পরিবার এমন জায়গা, যা মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে মায়ার বাঁধনে। কখনও এই বাঁধন ছিঁড়ে গেলে মানুষের শেকড়টাই যেন উপডড়ে যায়। আর বার্ধক্য হলো, মানবজীবনের এক অনিবার্য বাস্তবতা। বেঁচে থাকলে প্রত্যেকেই বৃদ্ধ হয়, এটা আল্লাহর অমোঘ বিধান। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে রোগ প্রতিরোধের শক্তি। শরীরে বাসা বাঁধে নানা অসুখ-বিসুখ। এই অক্ষমতার কারণেই অবহেলার চোরাবালিতে নিক্ষিপ্ত হোন প্রবীণরা।
কখনো তাঁরা শিকার হন সন্তানের অবহেলা, অযত্ম ও দুর্ব্যবহারের। কখনো আবার তাঁরা শিকার হন অমতানবিক নির্যাতনের। শেষ পর্যন্ত কারো কারো তো ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রমে। ইউরোপ-আমেরিকার যেসব দেশে ধর্মীয় বিশ্বাস ও নৈতিকতার ভিত নড়বডড়ে হয়ে ওঠেছে, সেসব দেশেই বৃদ্ধদের অমর্যাদার করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে আজ মানুষ যেন কাজের যন্ত্র। কাজের অযোগ্য একটি যন্ত্রের যেমন কোনো মূল্যথাকে না, তেমনি জীবনের পড়ন্ত বিকেলে বৃদ্ধরা মূল্যহীন হয়ে যান। যাঁরা একসময় শ্রম-ঘামের সবটুকুই বিনিয়োগ করেছেন সভ্যতার চাকা সচল করতে, তাঁদেরই পরিত্যক্ত যন্ত্রের মতো চলে যেতে হয় বৃদ্ধনিবাসে।
বয়োবৃদ্ধদের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতি হাজার বছর ধরে লালিত হয়ে আসছে মুসলিম দেশগুলোতে। দুখের বিষয় হলো, ইদানিং এসব দেশেও পশ্চিমা হাওয়া লেগেছে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে। ব্যাপারটি সুখের নয় কিছুতেই। আজ যাঁরা বৃদ্ধ, তাঁদের ধন-সম্পদ ও সময়ের সবটুকুই বিনিয়োগ করেছেন সন্তানের পেছনে। তাই তো ইসলাম বৃদ্ধ মা-বাবার সঙ্গে সদাচরণের ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা জারি করেছে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,’তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন, তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না। এবং মা-বাবার সঙ্গে সদাচরণ কর। তাদের একজন বা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে পৌছলে, তাদেরকে উফ শব্দটি বলো না, তাদের ধমক দিও না; তাদের সম্মান দিয়ে কথা বলো। তাদের সামনে ভালোবাসার সঙ্গে নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বলো হে প্রভূ! তাদের উভয়ের প্রতি দয়া করো, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালান-পালন করেছেন।(সুরা বনি ইসরাইল: ২৩/২৪)
সন্তানের অসহায়ত্বের সময় যেভাবে মা-বাবা তাদের স্নেহভরে লালন-পালন করেছিলেন। তেমনি মা-বাবার বৃদ্ধাবস্থায় সন্তানরা তাদের সব চাহিদা পূরণ করবে। এমনটিই ইসলামের বিধান।
নবীজির কাছে এক লোক এসে প্রশ্ন করলেন, আমার কাছ থেকে সবচেয়ে ভালো আচরণ পাওয়ার অধিকার কার? নবীজি (স.) বললেন, তোমার মায়ের। লোকটি আবার প্রশ্ন করলে তিনি একই উত্তর দেন। তিন-তিনবার এমন উত্তর দেওয়ার পর লোকটি আবার একই প্রশ্ন করে। নবীজি (স.) বলেন, তোমার পিতার। (বুখারি: ২২২৭) একদা প্রিয় নবী (স.) এর কাছে এক বদ্ধ এলেন। উপবিষ্টরা তাঁকে জায়গা করে দিতে একটু দেরি করলেন। দেরি করাটা প্রিয় নবীর পছন্দ হয়নি। নবীজি (স.) সাহাবিদের কঠোর ভাষায় বললেন, ‘যে শিশুদের ভালোবাসে না এবং প্রবীণদের সম্মান করে না, সে আমার উম্মত নয়। (তিরমিজি: ১৯১৯)
মহান আল্লাহ বলেন, আমি তো মানুষকে তার মা-বাবার সঙ্গে ভালো আচরণের নির্দেশ দিয়েছি। জননী সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুবছরে। সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার মা-বাবর প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই নিকট। (সুরা লুকমান: ১৪) অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর ও কোন কিছুকে তাঁর শরিক করবে না এবং মা-বাবার, আত্মীয়-স্বজন, এতিম-মিসকিন,কাছের-দূরের প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথি, মুসাফির ও নিজের দাস-দাসীর সঙ্গে উত্তম আচরণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক-অহংকারীকে। (সুরা আন-নিসা: ৩৪)
আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি, পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যহার করতে। (আনকাবুত: ৮)
আরেক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি মানুষকে তার মাতা-পিতার সঙ্গে উত্তম ব্যবহারের আদেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে গর্ভে ধারণ করে কষ্টের সঙ্গে এবং প্রসব করে কষ্টের সঙ্গে। তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও দুধ ছড়াতে সময় লাগে ত্রিশ মাস। (সুরা আহকাফ: ১৫) ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) এরশাদ করেন, মাতা-পিতার রাজি-খুশির মধ্যেই আল্লাহর রাজি-খুশি। মাতা-পিতার অসন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর অসন্তুষ্টি। (তিরমিজি: ২/১২)
অন্য হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, সন্তানের ওপর মা-বাবার দায়িত্ব কী?
রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, তারা উভয়ে জান্নাত অথবা জাহান্নাম। (ইবনে মাজাহ: ২৬০)
আরেক হাদিসে এসেছে, একদা জনৈক সাহাবি (নবীজি স.)-এর কাছে জিহাদে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করলেন। রাসুল (স.) প্রশ্ন করলেন, তোমার মা-বাবা কেউ কী জীবিত আছেন? সাহাবি হ্যাঁ সূচক জবাব দিলেন। রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন বাডড়িতে গিয়ে তাঁদের সেবা করো।(বুখারি ২৮৪২) আবু দারদা (রা.) বলেন, আমি নবীজি (স.) কে বলতে শুনেছি, পিতা-মাতা জান্নাতের মাঝের দরজা। যদি চাও দরজাটি নষ্ট করে ফেলতে পারো নতুবা তা রক্ষাও করতে পারো। (তিরমিজি, মুসনাদে আহমদ)
যে ব্যক্তি মাতা-পিতার খেদমত করে জান্নাত ওয়াজিব করতে পারে নি, সে ধ্বংস।
একবার নবীজি (স.) বললেন, ধ্বংস হোক! ধ্বংস হোক! অত:পর ধ্বংস হোক!
জিজ্ঞাসা করা হলো, কার কথা বলছেন? তিনি বললেন, যে তার পিতা-মাতা উভয়কে অথবা কোন একজনকে বার্ধক্যে পাওয়ার পরও জান্নাতে যেতে পারেনি। সলিম) মা-বাবার দোয়া:
রাসুল (স.) বলেন তিন ব্যক্তির দোয়া, নিঃসন্দেহে কবুল হয়। তা হলো,
(ক) মজলুমের দোয়া। (খ) মুসাফিরের দোয়া। এবং (গ)সন্তানের জন্য মা-বাবার দোয়া। (তিরমিজি)
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, সন্তান মা-বাবার প্রতিদান কোনভাবেই দিতে পারে না। তবে হ্যাঁ, পিত-মাতা যদি গোলাম হন। তখন তাদের ক্রয় করে আজাদ করে দেয়। (তিরমিজি)
সহজাতভাবেই সন্তান ও নাতি-নাতনির সঙ্গে থাকাই বৃদ্ধ মা-বাবার সবচেয়ে বডড় চাওয়া। সন্তান নাতি-নাতনির সঙ্গে, সুখ-দুখ ও আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করতে চান তারা। কিন্তু আমারা কী করি? অসুস্থ হলে, ওষুধটা পর্যন্ত এনে দিই না। চাকরের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিই। বৃদ্ধ ও দুর্বল হয়ে গেলে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিই। এ ব্যাপারে ইসলাম ও হাদিস কি বলে।
একদা এক সাহাবি নবি করিম (স)কে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার মুখ দিয়ে যত কথা বের হয়, এর মধ্যে সবচেয়ে শিষ্টাচারের কথাটি আমি কার সঙ্গে বলব? আমার বাডড়ির সবচেয়ে মজাদার খাবারটি খাওয়ার অধিকার কার? আমার বাডড়ির সবচেয়ে উন্নতমানের কক্ষটিতে থাকার অধিকার কার? এর উত্তরে নবীজি স. বললেন, তোমার মায়ের, তোমার মায়ের, তোমার মায়ের। তারপর তোমার পিতার। তাই পিতা-মাতার জায়গা বিদ্ধাশ্রম নয়; বরং বাডড়ির সবচেয়ে উন্নত কক্ষটিতে থাকার কথা তাঁদের। সাধ্যের সবচেয়ে মজাদার খাবারের তাঁরাই হকদার।
মাতা-পিতা মারা যাওয়ার পরও সন্তানের ওপর তাদের হক রয়ে যায়। এ ব্যাপারে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, এক সাহাবি বললেন, হে আল্লাহর রসুল! মা-বাবার মৃত্যুর পর তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার এমন কোন উপায় আছে কি, যা আমি অনুসরণ করতে পারি? রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, হ্যাঁ! চারটে উপায় আছে। তা হলো, ১. তাদের জন্য দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করা। ২. তাদের কৃত ওয়াদা পূরণ করা। ৩. তাদের বন্ধু ও অন্তরঙ্গ ব্যক্তিদের সম্মান করা। এবং ৪. তাদের মাধ্যমে তোমাদের সঙ্গে যে আত্মীয়তার সম্পর্ক গডড়ে উঠেছে, তা অক্ষুন্ন রাখা। (আবু দাউদ:৫১৪২)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন