নুরউদ্দিন আহসান
মহান আল্লাহ তায়ালা পৃথিবী নামক গ্রহটাকে সুন্দর করে পরিচালনা ও উর্বর রাখার স্বার্থে প্রত্যেক জীবকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। আমরা বিষয়টাকে লিঙ্গান্তের ভাষায় বিবেচনা করলে বলতে পারি পুং লিঙ্গ ও স্ত্রী লিঙ্গ। আর সষ্ট্রার সর্বোত্তম সৃষ্টি হলো মানুষ, লিঙ্গান্তের ভাষায় যাকে নারী- পুরুষ নামে অবহিত করা হয়। এর মধ্যে পুরুষ জাতিকে সষ্ট্রার ইচ্ছায় নারীর তুলনায় একটু শক্তিশালী করে গঠন করা হয়েছে। এর মানে এই নয়, নারীর উপর নির্যাতনের স্টিম রোলার পরিচালনার জন্য শক্তিশালী করে গঠন করেছেন। নারী নির্যাতন শুধু যে আজ থেকে তা নয়, এর সূত্রপাত প্রাচীনকাল থেকেই। সে সময়টাতে নারীকে শুধু ভোগ্য পণ্য হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। নারী জন্ম দেয়া মাকে অশুভ, অমঙ্গলকারী বলে মনে করা হতো। আর ভূমিষ্ঠ নবজাতক নারীকে জীবিত কবর দেয়া হতো। কারণ পুরুষ নামক নর পশুদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। তা না হলে বড় হলে তারা পুরুষের ভোগ্য পণ্যে পরিণত হবে।
তবে সময়ের পরিক্রমায় পৃথিবী আজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সময়ের এই পরিবর্তন ধারায় নিষ্ঠুর পৈশাচিক অবস্থা থেকে পৃথিবী আজ মুক্ত হলেও নারীর উপর নির্যাতন যে শেষ হয়েছে তা বলার কোন অবকাশ নেই। শুধু এতটুকু পরির্তন হয়েছে, সে সময়টাতে যে রকম যে ধরনের নির্যাতন হয়েছিল হয়তবা সে রকম এখন আর নেই তবে নির্যাতন যে আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তজ্জন্য বর্তমান সময়টা আমাদের চরম সাক্ষী। শুধু পরিবর্তন হয়েছে নির্যাতনের ধরন। তবে কিছু ক্ষেত্রে এই উন্নত পৃথিবীর পুরুষদের নির্যাতনের ধরন সেই বর্বরোচিত অন্ধকার যুগকেও হার মানায়। তার মধ্যে তনু হত্যা অন্যতম উজ্জল দৃষ্টান্ত।
এখন প্রশ্ন হলো কারা এই নির্যাতনকারী? শুধু কি অক্ষর জ্ঞানহীন গ্রাম্য লোকেরাই এই জঘন্যতম কাজে লিপ্ত? নাকি শিক্ষিতের পোশাক পরিহিত বিবেক বর্জিত লোকেরাও এই কাজটি করে? উত্তরটা সহজেই অনুমেয়, এই নির্যাতনটা অশিক্ষিত গ্রাম্য লোকের চেয়ে শিক্ষিত নামধারীরাও কম নয়। জাতি ভুলে যায়নি ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা নির্যাতনের কথা এবং গত ২৬ মার্চ একজন জনপ্রতিনিধি হয়েও নারীকে নির্যাতন করতে দ্বিধাবোধ করেননি। ঐ নারীর নামে পরকীয়ার আভিযোগ এনে মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয়েছে। এ রকম হাজারও ঘটনা ঘটে যা আমাদের দৃষ্টির অগোচরে অধরাই থেকে যায়। এখন জাতির প্রশ্ন, কে তাকে এই অধিকার দিয়েছে? কোন আইনের বলে সে এমন কাজ করলো? তাহলে কি দেশে আইন বিচার ব্যবস্থা বলতে কিছুই নেই? উত্তর হলো আছে তবে তা ভঙ্গুর দন্তহীন বাঘের ন্যায়।
যে সমস্ত মানুষ নারীকে নির্যাতন করে তারা মানুষ নয় অমানুষ, মানুষ নামে পশু। বর্তমান সময়ে নারী সমাজ নিরাপত্তাহীনতার চাদরে আবৃত্ত। তাদের চলাফেরা, তাদের বেড়ে ওঠা, তাদের লেখাপড়া সকল পর্যায়ে বাধার মুখে নারী। প্রশ্ন হলো, কারা তাহলে এই সষ্ট্রার সৃষ্ট সর্বোত্তম সৃষ্টির জীবন চলার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। উত্তরটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার আর তা হলো আমরা পুরুষ জাতি। আমাদের মধ্যে থাকা কিছু হিংস্র নর পশুর থাবায় সমাজ, নারী অশান্তির দাবানলে জ্বলছে। কিছু মানুষের অনৈতিক আচরণের ফলে আজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে পুরুষ জাতির নৈতিক চরিত্র। তাদের কারণে বিবেকের কাঠগড়ায় পুরো পুরুষ জাতি। আর নির্যাতনের ধারাবাহিকতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
যদি আমরা নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যানগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলেই ওঠে আসবে এর প্রকৃত অবস্থা। ব্র্যাকের ৫৫ জেলার নারী নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবেদন অনুযায়ী বলা হয়েছে ২০১৪-২০১৫ সালে নারী নির্যাতন বেড়েছে ৭৪ শতাংশ। যা ২০১৪ সালে ছিল ২৮৭৩ আর ২০১৫ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৫০০৮ জন। আরো ভয়ংকর রকম তথ্য হলো নির্যাতনকারী ৮৭% হলো পুরুষ। ধিক্কার এ সমস্ত পুরুষদের যারা নারীকে নির্যাতন করে। আমাদের দেশে এই সমস্ত পুরুষেরা মনে করে নারীকে না মারলে পুরুষত্ব জাহির হয় না। পুলিশের ওয়েব সাইটের তথ্য অনুসারে ২০১০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের মোট মামলা হয়েছিল ১৭ হাজার ৭৫২টি গত বছর এর সংখ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ২২০টি আর চলতি বছরটাতে বলা হয়েছে তিন মাসে ১০০টি। বছর শেষে এর পরিসংখ্যান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়। আজ সমগ্র জাতিকে ভাবিয়ে তুলেছে নির্যাতনের বিভীষিকাময় অবস্থা। এর পরিসমাপ্তি কোথায়? এর কি কোন সমাধান আমাদের নেই? নাকি থাকার পরও আমরা কোন এক অদৃশ্য দেবতার আদেশে এ সব স্থগিত করে রাখি। জাতির বিবেকে এমনি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বারবার।
মামলা নিষ্পত্তির দিকে তাকালেও আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই থাকে না। তা দেখে মনে হয় আমরা এক পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ পাখি যেখানে অনেক বলার আছে বলতেও পারি কিšুÍ কিছুই করার নেই। শুধু বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে আমাদের। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও কেন আমাদের নারীদের এ পরাধীনতা। এ জন্যই কি তিরিশ লক্ষ শহীদ, দুই লক্ষ মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছে? যেখানে আমাদের দেশ পরিচালনার হাতিয়ারে সুস্পষ্ট করে লিখা আছে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০’ (সংশোধিত ২০০৩) ৯(১) ধারায় যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে তবে সে যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত হবে। একই আইনের ৯(২)তে বলা হয়েছে ধর্ষণ পরবর্তী কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিতা নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে ধর্ষকের মৃত্যুদ- বা যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত হবে একই সঙ্গে জরিমানা। ৯(৩) বলা হয়েছে, যদি দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করার পর ঐ নারী বা শিশুর মৃত্যু হয় তাহলে প্রত্যেকের যাবজ্জীবন কারাদ- বা মৃত্যু দ-, ১ লক্ষ টাকা জরিমানা।
এত শক্ত আইন থাকার পরও কেন আমরা এর যথাযথ প্রয়োগ করছি না। প্রয়োগ না করার ফলেই আজ আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বিনা বিচারে হাজারও তনু। আর ধর্ষকেরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে মাত্র। বহুল প্রচলিত একটি কথা আছে, সরিষার মধ্যেই ভূত। তাহলে ভূত ছাড়বে কী করে। যেখানে মামলা হয় ৩০৭৫টি আর সাজা হয় মাত্র দুটির, এর মতো লজ্জাস্কর বিষয় আর কি হতে পারে। জাতির প্রশ্ন কোন প্রেতাত্মাকে বাঁচানোর জন্য এই বিড়ম্বনা? আমরা আর কতকাল শুনবো এ সব ফাঁকা বুলি- তদন্ত চলছে, অপরাধী যেই হউক না কেন শাস্তি পাবেই, তদন্ত শেষ না হলে কিছুই বলা যাচ্ছে না। তদন্ত যে আমাদের শেষ হয় না তার দৃষ্টান্তও আমাদের রয়েছে। জাতি ভুলে যায়নি সাগর রুনির কথা।
ভবিষ্যতে তনু হত্যাকারীর মুখ জাতি দেখবে কিনা তা নিয়েও রয়েছে সংসয়। ইতোমধ্যে দুবার ময়না তদন্ত হয়েছে। মামলা পরিচালনা করার জন্য বারবার সংস্থা পরিবর্তন করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্তÍ এই পরিবর্তনের খাতায় আর কতজনকে নাম লিখাতে হবে তা বলাই বাহুল্য। শত পরিবর্তনের পরও যদি সেই অপরাধীকে ধরা যায় তাহলেই কেবল এই শত পরিবর্তনের ফলাফলটা স্বার্থক হবে।
ষ লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ব বিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন