাহমুদুর রহমান যে কোন স্থানে স্বচ্ছল ও স্বচ্ছন্দ জীবন বেছে নিতে পারতেন। তিনি তা নেননি, তিনি আমৃত্যু সমাজ পরিবর্তনে কাজ করার অঙ্গিকার করেছেন বলেই প্রবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সাথে আপস করতে প্রস্তুত নন। জামিনযোগ্য আইনে মামলা হওয়ার পরও তাঁকে প্রায় চারবছর কারাগারে থাকতে হয়েছে। অভিযোগ তদন্তের নামে রিমান্ডে নিয়ে দিনের পর দিন তাঁকে নির্যাতন করা হয়েছে। এসব রিমান্ড ও নির্যাতনে তাঁর মনোবল ভেঙ্গে দেয়া সম্ভব হয়নি। তিনি কারাগারে অনশন করে নিজের প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছেন। রিমান্ডের পর আদালতে হাজিরা দিতে নিয়ে আসা মাহমুদুর রহমান হুইল চেয়ারে বসা, দুর্বল ও আশঙ্কাজনক অবস্থায়ও তার চোখে মুখে দৃঢ়তা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র ভ্রুকুটি দেখা গেছে। গত ২২ জুলাই বেলা সাড়ে এগারটায় কুষ্টিয়ার বিচারিক আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুর রহমানের জামিন দেয়ার পর তিনি বিকালেই তাকে ঢাকা ফেরার কথা ছিল। তবে মামলার বাদি ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা হয়তো মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করে হয়রানি করে স্বস্তি পাচ্ছিল না। তারা প্রথমে আদালতকে প্রভাবিত করতে আদালত প্রাঙ্গণে শত শত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর সশস্ত্র সমাবেশ গড়ে তোলে। মামলায় জামিন পাওয়ার পর তাঁকে যে প্রক্রিয়ায় আক্রমন, আঘাত ও রক্তাক্ত করা হয়েছে তা’ কোন সভ্য সমাজে তা কল্পনা করা যায়না। এটি শুধু একজন মাহমুদুর রহমানের নিরাপত্তা ও আইনগত সুরক্ষার বিষয় নয়। আদালত প্রাঙ্গণ ছাত্রলীগ কর্মীদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ার পর সংশ্লিষ্ট মেজিস্ট্রেট মাহমুদুর রহমানকে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে নিরাপদে ঢাকায় ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে স্থানীয় থানার ওসিকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলে উক্ত ওসি নিজের অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন বলে জানা যায়। মাহমুদুর রহমানের সফরসঙ্গি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব এম আব্দুল্লাহ ২২ জুলাই এগারটার পর ফেইজবুক লাইভে এসে তাদের অবরুদ্ধ ও ভীতিকর অবস্থার কথা বলেছিলেন। তিনি নিজেও ওসি এবং এসপির সাথে কথা বলেছেন বলে জানান। দেশের একজন বিশিষ্ট নাগরিক, পত্রিকার সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী একটি জেলা শহরে মামলার হাজিরা দিতে গিয়ে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের দ্বারা অবরুদ্ধ ও আক্রান্ত হওয়ার পর তারা স্থানীয় পুলিশের সহায়তা চেয়ে পাননি। এটা তাদের অক্ষমতা ছিলনা, এটা ছিল এক ধরনের ঔদ্ধত্বপূর্ণ অনিচ্ছা। এরপর আরো চার-পাঁচ ঘন্টা আদালত কক্ষে বসে থাকার পর বেশ কিছু সংখ্যক পুলিশফোর্সসহ সংশ্লিষ্ট থানার ওসি নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মাহমুদুর রহমান ও সফরসঙ্গিদের গাড়িতে তুলে দেন। গাড়ী চলতে শুরু করার পরই সশস্ত্র যুবকরা একযোগে ইট ও পাথর ছুঁড়ে গাড়ির গতিরোধ করে, অত:পর লাঠি দিয়ে দিয়ে ক্রমাগত আঘাতে গাড়ি ভেঙ্গে মাহমুদুর রহমানের মাথা, কপোলসহ শরীরের ঊর্ধাংশ থেকে রক্ত ঝরছিল তখন পুলিশ ছিল নির্বিকার, একটি বেআইনী, ন্যক্কারজনক,অমানবিক ঘটনার নিরব দর্শক। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, রক্তাক্ত মাহমুদুর রহমান এমন ঘটনার জন্য তার সামনে দাঁড়ানো ওসিকে অভিযুক্ত করছেন। তিনি বলেছেন, দেশের জন্য, ইসলামের জন্য তিনি সেখানে মরতেও প্রস্তুত। সোমবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশে সাংবাদিক ও পেশাজীবী নেতৃবৃন্দ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, পুলিশ প্রথমে সহায়তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলেও পরে নিরাপত্তার কথা বলে মাহমুদুর রহমানকে আদালতের এজলাসের নিরাপদ কক্ষ থেকে বের করে রাস্তার গুন্ডাদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। আর এ সবই নাকি করা হয়েছিল উপরের নির্দেশে। রবিবার কুষ্টিয়ার আদালত প্রাঙ্গণে মাহমুদুর রহমানকে রক্তাক্ত করার দৃশ্য তাৎক্ষনিকভাবেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড কোন নতুন বিষয় নয়। মাহমুদুর রহমানের উপর হামলার ঘটনায় সবশ্রেণীর মানুষের উদ্বিঘ হওয়ার কারণ ছাত্রলীগ নয়, আওয়ামীলীগ ও পুলিশ। এনালাইসিস বিডি নামের একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণে মাহমুদুর রহমানের উপর আওমীলীগ ও সরকারের সংশ্লিষ্টদের ক্ষুব্ধ হওয়ার পেছনে চারটি মূল কারণের কথা বলা হয়েছে। সেসব তাদের মূল্যায়ণ ও বিশ্লেষণ। আমরা তাদের সাথে একমত বা দ্বিমত কোনটাই করছিনা। তবে এনালাইসিস বিডির রিপোর্টের উপসংহারে রবিবার কুষ্টিয়ার আদালতে মাহমুদুর রহমানের উপর ছাত্রলীগের হামলার নির্দেশদাতা হিসেবে আওয়ামীলীগের একজন শীর্ষ কেন্দ্রীয় নেতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
সোমবার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মাহমুদুর রহমানের উপর হামলাকারিদের খুঁজে বের করা হবে। এটি যদি তাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত বা অবস্থান হত তাহলে এরই মধ্যে অন্তত ১০জন হামলাকারি পুলিশের হাতে ধরা পড়ত। কারণ হামলার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কুষ্টিয়াসহ সারাদেশে ভাইরাল হয়ে গেছে। দেশের লাখ লাখ মানুষ দেখেছে কারা কিভাবে মাহমুদুর রহমানের উপর হামলা করেছে। গতকাল এ নিবন্ধ লেখার শেষ পর্যন্ত এ ঘটনায় কাউকে আটক করা দূরের কথা কোন অভিযোগ বা মামলা হয়েছে বলে জানা যায়নি। মাহমুদুর রহমান একাধারে একজন সিনিয়র সাংবাদিক, দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক, এক সময় বিনিয়োগ ও জ্বালানী উপদেষ্টা হিসাবে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকরা ব্যক্তিত্ব, সকল উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও ইঞ্জিনিয়ার এবং দেশের শীর্ষ পেশাজীবী সংগঠনের ষাটোর্ধ বয়েসী নেতা। তারমত একজন ব্যক্তি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় হাজিরা দিতে কুষ্টিয়ায় গিয়ে কথিত ছাত্রলীগ কর্মীদের নির্মম আক্রমনের শিকার হওয়ার আশঙ্কায় পুলিশের সহায়তা চেয়েও পাননি। এমনকি মামলার সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট সরাসরি নির্দেশ দেয়ার পরও সহায়তা করতে স্থানীয় ওসির অপরাগরতা প্রকাশ জাতির সামনে মানুষের নিরাপত্তাহীনতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি আবারো স্পষ্ট হয়ে গেল। মাহমুদুর রহমানের মত বিশিষ্ট নাগরিকের কথা বাদ দিলেও, যে কোন সাধারণ নাগরিকও রাষ্ট্রের কাছে জীবনের নিরাপত্তা এবং আইনগত সুরক্ষা পাওয়ার দাবী তার মৌলিক অধিকারের আওতাভুক্ত। যে কোন সভ্য দেশের পুলিশ যে কোন নাগরিককে এ ধরনের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দিতে বাধ্য। আইনগত ব্যবস্থার বাইরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজি এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশ মানতে পুলিশ বাধ্য নয়, যে নির্দেশে একজন নিরপরাধ নাগরিকের জীবন বিপন্ন হতে পারে। রবিবারের কুষ্টিয়ার আদালতের ঘটনায় দেশে আইনের শাসন ও মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার অভিযোগ আবারো বিশ্বের সামনে প্রমানীত হয়ে গেল। ব্যক্তি মাহমুদুর রহমানের উপর অন্যায় আক্রমন এবং দেশের মানুষ ও বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের আদালত, পুলিশ, আইনের শাসন ও মানবাধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপরাধকে যদি আমলে নেয়া প্রয়োজন মনে করেন, এবং এই গ্লনীকর বদনাম কিছুটা হলেও ঘোচাতে চায় তাহলে মাহমুদুর রহমানের উপর আক্রমনকারিদের ধরে বিচারের আওতায় নিয়ে আসার কোন বিকল্প নাই। গত ৯ বছরে ছাত্রলীগের একশ্রেণীর নেতাকর্মীর অপকর্মের কারণে সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্জনও ম্লান হয়ে গেছে। এসব অপকর্মের হোঁতাদের অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, কেউ কেউ আদালতের মাধ্যমে সাজাও ভোগ করেছে। রাজপথে কুপিয়ে বিশ্বজিৎ হত্যা, সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ছাত্রলীগ নেতা বদরুলের চাপাতি দিয়ে কোপানোর দৃশ্য থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কোটা আন্দোলনের কর্মী ও শিক্ষকদের উপর ছাত্রলীগের অ্যাকশনদৃশ্য পর্যন্ত কিছু ঘটনার ভিডিও চিত্র গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার কারণে কিছু বেপরোয়া ছাত্রলীগ কর্মীকে আইনের আওতায় এনে কিছুটা হলেও রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছে। ছাত্রলীগের নানা অপকর্মের অতিষ্ট দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের অভিভাবকত্ব থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সত্যিকার অর্থে যদি এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হত তাহলে বার বার ছাত্রলীগ কর্মীদের এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটত না। সত্তুর বছরের পুরনো এই ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনটি এখন চরম ইমেজ সংকটের মুখে পড়েছে।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে ছাত্রলীগের অবস্থান যা’ই হোক, ছাত্রলীগের জন্ম আওয়ামিলীগের জন্মে আগে। আমরা কখনো কখনো উপমা হিসেবে বলি, ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়’। আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যে তুলনা করলে এর একটি সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। তবে ছাত্রলীগের গৌরবময় ঐতিহ্য আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক অগ্রযাত্রার পথকে অনেকটা সহজ করেছে। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের গৌরবগাঁথা আওমীলীগের চেয়ে কম নয়। বর্তমান ছাত্রলীগ নেতারা যদি পুরনো সংগ্রামী ঐতিহ্য মনে রেখে শিক্ষা ও জাতীয় ইস্যুতে নিরপেক্ষ ভ‚মিকা পালন করত, তাহলে দেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা, গণতন্ত্রের বেহালদশা ও সন্ত্রাসের জয়জয়কার হতনা। এখনকার ছাত্র রাজনীতি, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং জাতীয় রাজনীতিতে যে সন্ত্রাস দুর্বৃত্তায়ণ ঘটেছে তার মূলে রয়েছে ছাত্রলীগ নেতাদের শিক্ষা ও নৈতিকতার অবক্ষয় এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারা থেকে বিপরীতমুখী বিচ্যুতি। যে ছাত্রলীগ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলণ, ঊনসত্তুরের গণআন্দোলন এবং একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের মত জাতীয় ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবময় ভূমিকা রেখেছিল, সে ছাত্রলীগ এখন জনবিচ্ছিন্ন বিশৃঙ্খল শক্তিতে পরিনত হয়েছে। শিক্ষাঙ্গণে সুষ্ঠু সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখা ও এবং ছাত্র সমাজের শিক্ষা বিষয়ক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে ছাত্রলীগ অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার কথা। সেখানে ছাত্রলীগ এখন কোটা আন্দোলনের মত সার্বজনীন ও ন্যায্য দাবীর বিপক্ষে সারাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এ ধরনের ভিন্নমত থাকতেই পারে। কিন্তু ছাত্রলীগের অবস্থান শ্রেফ ভিন্নমত নয়, তারা ক্যাম্পাসে ও ক্যাম্পাসের বাইরে সরকারের বিরোধি যে কোন ভিন্নমতের অস্তিত্বকে অনৈতিক-অমানবিক কায়দায় দমন করতে চায়। সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের উপর এবং কুষ্টিয়ার আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিক-সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের উপর ছাত্রলীগ কর্মীদের বেপরোয়া, নির্মম ও রক্তাক্ত হামলার ঘটনা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কোটা আন্দোলন নিয়ে ছাত্রলীগের ভূমিকায় প্রধানমন্ত্রীর অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে। তিনি কোটা আন্দোলন নিয়ে ছাত্রলীগকে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। একইভাবে মাহমুদুর রহমানের উপর সন্ত্রাসী হামলায় জড়িতদের খুঁজে বের করার কথা বলেছেন আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সাংবাদিক হিসেবে, সম্পাদক বা পেশাজীবী হিসেবে একজন নাগরিক অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংস্থার নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু আদালতে জামিন পাওয়ার পর বেআইনীভাবে কোন নাগরিকের উপর বেপরোয়া হামলার ঘটনা দেশের আইনের শাসন, বিচারব্যবস্থা, পুলিশের সক্ষমতা ও পেশাদার ভূমিকা ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের অবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। আদালত প্রাঙ্গণে সন্ত্রাসী হামলার শিকার মাহমুদুর রহমানের রক্তাক্ত ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। দেশে ও বিশ্বের নানা প্রান্তে এর প্রতিবাদ বিক্ষোভ হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে আইনের শাসন, জননিরাপত্তা, পুলিশের পেশাদারিত্ব ও দলনিরপেক্ষ ভূমিকা। একজন পেশাজীবী নাগরিকের আদালত প্রাঙ্গনের মত নিরাপদ স্থানে রক্তাক্ত হওয়ার পেছনের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করে। বিষেশত: সংঘবদ্ধ উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তিদের হামলা থেকে আইনের আশ্রয় প্রার্থী একজন নাগরিককে বাঁচাতে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ এবং নিরাপত্তা প্রার্থী ব্যক্তির অনুরোধ উপেক্ষা, যথাযথ ভ‚মিকা পালনে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের ব্যর্থতা এবং হামলার সময় পুলিশের নিরব দর্শকের ভ‚মিকা সম্পর্কে সরকার ও পুলিশ বিভাগ নিরব থাকলে জাতির সামনে তা ভিন্ন বার্তা দিবে। মাহমুদুর রহমানের উপর হামলা ব্যক্তি মাহমুদুর রহমানের ওপর কিছু সংখ্যক উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তির হামলার দু:খজনক ঘটনামাত্র নয়। ঊনসত্তুরের গণআন্দোলনে শহীদ আসাদের রক্তাক্ত সার্টের মত মাহমুদুর রহমানের রক্তাক্ত সার্ট ও মুখাবয়ব জুলুম, নৈরাজ্য ও বিচারহীনতার প্রতিক হয়ে উঠতে পারে। এখনই এর সঠিক বিচার না হলে আমাদের পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই একদিন হয়তো মানুষের আদালতে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (8)
Farid Khan ২৫ জুলাই, ২০১৮, ৩:৩১ এএম says : 0
সব ধরনের হামলাই নিন্দনীয়,সেটা শিক্ষক,ইকবাল সোবহান,মাহমুদুর রহমান বা অন্য যে কেউ হোক।
Total Reply(0)
Sojib Kalam ২৫ জুলাই, ২০১৮, ৩:৩২ এএম says : 0
মাহমুদুর রহমান, আপনি সময়ের সাহসী সন্তান। ছালাম আপনাকে।
Total Reply(0)
নাসরুল্লাহ খোকন ২৫ জুলাই, ২০১৮, ৩:৩৩ এএম says : 0
অাইন শুধু বিরোধী মত দমনে বেশি ব্যাস্ত।
Total Reply(0)
Âbü Hørãírâ ২৫ জুলাই, ২০১৮, ৩:৩৩ এএম says : 0
লজ্জিত বাংলাদেশ
Total Reply(0)
Mohammad Almas ২৫ জুলাই, ২০১৮, ৩:৩৪ এএম says : 0
মানুষ কতটা নিছে নামতে পারে ছাত্রলীগ দেখে বুঝা যায়
Total Reply(0)
Md Mostafa Kamal ২৫ জুলাই, ২০১৮, ৯:৩৫ এএম says : 0
I love mahmudur rahman for his stands for truths
Total Reply(0)
ABDULLAH AL NOMAN ২৫ জুলাই, ২০১৮, ৬:৩০ পিএম says : 0
মানুষ কতটা নিছে নামতে পারে ছাত্রলীগ দেখে বুঝা যায়!!!!!
Total Reply(0)
নূরুল্লাহ ১৩ এপ্রিল, ২০২০, ৯:৫০ এএম says : 0
এসব রক্তাক্ত ক্লেদাক্ত ইতিহাস লেখা হবে একদিন হয়তো
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন