রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

গণতন্ত্র ও শাসনের চারিত্র্যলক্ষণ

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২৭ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

সেদিন শুনলাম যে, রাজধানীর অন্যতম স্বনামধন্য বিদ্যাপিঠ ভিকারুন্নেসা নুন স্কুলের ছাত্রীরা পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তর না লিখে প্রতিবাদ স্বরূপ ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ লিখে উত্তর পত্র (পরীক্ষার খাতা) জমা দিয়ে জাতীয় সংগীত গেয়ে পরীক্ষার হল ত্যাগ করেছে। ঘটনাটি যাচাই করার আমার সুযোগ হয় নাই, তবে ‘নিরাপদ সড়কের’ দাবিতে আন্দোলনের সময় ছাত্র/ছাত্রীরা হাতের লেখা যেসব প্লে-কার্ড প্রদর্শন করে তার একটিতে ইংরেজিতে লেখা ছিল We Want Justice. . যা আমি বিভিন্ন চ্যানেলের সংবাদে দেখেছি। ইংরেজি তের বর্ণমালা বা তিন শব্দের এই দাবি কি নতুন, না অধিকার বঞ্চিত জনতার দীর্ঘদিনের? এই দাবি বাস্তবায়নের জন্য দেশটিকে স্বাধীন করতে হলো দু’দুবার (১৯৪৭ ও ১৯৭১)। তার পরও এই একই দাবি নিয়ে কোন না কোন সময়ে মাঠে নামতে হচ্ছে এবং শাসকদল কর্তৃক দমন-পীড়ন মাথায় নিয়েই।
‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবন’, এ প্রবাদটি আমাদের দেশের জন্য শতভাগ সত্য। যখন শাসকদলের প্রার্থীদের জয়লাভ করাতে পুলিশ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান তাদের নিজ দায়িত্ব মনে করছিল, নিজের ভোট যখন ভোটাররা নিজে দিতে পারতো না, অর্থ ও গুন্ডাদের নিয়ন্ত্রণে যখন জানগণের ভোটাধিকার ভুলণ্ঠিত, তখন আওয়ামী লীগ, জাসদ (ইনু), ওয়াকার্স পার্টি (মেনন), জামায়াতে ইসলাম, বামপন্থীসহ মোট ২২টি দল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানায় এবং পরে জাতীয় সংসদে বিল পাশের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে এই আন্দোলনকারীদের একাংশ আওয়ামী লীগসহ কতিপয় দল জোটসরকার গঠন করে সেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংবিধান থেকে উঠিয়ে দিয়েছে। এখন তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি তারা শুনতেই নারাজ। ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে এই ‘রাবন’দের মুখে এখন উল্টো সুরে বইছে। এই উল্টো সুরের সাথে সুর মিলাচ্ছেন আমাদের দেশের হাইব্রিড বুদ্ধিজীবীরা, যারা এখন বিলাসবহুল গাড়িতে চড়েন, কেউ উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকতা বা কেউ সাংবাদিকতাকে রেখেছেন সাইনবোর্ড হিসাবে, কিন্তু কাজ করছেন জনস্বার্থের পরিপন্থি, সরকারের সকল কাজের প্রশংসা ও ভিন্ন মতাবালম্বীদের নিগৃহীত করার পরও জেনে শুনে সরকারের সকল অ্যাকশনের প্রশংসার পঞ্চমুখ হচ্ছেন জনতার দাবিকে জলাঞ্জলি দিয়ে। হাইব্রিড বুদ্ধিজীবীরা কথা বলছেন এখন খুবই কৌশলে, যাতে সরকারের নিকট থেকে দালালীর পারসেন্টেজ থেকে বঞ্চিত না হন। বর্তমানে নিজেদের দালাল না বলে Middle Man হিসাবে তাদের অবস্থান তুলে ধরতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন তারা। দালালী এখন সূক্ষ্ন থেকে সূ²তর অবস্থায় হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি প্রয়োজন অনুযায়ী জ্ঞানের আলোকে বিকশিত করার জন্য নতুন নতুন বিষয়ের উপর ডিগ্রি দেয়ার জন্য নতুন নতুন বিভাগ/ফ্যাকালটি চালু করছেন।
এর উল্টো চিত্রও আছে। পেশাগত সাংবাদিক যারা নিজেদের জীবনকে বাজী রেখে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন, জেলে যাচ্ছেন, শাসক দলের পিটুনি খাচ্ছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করছেন, রিমান্ডে যাচ্ছেন এমনকি জীবন দিচ্ছেন কিন্তু তাদের কলম থেমে নেই। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র/ছাত্রীদের ছবি ও সংবাদ প্রকাশ করতে যেয়ে সরকারের পেটুয়া বাহিনী কর্তৃক আহত হয়েছেন, জেলে গিয়েছেন, রিমান্ডে গিয়েছেন তারা অনেকেই। সাংবাদিকবৃন্দ তাদের উপর হামলাকারীদের গ্রেফতার করার দাবি জানাচ্ছেন। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু হামলাকারীদের গ্রেফতার করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত গ্রেফতারের কোন সংবাদ পাওয়া যায় নাই। তথ্যমন্ত্রীর চিঠি যদি আইওয়াশ না হয়ে থাকে এবং সরকারপন্থী সাংবাদিক নেতারা যদি লোক দেখানো ভ‚মিকা না নিয়ে থাকেন তবে সাংবাদিকদের উপর হামলাকারীদের অবশ্যই গ্রেফতার করার কথা। তবে সব নির্ভর করবে সরকারের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর।
গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে দেশে এখন অগণাতান্ত্রিক শাসন চলছে। সরকার যতই চেষ্টা করুক না কেন তার কর্মকান্ডে অগণতান্ত্রিক তকমা ঘুচাতে পারছে না। একটি জাতীয় পত্রিকায় কিছু দিন আগে প্রকাশিত একটি সংবাদে দেখা যায়, সরকারের একজন সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বৈরাচারী শাসন কি তার একটি বর্ণনা দিয়েছেন। স্বৈরাচারী শাসনের চেকলিস্ট বর্ণনায় তিনি ৮টি পয়েন্ট উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো: (১) যখন সাধারণ মানুষ তার মুক্তিচিন্তা ব্যক্ত করতে ভয় পায়, (২) যখন দল, সরকার এবং রাষ্ট্র একাকার হয়ে যায় আর সরকারকে সমালোচনা করলে সেটাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে আখ্যায়িত করা হয়, (৩) যখন দেশের প্রচলিত নানা আইন এবং নতুন নতুন আইন সৃষ্টি/তৈরি করে তার অপব্যবহার করে রিমান্ডে নেয় এবং নির্যাতন করা হয়, (৪) বিনাবিচারে হত্যা ও গুম করে ফেলা হয়, (৫) রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ব্যবহার করা হয়, (৬) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থাকে পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা হয়, (৭) যখন সাধারণ নাগরিকসহ সকলের কথাবার্তা, ফোনালাপ, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট মনিটর ও রেকর্ড করা হয় এবং (৮) যখন এই সমস্ত বিষয় রিপোর্ট না করার জন্য সংবাদমাধ্যম, সাংবাদিকদের গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে হুমকি দেয়া হয়।
সাবেক এই মন্ত্রী যে চেকলিস্ট উল্লেখ করেছেন তা অত্যন্ত যুক্তি সংগত। রাষ্ট্র তার প্রতিটি নাগরিকের অভিভাবক যা রাষ্ট্রীয় অর্থে লালিত একটি প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করবে কিন্তু প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারে না, মৌলিক অধিকারকে স্তব্দ করতে পারে না। এরিস্টলের মতে, রাষ্ট্র বলতে ‘কয়েকটি পরিবার ও গ্রামের সমষ্টি, যার উদ্দেশ্য স্বয়ং সম্পূর্ণ জাতি।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের মতে, ‘মানবজাতির অংশ বিশেষকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধভাবে দেখা গেলে তাকে রাষ্ট্র বলে।’ বর্ণিত চেকলিস্টের সঙ্গে দেশের বর্তমান অবস্থা ও শাসন মিলিয়ে দেখলেই বুঝা যায় আমরা কী ধরনের পরিস্থিতি ও শাসনের মধ্যে আছি।
পত্রিকায় প্রকাশ, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদকে নোটিশ করেছে দুদক। তারেক জিয়াকে মামলা থেকে খালাস দেয়ার পর বিচারক মোতাহার হোসেনকেও দুদক খুঁজেছিল বলে পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে, যিনি বর্তমানে মালোয়শিয়াতে পলাতক জীবন যাপন করছেন বলে জানা যায়। যেহেতু সরকার খসরুর বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের উসকানিদাতা হিসাবে মামলা করেছে, সেহেতু এখন দুদক খসরুকে নোটিশ করে সরকারের আজ্ঞাবহতার পরিচয় দিচ্ছে। ফলে এটাই ধারণা করা যায় যে, সরকার সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে করায়ত্ব করে রেখেছে। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলির এখন কোন স্বাধীনতা নাই।
একই দিনে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় ‘পুলিশের চাপে ব্যানার পরিবর্তন, বাদ পড়লো তিন বারের কাউন্সিলর’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। খবরটি এই: ‘নারায়ণগঞ্জ শহরের কালীরবাজার স্বর্ণপট্টি এলাকায় প্রবীর কুমার ঘোষ ও কাপড় ব্যবসায়ী স্বপন কুমার সাহা হত্যাকান্ডের ঘটনায় দ্রুত ক্লু উদঘাটন ও আসামী গ্রেফতারে জেলা পুলিশ সুপারকে দেওয়া সংবর্ধনায় দুটি ব্যানার নিয়ে বেশ আলোচিত হচ্ছে। একটি ব্যানারে স্থানীয় সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদের নাম থাকলেও পরবর্তীতে সেই নাম বাদ দিয়ে নতুন ব্যানার সাঁটিয়ে দেওয়া হয়। আয়োজকেরা এ বিষয়টি নিয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজী না হলেও কাউন্সিলর খোরশেদ নিউজ নারায়ণগঞ্জকে বলেন, ‘আমাকে আগেই দাওয়াত করা হয়েছিল। আমি যথারীতি অনুষ্ঠানস্থলে যাওয়ার পর আয়োজকেরা ক্ষমা চেয়ে উপস্থিত না থাকার আহবান করেন। যেহেতু আমি তাদের ভোটে নির্বাচিত সেহেতু তাদের অনুরোধ রাখতে হয়েছে। তবে সকাল ১১টায় পূর্ব ঘোষিত সংবর্ধনার অনুষ্ঠানের আয়োজনে কালীরবাজারের ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন। ওই সময়ে সাঁটানো ব্যানারে পুলিশ সুপার মঈনুল হক, মফিজুল ছাড়াও সদর থানার ওসি কামরুল ইসলাম, ১৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ, জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি শংকর সাহা, সেক্রেটারি সুজন সাহার নাম ছিল। আয়োজক ও সভাপতি হিসেবে কালীরবাজার স্বর্ণ শিল্পী ইউনিয়নের সভাপতি অরূণ কুমার দত্তের নাম ছিল। তবে ১১টায় হঠাৎ করেই মঞ্চ থেকে সে ব্যানার নামিয়ে ফেলা হয়। আধাঘণ্টা পর সেখানে নতুন করে ব্যানার সাঁটিয়ে দেওয়া হয় যেখানে ছিল না খোরশেদের নাম যিনি টানা তিনবার সিটি করপোরেশনের ১৩নং ওয়ার্ডে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। এর মধ্যে বিলুপ্ত পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে টানা দুইবার তিনি নির্বাচিত হন যার মধ্যে দুইবার তিনি সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন। তিনি মহানগর যুবদলের আহবায়ক।’ এখন প্রশ্ন হলো, যে পুলিশ কর্মকর্তা তিন বারের নির্বাচিত কাউন্সিলর বিএনপি হওয়ার কারণে অনুষ্ঠান বর্জন করার হুমকি দেয়ায় কাউন্সিলারের নাম বাদ দিয়ে ব্যানার তৈরি করতে হলো সে পুলিশের পক্ষে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রর্থীর পক্ষে (যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে) নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব হবে কি? বিবেচনার ভার দেশের ১৬ কোটি মানুষের উপর।
সরকার উন্নয়নের ‘শাক’ দিয়ে গণতন্ত্র ও মানুষের মৌলিক অধিকারের ‘মাছ’ ঢাকছে। পদ্মসেতু, ডিজিটাল বাংলাদেশ, স্যাটেলাইট প্রভৃতি করে যতটুকু জনসমর্থন পাচ্ছে, মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করে গণমানুষকে এর চেয়ে বেশি প্রতিপক্ষ বানাচ্ছে। সম্প্রতি যতগুলি আন্দোলন হয়েছে তার সবই হয়েছে সরকার বনাম জনগণ। যদিও জোর গলায় সরকার বলছে যে, ডিজিটাল উন্নয়নের জোয়ারে বাংলাদেশ ভাসছে। অথচ, মানুষ কথা বলতে পারছে না, নিজের ভোট নিজে দিতে পারছে না।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন