শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পবিত্র আশুরা সংখ্যা

ইসলামী জীবন ও সমাজব্যবস্থায় আশুরার তাৎপর্য

আসাদুজ্জামান আসাদ | প্রকাশের সময় : ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০৭ এএম

মহান আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির মহান কারিগর। তিনি সৃষ্টির সব কৌশল ব্যবহার করে আঠারো হাজার মাখলুখকে বিভিন্নরূপে অভিনব কৌশলে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন সম্পূর্ণ আলাদাভাবে। আশুরার দিনে এ নশ্বর পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন, আবার এই দিনেই মহা প্রলয়ের মাধ্যমে পৃথিবীকে ধ্বংস করবেন। এই দিনে অনেক নবী (আ:)-এর জন্ম হয়েছে এবং এই দিনে নবী ও রাসূল (সা:)-এর ফরিয়াদ আল্লাহ তাআলা কবুল করেছেন। মহান আল্লাহ তাআলা আশুরার দিনে আদি পিতা হযরত আদম (আ:)-এর তওবা কবুল করেছেন এবং এই দিনে হযরত নুহ (আ:)-এর কিস্তি মহা প্লাবন থেকে মুক্তি লাভ করেছে। এমনিভাবে হযরত ইউনুস (আ:) এই দিনে মাছের পেট থেকে এবং হযরত আইয়ুব (আ:) কঠিন মরণ ব্যাধি রোগ থেকে মুক্তি লাভ করেছেন। আশুরার এই দিনে হযরত ইব্রাহীম (আ:)-কে পাপিষ্ট নমরুদ জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করলেও মহান আল্লাহ ইব্রাহীম (আ:)-কে মুক্তি প্রদান করেন। হযরত মুসা (আ:) ও তার জাতি ফেরাউনের হিংসার গ্রাস থেকে নিস্তার লাভ করেন। এই দিনে আল্লাহ তাআলা হযরত ঈসা (আ:)-কে আসমানে তুলে নেয়ার ব্যবস্থা করেন। আশুরার দিনে বিশ্বনবী (সা:)-এর আদরের মেয়ে হযরত ফাতেমা (রা:)-এর ছেলে ইমাম হযরত হুসাইন (রা:)-কে কারবালার প্রান্তরে এজিদের জালিম সেনাপতি সীমার নির্মমভাবে আঘাত করেন। সেই আঘাতে হযরত হুসাইন (রা:) শাহাদাত বরণ করেন।
ইসলামী জীবন ও সমাজব্যবস্থায় আশুরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। পবিত্র কোরআনের ভাষায় বলা হয়েছে, ‘চারটি মাস সম্মানিত’। সেই চারটি মাসের মধ্যে ‘মহররম’ অন্যতম একটি মাস। যুগ যুগ ধরে ‘মহররম’ মাসের দশ তারিখ ‘আশুরার’ নামে পরিচিত। এই দিনে মোমিন বান্দারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য নানা রকম ইবাদত বন্দেগী করে থাকেন। মুত্তাকি বান্দাগণ রোজা পালন করে তাকওয়ার গুণ অর্জন করার চেষ্টা করেন। তাই প্রত্যেক মোমেন জীবনে এই দিনটির অনেক মর্যাদা, গুরুত্ব ও সম্মান। আশুরা শুধু বর্তমান যুগে নয়, বিশ্বনবী (সা:)-এর জন্মের পূর্ব থেকে শুরু করে, বর্তমান সময়কাল পর্যন্ত মুসলমানরা দিনটি পালন করে আসছে। আশুরার দিনে শুধুমাত্র মক্কার কুরাইশরা নয়, মদিনার ইহুদিরাও বিশেষভাবে এই দিনটিকে পালন করত। হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস হতে বর্ণিত তিনি বলেন, হযরত রাসূল (সা:) মদিনায় হিজরত করে দেখতে পান যে, ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা পালন করছে। তখন রাসূল (সা:) জিঞ্জাসা করেন, এই দিনে তোমাদের রোজা রাখার কারণ কি? তখন তারা বলল, এটি একটি মহান দিবস। এই দিনে আল্লাহ তাআলা হযরত মুসা (আ:)-কে এবং তার সম্প্রদায়কে কাফেরদের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। ফেরাউন এবং তার কওমকে দরিয়ায় নিমজ্জিত করেছেন। সুতরাং এর শুকরিয়া স্বরূপ হযরত মুসা (আ:) এই দিনে রোজা রাখতেন। এ জন্য আমরাও রোজা রাখি। তখন হযরত রাসূল (সা:) বললেন, হযরত মুসা (আ:)-এর সাথে তোমাদের অপেক্ষা আমাদের সম্পর্ক আরো গভীর। তারপর হযরত রাসূল (সা:) আশুরার দিন নিজেও রোজা রাখলেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন (মিশকাত)।
ইসলাম প্রচারের পূর্বে আশুরার রোজাই মুসলমানদের ওপর ওয়াজিব ছিল। দ্বিতীয় হিজরিতে মাহে রমজানের রোজা ফরজ হবার পর আশুরার রোজা সুন্নত বা নফল হিসেবে পরিণত হলো। বিশ্বনবী (সা:) এরশাদ করেন, ‘রমজান মাসের পর সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ রোজা হচ্ছে মুহাররমের রোজা’। বিশ্বনবী (সা:) আরো বলেন, ‘আমার বিশ্বাস যে, আশুরার রোজার বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা বিগত এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন’ (তিরমিজি)। অন্যত্র বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি নিজের পরিবারের মধ্যে আশুরায় খাদ্যদ্রব্যে প্রশস্ততা করবে, আল্লাহ পাক তাকে পুরো বছর সচ্ছল রাখবেন’। বিশ্বনবী (সা:) বলেন, ‘তোমরা আশুরার রোজা রাখ এবং ইহুদিদের সাদৃশ পরিত্যাগ করে আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোজা রাখ’ (মুসনাদে আহমদ ১ম খÐ)। হযরত আবু হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করিম (সা:) এরশাদ করেন, ‘যদি আমি আগামী বছর বেঁচে থাকি, তাহলে ৯ তারিখে অবশ্যই রোজা রাখব’ (মুসলিম)।
ইসলাম শান্তির ধর্ম। এই ধর্মে কোনো হিংসা-বিদ্বেষ নেই। আমরা মুসলমান জাতি শান্তির সুশীতল ছায়ায় বসবাস করি। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে মহান আল্লাহ আমাদের সময়, দিন, সপ্তাহ, মাস এবং বছর গণনায় সৌর বছর ও চন্দ্র বছর সৃষ্টির করেছেন। চন্দ্র বছরে ‘মহররম’ একটি সম্মানিত মাস। এ মাসের দশ তারিখ ‘আশুরা’ নামে পরিচিত। আশুরার দিনে পৃথিবীর ইতিহাসে নানা রকম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহের মধ্যে কিছু ঘটনা কল্যাণকর আবার কিছু ঘটনা অকল্যাণকর বটে। কিছু ঘটনা আনন্দের, কিছু ঘটনা বেদনা-বিধুর। সবকিছু মিলিয়ে মুসলিম জীবনে আশুরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
আমরা বর্তমানে আধুনিক সমাজে বসবাস করছি। বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে আধুনিক সমাজে সব কিছু হাতের মুঠোয় এসে পড়েছে। ইচ্ছা করলেই সব কিছু সহজে করা যায়। তাই সামাজিক জীবনে, অনেক ব্যক্তি বা সমাজ মহান আশুরাকে সামনে রেখে নানা রকম কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকেন। সেসব কর্মসূচি ইসলামী বিধিবিধান কখনোই সমর্থন করে না। এসব কর্মসূচিতে শুধুমাত্র বিলাসিতা ও অর্থ অপচয় করা হয়ে থাকে। আশুরাকে সামনে রেখে সাংস্কৃতিক নামে অপসংস্কৃতি, সংস্কারের নামে কুসংস্কার এবং বিভিন্ন রকম কুপ্রথা পালন করে থাকে। এসব কুপ্রথায়, কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বেশি। নানামুখী কর্মসূচির মধ্যে যেমন তাজিয়া বানানো, ঢোল তবলা বাজানো, হায় হোসাইন হায় হোসোইন বলে নিজের বুকের ওপর থাপ্পর মারা। হযরত হোসাইন (রা:)-এর শাহাদাতকে কেন্দ্র করে কান্নাকাটি করা, সাজগোজ করা, নারী-পুরুষ একসাথে একত্রিক হয়ে মিছিল করা, খিচুরী, শিন্নি এবং শরবত বিলি করা। আশুরার দিনে শোকগাথা পাঠ, শোক পালন, শোক মিছিল ও র‌্যালি বের করা, নিজের শরীরকে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি। এসব কর্মসূচি বড় ধরনের কুসংস্কার বা কুপ্রথা বটে। কুপ্রথা সম্পর্কে বিশ্বনবী (সা:) বলেন, ‘তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সর্ম্পক নেই, যারা বুক চাপড়ায়, কাপড় ছিঁড়ে এবং জাহেলী যুগের কথাবার্তা বলে’। বিশ্বনবী (সা:) আরো বলেন, ‘নিশ্চয়ই চোখ অশ্রæসজল হয়, হৃদয় ব্যথিত হয়, তবে আমরা মুখে এমন কিছু উচ্চারণ করি না, যা আমাদের রবের কাছে অপছন্দনীয়’। এসব রসম রেওয়াজের কারণে এ মাসে আর একটি খারাপ প্রবণতা মুসলমানদের মাঝে লক্ষ করা যাচ্ছে। অনেকে মহররম মাসে আশুরার দিনে শুভবিবাহ শাদী করা থেকে নিজেকে বিরত রাখে। মোট কথা, এসব অনৈসলামিক ধারণা ও কুসংস্কার থেকে দূরে থাকতে হবে।
সর্বশেষে বলতে চাই যে, প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো আশুরার দিনে গভীরভাবে মহান আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করা। কুসংস্কার ও কুপ্রথা থেকে সাজাগ থাকা। আমরা কখনোই ইসলামবিরোধী নীতিমালা অনুসরণ করব না। আমরা সর্বদা অনুসরণ করব কোরআন, হাদিস ও বিশ্বনবী (সা:)-এর কর্ম ও নীতিমালা। আমরা বিশ্বনবী (সা:)-এর নীতিমালার শিক্ষায় অটল থাকব। সেই শিক্ষার আলোকে জীবনযাপন করব। সেই শিক্ষা প্রত্যেক মুসলমানের জীবনে বাস্তবায়ন হোক। এই হোক আজকের একান্ত কামনা। আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন