দেশে দিন দিন শিক্ষার হার বাড়ছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে বেকারত্ব। চাকরির পিছনে হন্যে হয়ে ছুটে চলেছে উচ্চ শিক্ষিত বেকাররা। বেকারের তুলনায় আনুপাতিক হারে নেই চাকরির বিজ্ঞপ্তি, নেই পর্যাপ্ত পদসংখ্যা। তার সাথে মূল প্রতিবন্ধক হিসেবে যুক্ত হয়েছে চাকরিতে প্রবেশে বয়সের দেয়াল। সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করেছে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে দক্ষ মানবসম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে পুরোপুরি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিণত হতে হলে এবং এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে চাকরিতে প্রবেশে বয়সের সীমাবদ্ধ প্রাচীর কতটুকু গ্রহণযোগ্য? লাখ লাখ শিক্ষার্থী পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের পড়াশোনা শেষ করেছে ২৭ বা ২৮ বছরে। সেশন জট, রাজনৈতিক সমস্যা ইত্যাদি কারণে তারা যথাসময়ে পড়াশোনা শেষ করতে না পেরে ৬/৭ বছর পরে করতে পেরেছে। এর সাথে অনার্স ও ডিগ্রি উভয় কোর্সে বাড়তি এক বছর করে যুক্ত করা হয়েছে। নব্বই দশকের আগে চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ছিল ২৭ বছর আর অবসরের বয়সসীমা ছিল ৫৭ বছর। তারপর গড় আয়ু আর কর্মক্ষমতার বিচার করে ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে শুধু বয়সসীমা বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়। তবে সর্বশেষ বিগত ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে শুধুমাত্র অবসরের বয়স ৫৭ থেকে বাড়িয়ে সাধারণদের জন্য ৫৯ বছর আর মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ৬০ বছর করা হয়। তবে এই অবসরের বয়স দৃশ্যমান কোন দাবি-দাওয়া বা আন্দোলন ছাড়াই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সরকার বাড়িয়েছে। একতরফাভাবে শুধু অবসরের বয়স বাড়ানোর কারণে স্বাভাবিকভাবেই শূন্যপদের সংখ্যা কমে যায়। এরপরই চাকরির আবেদনে বয়স বাড়ানোর দাবি তোলে সারাদেশের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী ও চাকরিপ্রার্থীরা। তারা ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি জেলার প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন, প্রতীকী ফাঁসি, অনশন, সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের স্মারকলিপিও দিয়েছে। সংসদেও বিষয়টি উঠেছে বহুবার। এর সাথে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ২০১২ সালে তার ২১তম বৈঠকে সুপারিশ করেছিল ৩২ বছরের। ২০১৬ সালে ডিসি সম্মেলনে সকল জেলার ডিসিরা ৩৩ বছরের সুপারিশ করেন। ৬ বছর পরে চলতি বছরের ২৭ জুন সংসদীয় স্থায়ী কমিটি দ্বিতীয়বারের মত তার ২৯তম বৈঠকে ৩৫ বছর করার সুপারিশ করে। যথাসময়ে বাস্তবায়নের উদ্যোগ না নেয়ায় চলতি মাসের ১০ সেপ্টেম্বর সর্বশেষ আবারও সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ৩৫ বছর করার জোর সুপারিশ করে এবং দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে মন্ত্রণালয়কে বলে। তারপরও আজ পর্যন্ত বেকার তরুণদের ভাগ্য খোলেনি!
এই বয়সে তরুণদের সংসার করার কথা, বৃদ্ধ পিতা-মাতার দেখভাল করার কথা। অথচ তারা নিজেরাই নিজের খরচ চালাতে পারে না। এখনও তারা পিতা-মাতানির্ভর। আবার অনেকের তো পিতা-মাতাও নেই। কেউ কেউ আবার পরিবারের বড় সন্তান। এহেন পরিস্থিতিতে তারা কোথায় যাবে? এই উত্তর হয়ত কারও জানা নেই। বাস্তবতা এমন, এই তরুণদের অনেকেই আত্মগোপন করে থাকার চেষ্টা করে। পরিচিত সমবয়সী বা বয়স্কদের সামনে পড়লে যদি জানতে চাওয়া হয়, কী করেন সেই উত্তর দিতে পারবে না বলে। এতে করে যে তাদের দিকে অযোগ্যতা ও মেধাহীনতার প্রশ্ন উঠে! এলাকার জুনিয়র চাকরিপ্রাপ্তদের সামনে পড়লে লজ্জা ও নিরব আর্তনাদে ভিতরটা কেঁপে উঠে। ধরে রাখতে পারে না বাঁধ না মানা অশ্রু। তাদের এই বাস্তবতার বেড়াজাল সম্পর্কে কয়জন জানে? কেউ কেউ বাধ্য হয়ে ভিটে-মাটি বিক্রি করে দালাল চক্রের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সমুদ্র পথে পাড়ি দিতে গিয়ে অকালে প্রাণ দিচ্ছে। পড়েছে নানান সমস্যায়। কথায় আছে, শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। কিন্তু কোন জাতিকে শুধু শিক্ষিত করে কর্মের সুযোগ না দিলে সে জাতি মেরুদন্ডহীন হয়ে পড়বে। মূলত শিক্ষিত যুব সমাজ যে কোন দেশের সম্পদ। তাদের কাজে লাগাতে হবে সমৃদ্ধ জাতি ও দেশ গঠনে। কিন্তু তাদেরকে এমন করে কাজে লাগার সুযোগ দিতে তাদের প্রতি সরকার ও নির্ধারকদের কতটুকু ইতিবাচক দৃষ্টি রয়েছে সেটাই বিবেচ্য বিষয়।
আমাদের তরুণরাও একটা সুযোগ চায় তাদের যোগ্যতা প্রমাণের। তারা আবেদন করবে, নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। মেধা থাকলে চাকরি পাবে নয়তো পাবে না। তাতে সমস্যাটা কোথায়? তাছাড়া বয়স বাড়ালে যে সবাই সম সুযোগ পাবে তাও কিন্তু নয়। তাছাড়া এটা তাদের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকারও বটে। এ দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭২ বছর। তবে এখনও কেন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০-এ থমকে থাকবে? বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-২০১৭ অনুসারে এ দেশে বর্তমানে প্রায় ২৭ লাখ বেকার রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করা চাকরিপ্রত্যাশী। ঐ সব শিক্ষিত তরুণের কর্মে প্রবেশের সুযোগ না দিলে সেটা ক্রমবর্ধমান বাড়তে থাকলে এক পর্যায়ে বেকারত্বের বিস্ফোরণ ঘটার সম্ভাবনা শতভাগ। অথচ চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ অবারিত করে দিলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যোগ্য প্রার্থীর অভাবে অসংখ্য শূন্য পদ সঠিক মেধাবীদের দ্বারা পূরণ হয়ে যেত।
বিভিন্ন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, একেকটি পদের জন্য ২/৩ বছর বা তদূর্ধ্ব অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। ২৭-২৮ বছরে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করা ছাত্র-ছাত্রী কীভাবে এই অভিজ্ঞতা দেখাবে? শিক্ষাগত যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতা তো এক নয়। দুইটা সম্পূর্ণই ভিন্ন বিষয়। এই অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তো সেই সময়টুকু থাকতে হবে। যে দেশের যুব সমাজ যত বেশি শিক্ষিত আর তদানুযায়ী কর্মক্ষেত্রে যুক্ত সে দেশ তত বেশি উন্নত আর সমৃদ্ধশালী। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠির অর্জিত শিক্ষা আর সনদ থাকলেও হাতে কর্ম নেই। তাহলে আমরা কিভাবে উন্নত আর সমৃদ্ধশালী হওয়ার আকাশ কুসুম চিন্তা করি? অথচ আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠি কর্মহীনতার যন্ত্রণায় দিশেহারা হয়ে নানা রকম অপরাধ কর্ম, মাদকাসক্ত, মাদক ব্যবসা, ডাকাতি আর নিষিদ্ধ জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত হচ্ছে। এ যেন তাদের কাছে অন্ধের যষ্টি। শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের কাজে না লাগালে আসন্ন ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন, ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ প্রণীত ১৭টি ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (এসডিজি) অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে চূড়ান্ত পর্যায়ের উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার পথে শতভাগ ব্যাঘাত ঘটবে।
দেশের সার্বিক প্রেক্ষাপটে সরকারি চাকরিজীবীদের পদমর্যাদা অনুযায়ী প্রাপ্ত বেতন-ভাতাদি আহামরি কিছু নয়। কারণ একটু ভালো আর সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার পক্ষে এই সীমিত বেতন যথেষ্ট নয়। তাই প্রশ্ন থাকে- কেন এই সরকারি চাকরির প্রতি লোভ আর চাহিদা লাখো বেকার তরুণ-তরুণীর চোখে-মুখে? উত্তরে বলা যায়, এতে সুন্দর ভবিষ্যৎ আর চাকরির শতভাগ নিশ্চয়তা নিহিত রয়েছে। রয়েছে সম্মান আর জীবনের শেষ মুহূর্তে অবসরের সময় এককালীন একটা বড় অংকের সম্মানী। যা অন্য কোন সেক্টরে নেই।
তবে সরকারের ক্ষমতার শেষ মেয়াদে এসে সরকার ও সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বয়স বাড়ানোর ব্যাপারে নড়েচড়ে বসেছেন। বিস্বস্থ সূত্রে জানা যায়, বয়স বাড়ানোর এই বিষয়টাকে নিয়ে সরকারের শীর্ষ মহলে দ্বিমত রয়েছে। সরকার কৌশলগত ভাবেই বিষয়টাকে নির্বাচনী ইশতেহারে যুক্ত করে আগামীতে ক্ষমতায় এসে সেটা বাস্তবায়নের কথা ভাবছে। কারণ দেশের ১০ কোটি ৪১ লাখ ভোটারের মধ্যে ২ কোটি ২৫ লাখ তরুণ রয়েছে। আর এটি তাদের দীর্ঘদিনের দাবী। ফলে এমন প্রতিশ্রুতিতে তরুণ ভোটাররা উদ্বুদ্ধ হয়ে আওয়ামীলীগকে ভোট দেবে বলে ভাবছে সরকার। যদিও অতীতেও এমন পরিকল্পনার কথা বললেও এখনও সেটার বাস্তবায়ন হয়নি। শীর্ষ মহলের কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনের আগে তরুণদের এই দাবি মেনে নিলে ভোটের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আবার কেউ কেউ রয়েছেন এর বিপরিতমুখী অবস্থানে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এমন, এই সব তরুণ নির্বাচনের আগেই এর বাস্তবায়ন চায়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে দেখা যায়, অনেকেই বিভিন্ন পোস্ট বা মন্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে তাদের দাবি মেনে নিলে তারা নিজেরাসহ পরিবার পরিজন ও আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে আওয়ামীলীগকেই বিপুল পরিমাণ ভোট দেবে। এ ক্ষেত্রে তরুণদের দখলে যে ভোট ব্যাংক রয়েছে সেটা স্বাভাবিকভাবেই ২ কোটি ২৫ লাখ থেকে বেড়ে অনেক বড় হয়ে যাবে। তাই এ বিষয়ে খুব দ্রুতই সরকারের পজিটিভ সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ হবে বলে সরকার শুভাকাক্সক্ষীরা ধারণা করছেন।
সার্বিক দিকের উন্নয়নমুখী চিন্তাসহ শিক্ষিত তরুণদের কান্না থামাতে তাদেরকে কর্মে প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে। দিতে হবে দেশকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি। স্বপ্নের সমৃদ্ধশালী ও আধুনিক বাংলাদেশ নামে বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা করে নিতে হলে এখনই চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ন্যূনতম ৩৫ বছর বা তার বেশি করে দেয়াই হবে সঠিক সিদ্ধান্ত।
লেখক: প্রকৌশলী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন