শফিকুল ইসলাম বেবু, কুড়িগ্রাম থেকে
প্রায় পাঁচ যুগ ধরে অবৈধ দখলকারীরা গণপূর্তের ৩০২ একর জমির শতাধিক একর জবর দখল করে ভোগ করছে। এসব মূল্যবান সরকারি জমি রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জোড়ালো পদক্ষেপ না থাকায় অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে যত্রতত্র দোকানপাট, বাড়িঘর, ক্লাব সমিতি, প্রভাবশালী সংগঠনের কার্যালয়। ড্রেন, পুকুর, আবাদি জমি সবই বেআইনি দখলদারদের কবলে। দখলীস্বত্ব এমনভাবে কায়েম হয়েছে যে পাকা ভবন তৈরি করতেও দ্বিধা করেনি। কোন কোন অবৈধ দখলদার বিপুল পরিমাণ জায়গা দখল করে অবকাঠামো নির্মাণ করছে তাতে মনে হয় সরকার তাদের জন্য এ জমিগুলো হুকুম দখল করেছে। শুধু তাই নয় অবৈধ দখলদাররা তাদের জবরদখলীয় জমির পজেশন লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে হাত বদলও করেছে। পাশাপাশি সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত ও বেসরকারি সংস্থাসমূহ এই হুকুম দখলকৃত জমিতে যে অবকাঠামোসমূহ তৈরি করেছে তাতেও বিধিবদ্ধ নিয়মকানুন মানা হয়নি। যে যেখানে পেয়েছে সেখানে ইচ্ছেমত জমি দখলে নিয়ে অবকাঠামো তৈরি ও সীমানা প্রাচীর কিংবা ঘেরা দিয়েছে। ০১/১১/২০০৬ সালে সেনা সমর্থিত সরকার আসার সাথে সাথে অবৈধ দখলদাররা বিপাকে পড়ে যায়। তৎকালীন জেলা প্রশাসক এ আর মোল্লা’র নির্দেশে এবং সেনাবাহিনীর সহায়তায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। গণপূর্ত বিভাগ তাদের বেদখলকৃত জমি ফিরে পায়। ওই ফাঁকা জায়গায় মার্কেট করার প্রস্তাব গণপুর্র্ত বিভাগ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। কিন্তু এর কোন কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যায়নি। এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে অবৈধ দখলদাররা নড়েচড়ে বসে। প্রথমে কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতা অবৈধ জায়গায় ঘর তোলা শুরু করে। তাদের দেখাদেখি বাকি দখলদাররা তাদের পূর্বের জায়গা দোকানপাঠ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এই দখলদারদের তালিকায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ সাধারণ মানুষও রয়েছে। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের ব্যাপারে প্রায় মাইকিংসহ উচ্ছেদ নোটিশ পাঠানো হলেও অবৈধ দখলদাররা তা আমলে নিচ্ছে না। ১৯০০ সালের গোড়ার দিকে ধরলা নদী ক্রমেই ভাঙন প্রবণ হয়ে উঠে। এবং ব্যাপকভাবে ভাঙতে শুরু করে। এর ফলে কুড়িগ্রাম শহর ক্রমেই বিলীন হতে থাকে। একের পর এক বিলীন হয়ে যায় অফিস, আদালত, স্কুল, খেলার মাঠ, রেলওয়ে স্টেশন, বাড়িঘর। ১৯৫৪ সালে ধরলার ভাঙনে শহরের অধিকাংশ এলাকা বিলীন হয়ে যায়। এরই প্রেক্ষিতে তৎকালীন সরকার কুড়িগ্রাম শহর উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন করে গণপূর্ত বিভাগের আওতায় ১৯৫৮-১৯৫৯ অর্থ বছরে এল এ কেস নং ১/৫৮-৫৯ মারফত নাজিরা মৌজায় ৩৯.৫০ একর, হিঙ্গন রায় মৌজায় ১১৩.৫০ একর এবং কৃষ্ণপুর মৌজায় ১৪৯.৪৫ একর মোট ৩০২.৪৫ একর ভূমি হুকুম দখলের প্রক্রিয়া শুরু করে। ১৯৬১ সালের দিকে ভূমি হুকুম দখল প্রক্রিয়া শেষ হয় এবং ১৯৬২ সাল থেকে নতুন শহরে অফিস-আদালত, বাসভবন নির্মাণ শুরু হয়। এ সময় একটি মাস্টার প্লানের আওতায় ভূমি হুকুম দখল এবং অবকাঠামো নির্মাণ করা হলেও পরবর্তীতে এই মাস্টার পান অনুযায়ী আর কাজ হয়নি। মাস্টার প্লানটির অস্তিত্ব এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ৭০ দশকে নতুন শহর এলাকা ব্যস্ততম এলাকা হিসেবে গড়ে উঠার সাথে সাথে অবৈধ দখল প্রক্রিয়াও শুরু হয়। অব্যহৃত জমিতে বাড়িঘর নির্মাণ হতে থাকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দখল প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়ে প্রতিযোগিতায় রূপ নেয় এবং দখল হতে থাকে এলাকার পর এলাকা। রাস্তার দু’ধারে দখল হয় দ্রুত গতিতে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ৩০২.৪৫ একর জমির মধ্যে প্রায় ১৬০ একর দখলদারদের হাতে চলে গেছে। অভিযোগ রয়েছে স্থাপনা ছাড়া বাকি জায়গা ও পুকুরগুলোতে আবাদ ও মাছ চাষে যে আয় হচ্ছে তা বৃহৎ অংশ সরকারি কোষাগারে জমা হচ্ছে না। এগুলো কার পকেটে যাচ্ছে তার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি কলেজ মোড় এলাকার জায়গা দখল করে কয়েক লক্ষ টাকার বিনিময়ে হস্তান্তর করার অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রামে আগমন উপলক্ষে তাঁর নিরাপত্তা স্বার্থে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই দখলদাররা পুনরায় সরকারি জায়গা দখল করে নিয়েছে। গণপূর্ত বিভাগ সাইনবোর্ডে সতর্ক বাণী দিলেও দখলদাররা তা মানছে না। সচেতন মহল বলছেন, বিষয়টি নিয়ে গণপূর্ত বিভাগ, পৌরসভা এবং প্রশাসন যৌথভাবে উদ্যোগ নিলে সুশৃঙ্খলভাবে শহর গড়ে তোলার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হবে। পরিকল্পনা মাফিক মার্কেট ও দোকানপাট নির্মিত হলে দোকানদাররা তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন