কামরুল হাসান দর্পণ
আমরা জানি পুলিশ বাহিনীর মূল দর্শন ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের লালন’। এই মূলমন্ত্র নিয়েই পৃথিবীতে পুলিশ বাহিনী সৃষ্টি করা হয়েছে ,যার সদস্যরা কেবল জনসাধারণের কল্যাণে নিবেদিত থাকবে। তবে এই উপমহাদেশে ১৮ শতাব্দীর শেষ দিকে ব্রিটিশরা যখন পুলিশ বাহিনী সৃষ্টি করে তখন এর পরোক্ষ উদ্দেশ্য ছিল শিষ্টের দমন। চোর-ডাকাত, গু-া-বদমাশ, দুষ্কৃতকারীÑ অর্থাৎ সমাজ ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর যারা তাদের শায়েস্তা করার লক্ষ্যে এই বাহিনী গঠন করা হয়েছে বলে ব্রিটিশরা বললেও সাধারণ মানুষ কিছু দিন না যেতেই তাদের কুমতলবের বিষয়টি টের পায়। জনগণ বুঝতে পারে, দখলদার ব্রিটিশরা তাদেরকেই দুষ্কৃতকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। স্বাধীনতার কথা যাতে তারা বলতে না পারে এবং যেসব মহান নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশকে বিতাড়িত করে স্বাধীনতা অর্জনের নেতত্বে ছিলেন, তাদেরকেই দুষ্কৃতকারী আখ্যা দিয়ে দমন করার জন্য পুলিশ বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়া হয়। একটি অসামরিক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম এবং পুলিশ বাহিনী দ্বারা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করাই যে ব্রিটিশদের অন্তরালের উদ্দেশ্য ছিল, তা সে সময় মানুষদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। বলা যায়, ব্রিটিশরা উপমহাদেশকে একটি পুলিশ শাসিত অঞ্চলে পরিণত করে। জনগণের ওপর পুলিশের সে সময়ের নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা এতটাই তীব্র ছিল যে, রবীন্দ্রনাথ তাদের উদ্দেশ করে লেখেনÑ ‘উহাদের লালায় বিষ রহিয়াছে। উহারা যে ডাল কামড়াইয়া দেয়, সেই ডালে ফুলও ফুটে না পাতাও ধরে না। শুকাইয়া মরিয়া যায়।’ রবীন্দ্রনাথের এই কথা অদ্যাবদি মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি। সাধারণ মানুষ প্রতি মুহূর্তে অনুধাবন করছে, ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ছেড়ে চলে গেলেও তাদের সৃষ্ট পুলিশ বাহিনীর নিপীড়নমূলক চরিত্র বদলায়নি। পরবর্তীতে উপমহাদেশ ভেঙে টুকরো হলেও স্ব স্ব দেশের শাসকরা নিজেদের সুবিধামতো এই পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার শুরু করে। ব্রিটিশদের মতো তীব্রভাবে ব্যবহার না করলেও প্রতিপক্ষ দমনে শাসকরা ব্রিটিশদের সেই দমননীতি বহাল তবিয়তে রেখে দিয়েছে। নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য প্রতিপক্ষ দমনে ব্রিটিশরা পুলিশ নামক ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহারের যে মজা দেখিয়ে যায়, তা তারা বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করে রাখে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসনামল পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশেও শাসক দল কর্তৃক পুলিশের অপব্যবহার এতটুকুও কমেনি। বরং দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শাসক দল কর্তৃক এখন যেভাবে পুলিশের অপব্যবহার হচ্ছে, তাতে বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে স্বাধীনতাকামীদের অভিযোগ ছিল, স্বাধীনতার আন্দোলন দমন করার জন্য পুলিশ বাহিনীকে নিপীড়ক যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এখন অভিযোগ করা হচ্ছে, গণতন্ত্র উদ্ধারে বিরোধী দলের ন্যায্য গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনে ব্রিটিশদের সেই নীতিই অবলম্বন করা হচ্ছে।
দুই.
পুলিশকে ‘জনগণের বন্ধু’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আবার যারা ‘খারাপ’ এবং ‘অপরাধী’, পুলিশকে তাদের চরম শত্রু বলে গণ্য করা হয়। অর্থাৎ পুলিশকে একই সাথে দুই ধরনের চরিত্র ধারণ করতে হয়। সাধারণ মানুষের সাথে শিষ্ট ও কোমল আচরণ আর অপরাধীদের প্রতি কঠিন হয়ে উঠতে হয়। যাকে বলে ‘কঠিনে-কোমলে’ একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী। অতি সরল মনে যদি কেউ প্রশ্ন করে, দেশ পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হলে সমস্যা কোথায়? বিরোধী দলগুলো এ অভিযোগ করছে কেন? পুলিশ তো মানুষের কল্যাণেই কাজ করছে! সরল মানুষের এই সরল বিশ্বাস যদি সত্যি সত্যি পুলিশের আচার-আচরণে প্রকাশ পেত, তাহলে বোধ হয়, আমাদের দেশের মতো এত শান্তি পৃথিবীর আর কোনো দেশে দেখা যেত না। তবে সরল মানুষের এই সরল বিশ্বাসের প্রতিফলন যে পুলিশের আচরণে প্রকাশিত হচ্ছে না বা শাসক দল প্রকাশ করতে দিচ্ছে না, তা মোটামুটি সবাই জানেন। এ কারণেই ‘পুলিশি রাষ্ট্র’ কথাটি নেতিবাচক অর্থে উচ্চারিত হচ্ছে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, পুলিশি রাষ্ট্র বলতে কী বোঝায়? এর সাধারণ একটি অর্থ হচ্ছে, শাসক দল যদি তার শাসন কাজ পুলিশ বাহিনীর ওপর নির্ভর করে ইচ্ছামতো স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে পরিচালনা করে, তবে তা পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এ ধরনের রাষ্ট্রে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশে বাধা দেয়া, ভিন্ন মতাদর্শের রাজনীতি সীমিত এবং সিক্রেট পুলিশ দ্বারা বিরোধী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বিভিন্ন দেশে এর উদাহরণ রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত হিটলার জার্মানির জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে নাজি পুলিশ গঠন করেছিল, তাদের আচরণ ছিল ভয়ংকর। কেউ তার কৃতকর্ম সম্পর্কে টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করতে পারত না। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা পুলিশি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ছিল। এ সময়ের মধ্যে দেশটির জনগণ পুরোপুরি অবরুদ্ধ ছিল। সরকারের বিরুদ্ধে তাদের কথা বলা দূরে থাক, স্বাভাবিকভাবে চলাচলও করতে পারত না। তাদের অধিকার বলে কিছু ছিল না। রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করা ছিল দূরাশা মাত্র। যারাই সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলত, তাদের গণহারে গ্রেফতার করে জেলে ঢুকানো হতো। এসবই করা হয় পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করে। চিলিতে অগাস্টো পিনোচেট-এর শাসন আমল ছিল আরও কঠিন। তার শাসনামলে রাজনৈতিক আন্দোলন করার কথা কেউ চিন্তাও করতে পারত না। ঠারেঠুরে যে কথা বলবে তারও কোনো সুযোগ ছিল না। বর্তমানে তুরস্কের ক্ষমতাসীন একে পার্টির বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে, সে দেশকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। অবশ্য যারাই দেশকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে, তাদের পরিণতি খুবই করুণ হয়েছে। এর কারণ আধুনিক গণতান্ত্রিক বিশ্বে রাষ্ট্রকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করা বা গণতন্ত্রকে নামমাত্র জিইয়ে রাখার মতো ধ্যান-ধারণা কেউই পছন্দ করে না। প্রত্যেকেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা করে এবং এর প্রতিফলন সব দেশেই দেখতে চায়। আমাদের দেশে ইদানীং পুলিশি রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে বলে অহরহ অভিযোগ উঠছে। এ অভিযোগ যে শুধু দেশের অভ্যন্তরের বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সচেতন মহল থেকেই উঠছে তা নয়, বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোও তাদের কূটনৈতিক ভাষায় এবং প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে তুলে ধরছে। সম্প্রতি বিশ্ব মানবাধিকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ২০১৫ সালের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশের পুলিশ ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতন ও আইন লঙ্ঘন, খেয়ালখুশিমতো গ্রেফতার, আটক, বিচারের আগেই দীর্ঘ সময় আটকে রাখা, নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয় অধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, খুন, গুম উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্যের মারাত্মক অপরাধে জড়িয়ে পড়া এবং পুরো পুলিশ বাহিনীকে বিরোধী দল দমনে ব্যবহার করার এ ট্র্যাডিশন যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রতিবেদনে উল্লেখ না করলেও এমন কিছু যেত আসত না। কারণ দেশের মানুষ এসবই জানে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, দেশ পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হলে বা শাসক দল যদি পুলিশের ক্ষমতায় ক্ষমতাশালী হয়, তখন দেশের পরিস্থিতি কী হয়। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনের দর্শন ব্যবহার করে পুলিশকে যদি বিরোধী মত ও দল দমনে লেলিয়ে দেয়া হয়, তখন কি দেশ আর গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মধ্যে থাকে? যারা সচেতন মানুষ তারা বোঝে, একটি সরকারের জনভিত্তি যখন থাকে না, তখন তাকে পুলিশের ওপরই নির্ভর করতে হয়। কারণ এ ধরনের সরকারের ভেতর এক ধরনের ভয় কাজ করে। এই বুঝি কেউ এসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলÑ এমন শঙ্কা থেকে ভালো কাউকে দেখলেও ভয় পায়। অর্থাৎ সর্বদা ভয় ও অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে থাকলে যে কেউ দড়িকে সাপ ভেবে লাফিয়ে ওঠে। এই ভয় তাড়ানোর জন্যই তার কোনো না কোনো একটা অবলম্বন দরকার হয়, যা তার ভয় দূর করতে সাহায্য করে। রাষ্ট্রের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে পুলিশের চেয়ে বড় অস্ত্র আর নেই। তাই ভয় তাড়ানোর জন্য শাসক দল পুলিশের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবে পুলিশ শাসক দলের কথায় চলবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে জনভিত্তিহীন সরকারের ক্ষেত্রে পুলিশের কিছু লোক যখন বোঝে সরকার তাদের ওপর নির্ভরশীল, তাদের ছাড়া গতি নেই, তখন তারাও নিজেদের শাসক দলের লোকজনের মতো ক্ষমতাবান মনে করে। প্রচ্ছন্নভাবে নিজেদের সরকার ভাবতেও কুণ্ঠিত হয় না। এর লক্ষণ তার আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় ফুটে ওঠে। পুলিশের ওপর নির্ভরশীল দুর্বল সরকারও তা মেনে নেয়। এ ছাড়া তার আর কোনো উপায় নেই। কারণ তার ভিত্তি জনগণ নয়, পুলিশ বাহিনী।
তিন.
এ সময়ে তরুণ শ্রেণীর মধ্যে অন্যতম কাক্সিক্ষত চাকরি সম্ভবত পুলিশের চাকরি। ইতোমধ্যে সরকার আরও বেশ কয়েক লাখ পুলিশ সদস্য নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অচিরেই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হবে। ফলে তরুণ বেকার শ্রেণীর মধ্যে এ চাকরি পাওয়ার জন্য যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হবে, তাতে সন্দেহ নেই। আমরা দেখেছি, বছর দেড়েক আগে সাধারণ কনস্টেবল পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কী সাঙ্ঘাতিক প্রতিযোগিতা হয়েছে। এ চাকরি দেয়ার জন্য কোনো কোনো মন্ত্রী-এমপিও প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। তাদের কোটার কথাও শোনা যায়। কোনো কোনো এমপির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তারা কয়েক লাখ টাকার বিনিময়ে নাকি চাকরি দিয়েছেন। এ ছাড়া পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তার নিয়োগ বাণিজ্যের কথাও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ভাবা যায়, পুলিশের সর্বনি¤œ একটি পদে চাকরি পাওয়ার জন্য ক্ষমতার কত ওপর লেভেল পর্যন্ত যেতে হয়! আর এএসআই, এসআই বা তার উপরের পদের ক্ষেত্রে কী পরিস্থিতি হবে, তা একজন সাধারণ প্রার্থীর ক্ষেত্রে তো কল্পনাই করা যায় না। আমি দেখেছি, পুলিশ কর্মকর্তা পদে পরীক্ষা দিয়ে এক হ্যান্ডসাম মেধাবী তরুণকে হতাশ হয়ে পড়তে। পরীক্ষা ভালো দেয়া থেকে শুরু করে বাকি সব যোগ্যতায় সে উৎরে ছিল, তারপরও চাকরি হয়নি। হতাশ হয়ে তাকে বলতে শুনেছি, টাকা থাকলে চাকরিটা হয়ে যেত। পাঁচ-ছয় লাখ টাকা পাব কোথায়? উপরের লেভেলে জ্যাকও নেই যে, পাওয়ার খাটিয়ে চাকরিটি পাব। চাকরি না পাওয়ার হতাশায় তরুণ নুয়ে পড়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, জনগণের বন্ধু পুলিশ বাহিনীতে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে ‘মানি অ্যান্ড পাওয়ার’-এর বিষয়টি আসবে কেন? একজন যোগ্য প্রার্থীকে কেনইবা এ চিন্তা করতে হবে? সুশৃঙ্খল এ বাহিনীতে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে তো সবার আগে নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। একজন তরুণ কেন ও কী কারণে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিতে চায়, এ প্রশ্নের সঠিক উত্তরই তো চাকরি পাওয়ার প্রথম যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা। তারপর শারীরিক মাপকাঠিসহ অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয় আসবে। একজন প্রার্থীকে কেন আগে থেকে ভাবতে হবে পুলিশ বাহিনীতে চাকরি পেতে হলে লাখ লাখ টাকা লাগবে? শুধু টাকাই যথেষ্ট নয়, সেই সাথে শক্ত জ্যাকও লাগবে? আর পুলিশের নিয়োগ কর্তাদেরও কেন অর্থের বিনিময়ে বা উপরের লেভেলের তদবিরে চাকরি দিতে হবে, এ মনোভাব ধারণ করতে হবে? সরকারের মন্ত্রী-এমপিদেরও কেন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জড়াতে হবে? এ প্রক্রিয়ায় যদি একজন প্রার্থী পুলিশে চাকরি পায়, তবে সে কি জনগণের বন্ধু হতে পারবে? নাকি তার চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকৃত অর্থ উদ্ধার করার জন্য সাধারণ মানুষকে হয়রানি থেকে শুরু করে অনিয়ম, দুর্নীতিতে জড়িয়ে ধনপতি হওয়ায় মনোযোগী হতে হবে? তখন কি সে দুষ্টের দমন শিষ্টের লালন নীতি অবলম্বন করতে পারবে? এসব প্রশ্নের উত্তর বোধকরি সবারই জানা। যে বাহিনীর মূল লক্ষ্যই হচ্ছে নাগরিকদের সুরক্ষা দেয়া এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ, অপরাধ ও অপরাধীকে দমন করে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, সেই বাহিনীরই যদি এ দশা হয়, তবে কোনো রাষ্ট্র কি সঠিকভাবে চলতে পারে? অথচ জোর গলায় বলা হয়, পুলিশ শাসক দলের বাহিনী নয়, রাষ্ট্রের বাহিনী। সাধারণ মানুষ তো তার প্রতিফলন দেখে না। হ্যাঁ, অবশ্যই পুলিশ শাসক দলের নীতি অনুযায়ী চলবে, তার অর্থ এই নয়, তাদের ক্ষমতায় থাকার ভিত্তি বা পাহারাদার হবে। শাসক দল যদি তার কোনো অপনীতি বাস্তবায়নের কথা বলে, তবে রাষ্ট্রের বাহিনী হিসেবে পুলিশ সে নীতি বাস্তবায়নের সহায়ক হতে পারে না। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে এর ব্যতিক্রম বরাবরই দেখা গেছে, এখনো দেখা যাচ্ছে। পুলিশ বাহিনীকে কোনোকালেই রাষ্ট্রের বাহিনী হয়ে উঠতে দেয়া হয়নি। হিন্দি একটি সিনেমায় দেখেছিলাম, মন্ত্রী ও এলাকার গডফাদারের হুমকি-ধমকিতে এক জুনিয়র সৎ পুলিশ অফিসার অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তারপরও সে তাদের কাছে মাথা নত করেনি। বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে সে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে যায়। অবশেষে মন্ত্রী ও গডফাদারের ক্ষমতার প্রভাবে তাকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বদলির আদেশ দেয়া হয়। সৎ পুলিশ অফিসার তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে গিয়ে এর প্রতিবাদ করে এবং পুলিশের কী দায়িত্ব ও কর্তব্য তা তুলে ধরে। শেষ পর্যন্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বোধোদয় হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, গডফাদারকে দমন করা হবে। এক দিনের জন্য তারা পুলিশের যে দায়িত্ব তা পালন করবে। এক্ষেত্রে কোনো মন্ত্রী, এমপি বা প্রভাবশালী মহলের কথা শুনবে না। তারা সেই সৎ অফিসারের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে গডফাদারকে দমন করে। পুলিশের কাজ এটিই। পুলিশ এ কাজ তখনই করতে পারে, যখন রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বজায় থাকে। এখন পুলিশ যদি রাষ্ট্রের বাহিনী না হয়ে শাসক দলের বাহিনীতে পরিণত হয় এবং উচ্চাভিলাষী হয়ে ক্ষমতার অংশীদার মনে করে, তখনই রাষ্ট্র পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তারা দেশের সেবক না হয়ে, রাজায় পরিণত হয়। জনগণের পক্ষে সরকার ও রাষ্ট্র পুলিশি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পায়। ফলে আমাদের বিরোধী রাজনৈতিক দল যখন বলে দেশ পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, তখন সাধারণ মানুষের কাছে তা একেবারে অযৌক্তিক মনে হয় না। এই কিছু দিন আগেই তো বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, ‘মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ’। তার এ মন্তব্যের প্রতিবাদ সরকার ও পুলিশ বাহিনীর তরফ থেকে করতে দেখা যায়নি। এতে বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী দেশ যে ‘পুলিশি রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়েছে তার স্বীকৃতি মেলে।
চার.
পুলিশের মধ্যকার অনিয়ম, দুর্নীতি এবং নিপড়ীনমূলক আচরণ নিয়ে তার জন্মলগ্ন থেকেই অভিযোগ উঠছে। এই অভিযোগ ও অপবাদ থেকে পুলিশ কবে মুক্তি পাবে, তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারে না। তবে শুধু পুলিশ বাহিনীর মধ্যেই কি এসব অনিয়ম-দুর্নীতি বিদ্যমান? আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারাও কি মানসিকভাবে দুর্নীতিপ্রবণ নই? চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কি নিজেদের যোগ্যতার কথা বিবেচনা না করে কাকে ধরলে এবং কত টাকা খরচ করলে চাকরিটা পাওয়া যাবে, এ চিন্তা করি না? যাদের যোগ্যতা আছে অথচ জ্যাক ও অর্থ নেই বলে চাকরি হবে না, এমন মানসিকতা পোষণ করে না? কেন এ চিন্তা করতে হবে? বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা থাকে তারাও এ মানসিকতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। যারা কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে বা পুলিশি ঝামেলায় পড়ে যায়, তখন প্রথমেই তাদের এ চিন্তা আসে, কোন নেতাকে বা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কোন কর্মকর্তাকে ধরলে এ থেকে মুক্ত হওয়া যাবে। এ মানসিকতা কি সমর্থনযোগ্য। আবার এ ঘটনাও তো আমরা দেখি, তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলেন, কিছু মালপানি ছাড়–ন, কেসটা হালকা করে বা ঝামেলা চুকিয়ে দেইÑ এমন প্ররোচনা দিয়ে অপরাধ ও অপরাধীকে প্রশ্রয় দিতে। ফলে অপরাধীর মনে এই ধারণা জন্মায়, অপরাধ করলে পার পাওয়া যায়, আর পুলিশের কতিপয় সদস্যও চায় অপরাধী আবার অপরাধ করুক এবং তার আয়ের একটি পথ খুলুক। এভাবে আমাদের সমাজের কিছু মানুষ এবং অপরাধী অর্থ ব্যবহার করে এবং পুলিশও সেই অর্থের দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে অপরাধকে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে নিচ্ছে। যাদের অর্থ ও ক্ষমতা নেই তারাও চেষ্টায় থাকে কীভাবে এবং কার কাছে গেলে চাকরি পাওয়া থেকে শুরু করে অপরাধ করে তা থেকে বাঁচা যায়। আমাদের সমাজের এই যে দুর্নীতিপ্রবণ মানসিকতা, এটা এতটাই সংক্রমিত হচ্ছে যে, এর প্রতিকার যদি করা না যায়, তবে সুশাসন ও ন্যায্যতা কোনো দিনই দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে না। বাস্তবতা হচ্ছে, রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং এ ব্যবস্থার যারা পরিচালক তারা যদি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দুর্নীতিপ্রবণতা থেকে বের হতে না পারে, তবে দেশের মানুষের মধ্য থেকেও এ প্রবণতা দূর করা সম্ভব হবে না। অবশ্য জনগণের ভোট না নিয়ে যারা সরকার গঠন করে, তাদের পক্ষে এ মানসিকতা থেকে জনগণকে বের করে আনা সম্ভব নয়। কারণ, তারা নিজেরাই অনিয়মতান্ত্রিকতার বেড়াজালে আটকে থাকে। তাদের ক্ষমতার উৎস হয়ে পড়ে রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী। তাদের এ দুর্বলতার সুযোগে পুলিশ যদি মনে করে রাষ্ট্র তারা পরিচালনা করছে, তবে তাদের খুব বেশি দোষ দেয়া যাবে না।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন