মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

পূর্বমুখী নীতি বাস্তবায়নে আরো মনোযোগী হতে হবে

প্রকাশের সময় : ২৩ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুনশী আবদুল মাননান

অবশেষে ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী বহুল আলোচিত ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কে বাংলাদেশকে সংযুক্ত করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার। এ লক্ষ্যে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার হয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী উখিয়ার ঘুনধুম পর্যন্ত ১২৯ কিলোমিটাপর রেললাইন নির্মাণ করা হবে। গত মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ১৮ হাজার ৬৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রকল্পটি ২০১০ সালে গ্রহণ করা হয় যখন এর ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের এপ্রিলে এটি উদ্বোধন করেন। পরবর্তীতে এর কাজের তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। জমি অধিগ্রহণ, বিদেশি অর্থায়ন এবং নকশা পরিবর্তন ইত্যাদি সমস্যার কারণে কাজের অগ্রগতি হয়নি। এর মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। আর সবচেয়ে বড় সুখবর : এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এ প্রকল্পে অর্থায়নে সম্মত হয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা দিতে রাজি হয়েছে। অবশিষ্ট টাকা সরকারি তহবিল থেকে জোগান দেয়া হবে। ২০২২ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবে। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পরিকল্পনামন্ত্রী এ এইচ এম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, চীন থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত আসা রেল লাইনের সঙ্গে এটি রেললাইন হবে। আলোচ্য রেললাইন সংযুক্ত হবে।
এভাবে এশিয়ার এই অংশের ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের সংযোগ স্থাপিত হবে। এতে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার হয়ে চীন পর্যন্ত ট্রেনে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন সম্ভব হবে। অন্যদিকে মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর পর্যন্ত যাওয়া যাবে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের অন্য রুটের মাধ্যমে। ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের এই সংযুক্তি কৌশলগত কানেকটিভিটির দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে এই অঞ্চলে জন যাতায়াত বাড়বে, পর্যটনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হবে এবং পণ্য বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের বৈপ্লবিক অগ্রগতি সাধিত হবে। ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি দেশ। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রান্তিক দেশ। আর মিয়ানমার আসিয়ানের প্রান্তিক দেশ। একই সঙ্গে চীনের সঙ্গে রয়েছে তার সীমান্ত সংযোগ। তুরস্ক থেকে সিঙ্গাপুর এবং চীনকে রেলের মাধ্যমে যুক্ত করার যে পরিকল্পনা তাতে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা অপার, অপরিমেয়। যত দ্রুত এটা কার্যকর হবে বাংলাদেশের জন্য ততই লাভ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলপথ মন্ত্রণালয়কে দোহাজারী-কক্সবাজার ভায়া রামু ১০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের কাজ তিন বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার তাগিদ দিয়েছেন। তিনি এ প্রকল্পকে ফাস্ট-ট্র্যাক মনিটরিং প্রজেক্টের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে নির্ধারিত সময়ে এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত হয়। অনেক আগে প্রকল্পের উদ্বোধন হলেও বাস্তবে কাজ শুরু করতে এতদিন পর্যন্ত অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়েছে। বিলম্বের কারণ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এত বড় একটি প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ খুব সহজ কাজ নয়। এক্ষেত্রে জট-জটিলতার অভাব নেই। দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক সহায়তা ছাড়া এরকম বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন অসম্ভবপর। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক অর্থ সহায়তায় সম্মত হলেও কিছু শর্ত আরোপ করেছিল। প্রকল্পটি যখন অনুমোদন করা হয় তখন এই ১২৯ কিলোমিটার রেললাইন সিঙ্গেল ট্র্যাক ও মিটারগেজে নির্মাণের কথা ছিল। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক শর্ত দেয়, মিটারগেজের পরিবর্তে ডুয়েলগেজে করতে হবে। আরও একটি শর্ত দেয়, যেসব পাহাড়ি এলাকায় হাতি চলাচল করে যেসব এলাকায় আন্ডারপাস করে নির্বিঘেœ হাতি চলাচলের সুযোগ করে দিতে হবে। এ জন্য প্রকল্পের নকশায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হয়। এ জন্য অনেক সময় ব্যয় হয়ে গেছে। পাঁচ বছরের ব্যবধানে ব্যয়ও বেড়ে গেছে ১০ গুণ। এখন সব কিছু ঠিকঠাক হওয়ায় প্রকল্পের কাজ দ্রুত শুরু হবে এবং নির্ধারিত সময়ের আগেই সম্পন্ন হবে, এটাই একান্ত প্রত্যাশা।
ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে একটি বিশাল প্রকল্প, স্বপ্নের প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়নাধীন রেলপথ কার্যকর হলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে যে কানেকটিভিটি গড়ে উঠবে তাতে প্রতিটি দেশই নানাভাবে লাভবান হবে। বলে রাখা দরকার, প্রায় প্রতিটি দেশেই রেল নেটওয়ার্ক রয়েছে। এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সংযোগ স্থাপন করে দিলেই ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে কার্যকরযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। উপমহাদেশে রেললাইন বা রেলওয়ে নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে ব্রিটিশ আমলে। এক সময় বলা হতো, বিশাল ভারতকে রেলপথই সংযুক্ত করেছে। বাংলাদেশের রেলপথ সেই ব্রিটিশ ভারতীয় রেলপথেরই অংশ। পাকিস্তান থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত রেললাইন রয়েছে। এই তিন দেশের মধ্যে আন্তঃদেশীয় রেল যোগাযোগও আছে। এখন বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে মিয়ানমারের রেলওয়ের সংযোগ সাধন করা গেলেই এই গোটা অঞ্চলে সরাসরি রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। বাংলাদেশ রেলওয়ের দোহাজারী পর্যন্ত লাইন আছে। সেখান থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত লাইন স্থাপন করা গেলে একটা বড় কাজ হয়ে যায়। সেখানে থেকে ২৮ কিলোমিটার লাইন স্থাপন করলে ঘুনধুম পৌঁছানো যায় এবং এভাবেই মিয়ানমারের সঙ্গে রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেতে পারে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ব্রিটিশ আমলেই ১৮৯০ সালের দিকে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার হয়ে ঘুনধুম পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছিল। এখন পর্যন্ত সেই লাইনটি হয়নি। মিয়ানমারের সঙ্গে রেল কানেকটিভিটি বা ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় এ লাইন স্থাপিত হলে এত বছরের একটি পড়ে থাকা কাজ সম্পন্ন হবে।
গোটা বিশ্বেই এখন বহুমুখী কানেকটিভিটি গড়ে তোলায় গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। মানবিক সম্পর্ক ও বন্ধুত্বের বিস্তার, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বাণিজ্যিক লেনদেন বৃদ্ধির লক্ষ্যেই মূলত এই গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে। ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা তেমনই একটি উদ্যোগ। আরও একটি উদ্যোগ হলো প্রাচীন সিল্করুট পুনরুজ্জীবিত করা। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কুনমিং-কোলকাতা হাই স্পীড রেল নেটওয়ার্ক গড়ার আগ্রহ ব্যক্ত করেছে চীন। এ রেলপথ যাবে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ হয়ে। প্রাচীন কুনমিং-কলকাতা বাণিজ্যরুট নতুন করে চালু করার বিষয়ে একটি বেসরকারী উদ্যোগও সক্রিয় আছে। চীন ও ভারত সরকারের সমর্থনে ও উদ্যোগে কে টু কে (কুনমিং-কলকাতা) ফোরাম নামের একটি ইনিশিয়েটিভ কাজ করছে। গত বছর চীনের তরফে প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে দেয়া হয়। ওই প্রস্তাবে বলা হয়, চীন এটা চায় এবং এতে চীন ও ভারতই নয়, মিয়ানমার ও বাংলাদেশও অর্থনৈতিকভাবে প্রভূত উপকৃত হবে। এ প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক অর্থায়ন করতে সম্মত বলেও জানা গেছে। অন্য একটি সূত্র মতে, এই রেল নেটওয়ার্কটি হবে বিসিআইএম (বাংলাদেশ-চায়না-ইন্ডিয়া-মিয়ানমার) করিডোরেরই অংশ। বিসিআইএম করিডোরের ব্যাপারে চীনের আগ্রহের কথা কারো অজানা নেই। চীনের প্রেসিডেন্ট ভারত সফরের সময় এই চার দেশীয় করিডোর বাস্তবায়নে তার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এ নিয়ে চার দেশের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা ও কথাবার্তা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাচীন সিল্করুট। যার নামকরণ এখন করা হয়েছে বিসিআইএম করিডোর চালু হলে বার্ষিক অন্তত ১৩২ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হতে পারে। চীন আগেই জানিয়ে রেখেছে, এই করিডোর তৈরিতে সে অন্তত ৪৩ কোটি ডলার লগ্নি করবে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান আগে থেকে ইতিবাচক ও স্পষ্ট। বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী কানেকটিভিটি বাড়াতে চায়। ভারতের বহু আগেই সে তার পূর্বমুখী নীতি ঘোষণা করে। এই নীতি অনুযায়ী সে নিকট প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে সরাসরি রেল ও সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করতে চায় যাতে এই রেল ও সড়ক যোগাযোগের মাধ্যমে একদিকে চীন ও অন্যদিকে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক ও বাণিজ্যের বিস্তার ঘটতে পারে। এই একই নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী বাংলাদেশ ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে, এশিয়ান হাইওয়ে, বিসিআইএম করিডোর ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। এ ব্যাপারে তার সম্মতি, সমর্থন ও উদ্যোগ আছে। তবে এও স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশের সক্রিয়তা প্রত্যাশানুপাতে জোরদার নয়। সেটা ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের অংশ দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনধুম রেললাইন নির্মাণের ক্ষেত্রে যেমন লক্ষ্যণীয়, তেমনি এশিয়ান হাইওয়ের বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রেও লক্ষ্যণীয়। ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের উদ্যোগ উদ্বোধন করার পরও ৫ বছর কেটে গেছে। একইভাবে এরও অনেক আগে সড়ক নির্মাণের কাজ উদ্বোধন করার পরও কাজের কাজ কিছু হয়নি। এর মধ্যে এশিয়ান হাইওয়ের রুট নির্বাচন নিয়েও সময়ক্ষেপণ হয়েছে। দেখা গেছে, ভারতকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার নামে রুটে পরিবর্তন আনা হয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগের সবচেয়ে সহজ রুট হলো, ঢাকা-চট্টগ্রাম- টেকনাফ-সিত্তুই-ইয়াঙ্গুন। কিন্তু এর বদলে যে রুটটি পরিবর্তিত মানচিত্রে দেখানো হয়েছে সেটি হলো, ঢাকা-সিলেট-জাফলং বা জকিগঞ্জ-করিমগঞ্জ বা শিলিং। শোনা গেছে, শেষ পর্যন্ত নাকি দুটি রুটই থাকবে। দ্বিতীয় রুটটি যে ভারতকে করিডোর সুবিধা দেয়ার জন্য নির্বাচন করা হয়েছে তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। যা হোক, নির্ধারিত সময়ে যদি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সংযোগ সড়কটি নির্মাণ করা সম্ভব হতো, তাহলে অনেক আগেই মিয়ানমার ও চীনের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হতে পারতো। একইভাবে থাইল্যান্ডসহ ওই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ প্রসারণ সম্ভব হতো। বলা আবশ্যক, বাংলাদেশের সঙ্গে সরাসরি রেল ও সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে মিয়ানমার ও চীনের যেমন আগ্রহ রয়েছে, তেমনি থাইল্যান্ডের আগ্রহের কথা আমাদের অজানা নেই।
ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্ক কবে কার্যকর হবে, আমাদের জানা নেই। আমাদের জানা নেই, এশিয়ান হাইওয়ে কবে নাগাদ চালু হবে। আমরা এও জানি না, বিসিআইএম করিডোর কিংবা কে টু কে হাইস্পীড রেলওয়ে নেটওয়ার্ক বাস্তবায়নে কতদিন লাগবে। এসব দিকে না তাকিয়ে বাংলাদেশের উচিত যত দ্রুত সম্ভব মিয়ানমারের সঙ্গে রেল ও সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করা। রেল ও সড়কের প্রাথমিক কাজ হয়ে আছে। এখন প্রয়োজন এই দুটি প্রকল্প জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা। দোহাজারি-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেল লাইন স্থাপনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে গৃহীত প্রকল্পটি যাতে দ্রুত শুরু করা সম্ভব হয় তার কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে অর্থায়নে সম্মত হয়ে এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন সহজ করে দিয়েছে। সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের অর্থায়নে কোনো সংকট দেখা দেবে বলে মনে হয় না। অনেক আগেই চীন এ ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিল। এ নিয়ে নতুন করে আলোচনা হতে পারে। চীন তার দেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশের কানেকটিভিটি বাড়ানোর ব্যাপারে যে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে, প্রাচীন সিল্করুট পুনরুজ্জীবনে তার উদ্যোগ-আগ্রহ এবং তাতে বিনিয়োগ করার প্রস্তাব থেকেই তা অনুধাবন করা যায়।
এটা মেনে নেয়া কঠিন যে, বাংলাদেশ ভারতের আগে পূর্বমুখী নীতি গ্রহণ করেও কিছু করতে পারে নি। অথচ ভারত পরে শুরু করে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ডসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে দুটি প্রকল্পের ব্যাপারে ভারত বেশ আগেই কাজ শুরু করেছে। এর একটি হলো, কালাদান মাল্টি মোডাল প্রকল্প এবং অন্যটি হলো, ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিদেশীয় হাইওয়ে। কালাদান প্রকল্পের লক্ষ্য হলো, কোলকাতা থেকে মিয়ানমারের সিতওয়ে বন্দর হয়ে কালাদান নদী পথে এবং শেষে সড়ক পথে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পাঠানো। আর ত্রিদেশীয় সড়ক পরিকল্পনাটি হলো, মনিপুর থেকে মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ডের মাসত পর্যন্ত যাওয়া। বাংলাদেশের কাছ থেকে ট্রানজিটের নামে করিডোর লাভ এবং বন্দর ব্যবহারের সুযোগ লাভের পরও ভারত সম্প্রতি এদু’টি প্রকল্প বাস্তবায়নে জোরদার পদক্ষেপ নিয়েছে। সিতওয়েতে নদীবন্দর তৈরি করে দিচ্ছে ভারত। এই সঙ্গে মিয়ানমারের সঙ্গে আর্থ-বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারিত করার নানামুখী প্রচেষ্টাও সে চালিয়ে যাচ্ছে।
এর বিপরীতে আমরা দেখছি, আমাদের সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে কানেকটিটিভি ও আর্থ-বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নে অনেক পিছিয়ে আছে। সরকারের বরং অধিক ব্যস্ততা যেন ভারতকে ঘিরে। ট্রানজিট-বন্দরসহ ভারতের যা কিছু চাওয়া সব কিছুই একে একে দিয়ে দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের নীতি কার্যত ভারতমুখী হয়ে উঠেছে। অথচ ভারতকে এতকিছু দিয়ে দেয়ার পরও বাংলাদেশের প্রাপ্তির খাতায় একেবারেই শূন্য। পানি সমস্যার, যাকে বাংলাদেশের জীবন মরণের সমস্যা বলে অভিহিত করা হয়, কোনো সমাধান হয়নি। গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির কার্যকারিতা এখন নেই বললেই চলে। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হিমাগারে। এদিকে খবর পাওয়া গেছে, ভারত সারদা নদীর পানি সবরমতি নদীতে নিয়ে যাওয়ার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে গঙ্গার পানি প্রবাহ আরো কমে যাবে। অন্য এক খবরে জানা গেছে, বহুল আলোচিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজও ভারত জোরদার করছে। টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের কাজও চলছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত ও কার্যকর হলে বাংলাদেশ পানিতে শুকিয়ে মরবে। সরকারের এদিকে খোঁজ-খবর নেই। ভারতের সঙ্গে সবচেয়ে গভীর ও আন্তরিক সম্পর্কের প্রচারণায় সরকার মশগুল।
ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক এদেশের প্রতিটি মানুষই চায়। কিন্তু সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে এবং কিছু না পেয়ে সন্তুষ্টি থাকা তাদের পক্ষে কিভাবে সম্ভব হতে পারে! একমাত্র ভারতমুখী নীতিইবা তারা কিভাবে সমর্থন করতে পারে! সরকারকে বাংলাদেশের দিকে তাকাতে হবে। তার স্বার্থে চেষ্টা-নিষ্ঠা-শ্রম নিয়োজিত করতে হবে। পূর্বমুখী নীতি যা আমাদের নতুন দিগন্তের সন্ধান দিতে পারে, বাস্তবায়নে উদ্যোগী ও আন্তরিক হতে হবে। সব দেশের সঙ্গে মানবিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন