মোবায়েদুর রহমান
বাংলাদেশের সাথে বিশ^ব্যাংকের সম্পর্কে কোথায় যেন একটি বড় ধরনের ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। কি পদ্মা সেতু, কি অর্থনৈতিক উন্নয়ন- বাংলাদেশ যে কথাই বলছে সেই কথার সাথেই বিশ^ব্যাংকের মতদ্বৈধতা সৃষ্টি হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে দেশের শিক্ষিত সমাজ উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, শুধু বিশ^ব্যাংক নয়, আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশে^র সাথে বাংলাদেশের একটি বড় ধরনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এতদিন রাজনৈতিক ফ্রন্টে এই দূরত্ব প্রকট ছিল। এখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সেই দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। এই দূরত্বের পলিটিক্যাল আসপেক্টে আমরা যাব না। কারণ সেই দিকে গেলে আলোচনা অনেক লম্বা হয়ে যাবে এবং পাঠক ভাইদের দৃষ্টি অর্থনৈতিক ইস্যু থেকে অন্যদিকে চলে যাবে। তাই আজ অর্থনীতির মধ্যেই আলোচনাটি সীমাবদ্ধ রাখছি।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই বিষয় নিয়ে সাধারণত সাহায্য দাতা সংস্থা ও দাতা দেশ এবং আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সরকারের খুব বেশি একটা মতভিন্নতা অতীতে দেখা যায়নি। ‘ এবার সে ক্ষেত্রেও দুই রকম কথা বা তথ্য শোনা যাচ্ছে। এর আগে পদ্মা সেতু নিয়ে বাংলাদেশ এবং বিশ^ব্যাংকের মধ্যে ঘুষ খাওয়া নিয়ে মতবিরোধ রীতিমতো ঝগড়াঝাটির পর্যায়ে চলে যায়। ঝগড়াঝাটির চূড়ান্ত পর্যায়ে বিশ^ব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায়। আর বিশ্ব ব্যাংক কোনো একটি ব্যবস্থা নিলে অন্য দাতা সংস্থাগুলো তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে। তখন সরকার ঘোষণা দেয়, বাইরের অর্থ ছাড়াই নিজেদের অর্থ দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। আসলে সেভাবেই সরকার এগিয়ে যাচ্ছে। গত শনিবার বাংলাদেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে দেখলাম, পদ্মা সেতুর কাজ নাকি ৩৩ শতাংশ কমপ্লিট হয়েছে। যাই হোক, কথায় বলে, সব ভাল যার শেষ ভাল।
এবার সরকারের সাথে বিশ^ব্যাংকের মতদ্বৈধতা সৃষ্টি হয়েছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে। আসলে এই ব্যাপারে মতদ্বৈধতার কিছু নেই। অনেকগুলি তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তারপর জিডিপির হার নির্ধারণ করা হয়। চলতি অর্থবছর শেষ হতে এখনও সাড়ে ৩ মাস বাকি। বিশ^ব্যাংকের সাথে বাংলাদেশের মতভেদ সৃষ্টি হয় পনের দিন আগে। অর্থাৎ তখনও চলতি অর্থবছর শেষ হওয়ার জন্য বাকি ছিল ৪ মাস। অন্য কথায় বলা যায়, একই বছরের দুই-তৃতীয়াংশ শেষ হতে না হতেই কিভাবে বলা যায় যে, প্রবৃদ্ধি হার এত শতাংশ? আগামী ৪ মাসের পর পরিস্থিতির উন্নতিও হতে পারে, অবনতিও হতে পারে। যাই হোক, এসব বিষয় নিয়ে আমরা সরকার এবং বিশ^ব্যাংকের বিতর্ককে অবাঞ্ছিত মনে করি।
বাংলাদেশ সরকার বলেছে যে, প্রবৃদ্ধির হার বর্তমানে ৭.০৫ শতাংশ। কিন্তু বিশ^ব্যাংক বলছে, সেটা হলো ৬.৩ শতাংশ। অর্থাৎ দুই দেশের দাবির মধ্যে ফারাক হলো ০.৭৫ শতাংশ। অংকের দৃষ্টিকোণে বিবেচনা করলে এটিকে একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মনে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি জিডিপির আয়তন বিবেচনা করলে সংখ্যাটি নেহায়েত কম নয়। তারপরেও কথা থেকে যায়। চলতি অর্থবছর শেষ হতে এখনও ৪ মাস বাকি। এই ৪ মাসে অবশ্যই সঠিক চিত্র বেরিয়ে আসবে। সরকার এখন এই কথাও বলছে যে, বছর শেষে দেখা যাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারিত লক্ষ্য মাত্রাকেও ছাড়িয়ে গেছে। ৪ মাস আগে অর্থনীতি নিয়ে এই ধরনের ভবিষ্যদ্বানী কি করা যায়? অথচ বাস্তবে সেটি করা হচ্ছে।
বিশ^ব্যাংক বলছে, এবার রাজস্ব আয় তার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে পারেনি।
॥ দুই ॥
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের পরিসংখ্যান মোতাবেক বাংলাদেশ সরকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার প্রকাশ করেছে। এখন দেখা যাচ্ছে, সরকার সাফল্যের যে দাবি করছে সেটির সাথে শুধুমাত্র বিশ^ব্যাংকই দ্বিমত করছে তা নয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও অর্থনীতিবিদ এবং অন্যেরা সরকারের এই দাবির সাথে দ্বিমত পোষণ করছে। একটি দৈনিক পত্রিকায় এ সম্পর্কে পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একজন ইকোনমিস্টের লম্বা সংলাপ প্রকাশিত হয়েছে। ঐ অর্থনীতিবিদ বলেছেন, প্রবৃদ্ধির দাবি নিয়ে সরকারের পূর্বাভাস অবাস্তব। এক্ষেত্রে সত্যতার দিক থেকে বিশ্বব্যাংক এগিয়ে রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, আমদানি কমে যাওয়া ও রফতানি বৃদ্ধির ফলে চলতি হিসাব ইতিবাচক থাকবে। কিন্তু দেশের বাহ্যিক খাতে দুর্বলতা রয়ে গেছে। আমদানি মূল্য হ্রাস, করনীতি ও রাজস্ব প্রশাসনের দুর্বলতায় রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। আর রাজস্ব আহরণে ঘাটতি ও বেসরকারি খাতে ঋণ চাহিদার দুর্বলতা সামষ্টিক ব্যবস্থাপনায় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন পত্রিকান্তরে বলেন, প্রবৃদ্ধি নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিতর্ক করলে তাতে কোনো আলো আসবে না বরং তাপই ছড়াবে। আমরা কোনো ধরনের বিতর্কে যেতে চাই না। এতটুকুতে সন্তুষ্ট থাকতে চাই যে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ভালো হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির অন্যতম উপাদান ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ। গত বছর ছিল তা জিডিপির ২২ দশমিক ০৭ শতাংশ। কিন্তু এ বছর তা কমে ২১ দশমিক ৮৭ শতাংশে নেমে এসেছে। ফলে প্রবৃদ্ধি কিভাবে বাড়ল তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আর আমরা এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। বিবিএস যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তার ডাটাগুলো আমরা বিশ্লেষণ করছি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মঙ্গলবার বলেছেন, সরকার বলছে ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। এটাকে কঠিন বললে উদার বিশ্লেষণ হবে। এটি একেবারে অসম্ভব এবং অবাস্তব। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ অর্জনের কথা বলা হয়েছে। এটাও প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি আরো বলেন, আমার এই মন্তব্য করার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য মোট দেশজ উৎপাদনের ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ বিনিয়োগ দরকার। কিন্তু সরকারি হিসাবই বলছে বিনিয়োগ হচ্ছে ২৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে প্রাক্কলন দিয়েছে সেটি আমার কাছে খুব বেশি মনে হয়েছে। তিনি আরো বলেছেন, কর্মসংস্থান হয়েছে কম। বিনিয়োগ প্রত্যাশিত নয়। বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিও সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন হার খুব কম। কৃষিতেও আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছে। এসব কারণেই সরকারের পূর্বাভাস আমার কাছে মাত্রাতিরিক্ত মনে হচ্ছে।
৭ দশমিক ০৫ মাত্রার জিডিপি অর্জন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেছেন, অর্থবছরের আর বাকি মাত্র তিন মাস। জিডিপি প্রাক্কলনে যেসব ডাটা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার কোনোটি ৬ মাস, কোনটি ৭ কিংবা ৮ মাসের। এ সময়ের মধ্যে বিরাজমান অর্থনীতিতে গতবারের চেয়ে দশমিক ৫ শতাংশ বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে বলে মনে হয় না। কারণ আমাদের এডিপি কাটছাঁট করতে হয়েছে। এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কমেছে। রেমিট্যান্সেও নেতিবাচক পরিস্থিতি। কর্মসংস্থানের প্রকৃত চেহারাও ভালো মনে হচ্ছে না। জিডিপি ৭ শতাংশ ছাড়ালে এসব সূচকের ইতিবাচক প্রবণতা এখনই ধরা পড়ত।
॥ তিন ॥
বর্তমানে মাথাপিছু আয় দেখানো হচ্ছে ১৪৬৬ মার্কিন ডলার। অথচ এখনও ৪০ শতাংশ লোকের প্রতিদিন আয় এক ডলার। বছরে এদের আয় মাত্র ৪০০ মার্কিন ডলার। অফিসিয়ালি চাকরি করে থাকে মাত্র ৫ শতাংশ লোক। আর ৪০ শতাংশ মানুষ এখনও বেকার এবং ৪৭ শতাংশ মানুষ কৃষি কাজে নিয়োজিত। হিসাব মতে, এখনও দেশের প্রায় ১১ কোটি মানুষ জিডিপিতে কোনভাবেই অবদান রাখতে পারছে না। জিডিপিতে সেবা খাতের অবদান ৫০ শতাংশ। অথচ তাদের মধ্যে মাত্র ১১ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে থাকে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, দেশে এখনও বেকার মানুষের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। তার পরেই রয়েছে লেবার গোষ্ঠী। এত সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে কিভাবে দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এখন জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৬ ভাগ। অথচ এখানেই সবচেয়ে বেশি শ্রম দিয়ে থাকে মোট জনগোষ্ঠীর। তাহলে সরকার যে উন্নয়নের স্লোগান তুলে রোডশো করছে তা আসলে কতটুকু যৌক্তিক ?
দেখা যাচ্ছে, শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানির মাত্রা গত বছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে যা ছিল এবারে একই সময়ে তার তুলনায় কম। তাহলে কি শুধু রফতানি খাতের প্রবৃদ্ধির কারণেই উচ্চ প্রবৃদ্ধি? এই একটি সূচক দিয়ে সমগ্র অর্থনীতিকে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ফাঁদ থেকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। কিন্তু সরকার সেটাই দাবি করছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ২০-২১ লাখ লোকের বেতন বেড়েছে, জীবনমান বেড়েছে- তাতে ১৬ কোটি লোকের বাদ বাকিদের কী আসে যায়? কেউ এটাও বলতে পারে, পোশাক শিল্পের অবস্থা রমরমা। কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি কমিশন হয়নি, বেতনও বাড়েনি। তাই প্রবৃদ্ধির বণ্টনের দিকটি বিবেচনার বাইরে রেখে নিছক ৭ শতাংশ নিয়ে ডুগডুগি বাজানো ঠিক নয়।
সরকার বেশ কয়েকটি মেগা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। মেগা প্রজেক্টের বিশাল ব্যয় ধনবাদী অর্থনীতিতে সব সময়ই জিডিপি বৃদ্ধি করে। কিন্তু তত্ত্বগতভাবে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি দেখানো হলেও বাস্তবে সেটি হয় না। যে কৃষক ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, তাপদাহ এবং শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে কাজ করে, মধ্যপ্রাচ্যের যেসব প্রবাসী ৪৭ থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের অগ্নিবানের মধ্যে কায়িক পরিশ্রম করে, রানা প্লাজার মতো শত শত শ্রমিক মৃত্যুকে মাথার ওপর নিয়েও গার্মেন্টসের উৎপাদনশীলতা এবং রপ্তানী বাড়ায় এরা কিন্তু কেউ প্রবৃদ্ধি বাড়লে তার বেনিফিট পায় না। যারা বেনিফিট পায় তারা কিন্তু ঠা-া ঘরে বসে থাকে, না হয় কানাডা, আমেরিকা বা ইউরোপের আধুনিক শহরগুলোতে বিত্তবৈভবের বিলাসী জীবনযাপন করেন। এরাই উন্নয়ন বা প্রবৃদ্ধির ননী-মাখন সব খেয়ে নেয়। আর একটু আগে যাদের কথা বললাম তারা উন্নয়ন বা প্রবৃদ্ধির উচ্ছিষ্টও সব সময় পায় না।
ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে মন্দার ফলে ব্যাংকে বাড়ছে অলস টাকার পরিমাণ। অন্যদিকে ব্যাংক ব্যবস্থায় চলছে সর্বগ্রাসী লুটপাট ও চরম অব্যবস্থাপনা। দেশ থেকে পুঁজি পাচার হচ্ছে যার ইংগিত আমরা পাই সুইস ব্যাংক, গ্লোবাল ইন্টিগ্রিটি রিপোর্ট এবং পানামা পেপারস থেকে।
আজকের আলোচনা শেষ করব, বিএনপি নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর একটি মন্তব্য দিয়ে। তিনি বলেছেন, যে দেশে ব্যক্তি খাতের উন্নয়ন হবে না সে দেশে কোনোভাবেই ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে না। তিনি আরো বলেছেন, বাংলাদেশে একটি ফ্লাইওভার নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হচ্ছে ১০০ কোটি টাকা। অথচ ভারত ও পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশী দেশে ১০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। পদ্মা সেতুতে ১০ হাজার কোটি টাকার ব্যয় ২৮ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আপনরা বুঝে নেন, এখন টাকা কোথায় যাচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন