বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

গণতান্ত্রিক গণদাবি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৩ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

আমরা এখন যে সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার সম্মুখীন তা থেকে উত্তরণের প্রাথমিক ধাপ হতে পারে একটি সমঝোতা ও সহাবস্থানমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ এবং নিরপেক্ষ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে সবার সমান সুযোগ সুবিধা নির্ভর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ক্ষমতাসীনরা যেখানে দাবী করছেন তারা দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে গেছেন। গত ১০ বছরে দেশে অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে। পদ্মাসেতু, বেশ কিছু বিদ্যুত প্রকল্প, ফ্লাইওভার, মেট্টোরেলেরমত অবকাঠামো খাতে শত শত কোটি ডলারের একেকটি মেগা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রগণ করা হয়েছে যা এখন বাস্তবায়নাধীন আছে। এমন সব প্রকল্প বাস্তবায়ণকে ক্ষমতাসীনরা তাদের উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে দাবী করতেই পারেন। আর এই দাবীকে সামনে রেখে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার কর্মকৌশলও গ্রহণ করতে পারেন। ইতিমধ্যে তা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। গত দুই বছর ধরে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা উন্নয়নের ঢোল বাজাচ্ছেন। দলীয় নেতাকর্মী এবং সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের ফিরিস্তি জনগনের কাছে তুলে ধরার জন্য বলা হচ্ছে। তবে এসব উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে জনগনের ভোট পাওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছেনা। বিরোধিদল ও জোটের বিরুদ্ধে লাগাতার মামলাবাজির খড়গ এবং অব্যাহত প্রোপাগান্ডার পরও গত কয়েক বছরে দেশের বেশ কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীদের জয় দেখে, তাদের মধ্যে হয়তো এমন ধারনা জন্ম হয়েছে। এ কারণেই নির্বাচনের বছরে এসেও খুলনা, বরিশাল, গাজীপুর, রাজশাহীতে নির্বাচনী প্রহসন দেখা গেছে। দেশি-বিদেশী পর্যবেক্ষকরা এসব নির্বাচনের গ্রহণযেঙাগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একটি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় জাতীয় বা স্থানীয় প্রতিনিধি নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও জনপ্রশাসনের নিরপেক্ষ ভ‚মিকা রাষ্ট্রের একটি মৌলিক অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। সংবিধানে জনগনকেই রাষ্ট্রের মালিকানার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অতএব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো চলবে সংবিধানের মৌলিক শর্ত এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠির প্রত্যাশা ও আবেগের সাথে সামঞ্জস্য বিধানের মধ্য দিয়ে। আমাদের রাষ্ট্রের চলমান বাস্তবতায় রাষ্ট্রের এসব স্টেক হোল্ডারদের আচরণ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অনুগত ক্যাডারের মত। বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দিতা এবং ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের অনুপস্থিতির নির্বাচনটিকে ক্ষমতাসীনরা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্বাচন বলে অভিহিত করে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যথাশীঘ্র আরেকটি নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি। ইতিপূর্বে বিএনপিও ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী প্রায় একই ধরনের নির্বাচন করেছিল। তবে তারা সংসদের একটি অধিবেশন ডেকে নিবার্চনকালীন নির্দলীয় তত্তাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করার মধ্য দিয়ে তাদের কথা রেখেছিল। সেই তত্তাবধায়ক ব্যবস্থার সুযোগ নিয়েই দীর্ঘ একুশ বছর পর আওয়ামীলীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করেছিল। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবারো বিএনপির ক্ষমতা লাভের মধ্য দিয়ে প্রমানীত হয়েছে নির্বাচনকালীন ত্বত্তাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীনদের পুন:নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অতএব ক্ষমতাসীনরা জনগনের কল্যানে কাজ করার পর জনগনের রায়ের উপর আস্থা রাখার কোন বিকল্প নেই। তবে রাষ্ট্রের উন্নতি ও জনগনের কল্যাণ যে শুধু অবকাঠামো, রাস্তা ও বিদ্যুতের উন্নয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটা একজন অতি সাধারণ মানুষও বুঝেন।
পাকিস্তানে আইয়ুব খানের ক্ষমতার দশককে উন্নয়নের দশক হিসেবে দেখানো হয়েছিল। সে সময়কার উন্নয়নের অনেক নির্দশন এখনো আমরা বহন করে চলেছি। ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি) গঠন করে ঢাকার জন্য প্রথম মাস্টার প্লান প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কৃতিত্বও আইয়ুব সরকারের। স্বাধীনতার পর ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও আমাদের সরকার বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার জন্য একটি সময়োপযোগী মাস্টারপ্লান গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি আইয়ুব খানের আমলে গৃহিত পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হিসেবে ঢাকার জন্য যে নগর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হলে ঢাকা শহর আজকের অবস্থায় উপনীত হতো না। সে সময় পরিকল্পিত ও নির্মানাধীন আমাদের জাতীয় সংসদ এখনো বিশ্বের অনন্য স্থাপত্য নির্দশন হিসেবে স্বীকৃত। কমলাপুর রেলস্টেশনের স্থাপত্যশৈলীও সে সময়কার নির্দশন। পাকিস্তানের সামরিক শাসকের উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরা আমার এই বক্তব্যের উদ্দেশ্য নয়। এই বক্তব্যের লক্ষ্য হচ্ছে, এটা তুলে ধরা যে, এরপরও বাঙ্গালীরা পাকিস্তানী সামারিক জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল এবং লাখো প্রাণের বিনিময়ে এই দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। তথাকথিত উন্নয়নের বুলি আওড়ে বাঙ্গালীর গণতন্ত্র ও সমঅধিকারের দাবী থেকে বিচ্যুত করা যায়নি। নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সরকারের সরকারের ইচ্ছায় সামরিক বাহিনী, প্রশাসন ও পুলিশ যদি জনগনের রায়কে প্রভাবিত করতে চাইত তাহলে ৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল হয়তো ভিন্ন হতে পারত। এটা হয়নি বলেই এ দেশের জনগণ ব্যালটের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ রায় দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামীলীগকে চালকের আসনে বসিয়েছিল। দেশে এখন ১৯৫৪ এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনপূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতির মত অবস্থা বিদ্যমান। এখানে অনেক বড় পার্থক্য হচ্ছে, সে সময় ক্ষমতাসীনরা উলঙ্গভাবে নির্বাচন ও জনগনের রায়কে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেনি। বর্তমান বাংলাদেশে বিরোধিদলের অবস্থা ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট বা ১৯৭০ সালের আওয়ামীলীগের অবস্থার চেয়ে অনেক বেশী অগণতান্ত্রিকভাবে প্রতিকূল। স্বাধীনতার পর গত সাড়ে চার দশকে দেশে ক্রমান্বয়ে মাথাপিছু আয় বা জিডিপি বেড়েছে, জীবনযাত্রার ব্যয় ও মান বেড়েছে, বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে ডিজিটালাইজেশন হচ্ছে, যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নত হয়েছে। পক্ষান্তরে রাষ্ট্র যেন স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছে। সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য, শোষণ-বঞ্চনা, দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক লুণ্ঠন বেড়েছে, মানুষের ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাহীনতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও শাসনব্যবস্থা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে এখন অনেক খারাপ অবস্থায় পড়েছে। নিজেদের জাতীয় ও স্থানীয় প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনে জনগন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, জনপ্রশাসনের সাথে সাথে গণমাধ্যমকে ক্ষমতাসীনরা ক্ষীন দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনে এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা দুইশ বছরের ঔপনিবেশিক শোষনের যাঁতাকলে নিস্পিষ্ট হয়েছি। আমরা ২৩ বছরের পাকিস্তানী শাসনে বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হয়েছি। কোটি মানুষের ত্যাগ ও লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের মানুষকে এখনো ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই করতে হচ্ছে, জীবন দিতে হচ্ছে! গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন দেশে এখনো ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে ক্ষমতায় গিয়ে ক্ষমতাসীনরা ভোট ভাতের অধিকারকে আরো দূরুহ করে তোলার বিষ্ময়কর বাস্তবতা বিদ্যমান।
দেশ আজ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আগামীর বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। আওয়ামীলীগ তার উন্নয়নের রূপকল্প এবং নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে যে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি অতীতে দেয়া হয়েছে তার সাথে মানুষের প্রত্যাশা ও বাস্তবতার কোন মিল নেই। এ দেশের মানুষ একটি দুর্নীতিমুক্ত, ক্ষুধামুক্ত, বৈষম্যমুক্ত, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রত্যাশা করেছিল। বৃটিশ ঔপনিবেশিক যুগ পেরিয়ে এ উপমহাদেশের মানুষ স্বরাজ প্রতিষ্ঠার পর প্রথম অভিজ্ঞতা ছিল, ‘এ আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’। এর আগেই বাঙ্গালী জাতিসত্ত¡ার কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর আমার কৈফিয়ত কবিতায় লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায়না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন, বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক’বাছা কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।’ এরপর ২৩ বছরের সংগ্রাম শেষে লাখো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৭ বছর পর এখনো ক্ষুধাতুর শিশুরা ঢাকার ফুটপাতে, বস্তিতে ঘুমায়। এখনো অভাবের তাড়নায় নাড়ী ছেঁড়া ধন সন্তান বিক্রি করতে বাধ্য হয় অনেক মানুষ, একটা ভাল কর্মসংস্থান ও নিরাপদ জীবনের আশায় লাখ লাখ মানুষ বৈধ-অবৈধ পথে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। এভাবেই দেশে মানুষের গড় মাথাপিছু আয় বেড়েছে। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপে দেখা গেছে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ৫টি মহাদেশের উন্নত ও উন্নয়নশীল সবদেশের মধ্যে বাংলাদেশ এক নম্বরে রয়েছে। যদিও অর্থনীতির আকার এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের ৫০টি দেশের তালিকায় পড়েনা। এর মানে হচ্ছে, এ দেশের ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে, গরীব আরো গরীব হচ্ছে।অর্থাৎ অর্থনৈতিক বৈষম্য আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেড়েছে। কোটি কোটি মানুষকে অধিকার বঞ্চিত করে মাত্র কয়েকশ মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলছে। এসব মানুষের কাছে সামাজিক সাম্য, আইনের শাসন, রাজনৈতিক সহাবস্থান ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জিম্মি হয়ে পড়েছে। ইতিহাস তো ক্ষমতাসীনরাই লেখায়। একাত্তুরের আগে অবস্থা এতটা প্রকট ছিল কিনা দেশের মুক্তিযোদ্ধা এবং সে সময়ের ভুক্তভোগিরাই তা বলতে পারবেন। দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে খাদ্য উৎপাদনও বেড়েছে, রফতানীমুখী গার্মেন্টস কারখানা বেড়েছে, বাণিজ্য বৈষম্য বেড়েছে, দুর্নীতি-লুন্ঠন বেড়েছে তারই পথ ধরে অর্থনৈতিক বৈষম্যও বেড়েছে। রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টর দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও অস্বচ্ছতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। কথা ছিল ডিজিটালাইজেশন হলে দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা কমে আসবে, সরকারী প্রশাসনিক সেবা গতিশীল ও সহজ হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টর বড় ধরনের লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে। প্রায় প্রতিটি সরকারী ব্যাংক এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রির্জাভ ডিজিটাল লুন্ঠনের শিকার হয়ে দেশের অর্থনীতি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। আভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান, বৈদেশিক কর্মসংস্থানে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বর্ষা শেষ হতে না হতেই দেশের নদীগুলো শুকিয়ে মরুভ’মি হয়ে যাচ্ছে, বর্ষার শুরুতে সে সব নদীই আবার প্রলয়ঙ্করী রূপ নিয়ে হাজার হাজার মানুষের বসতবাড়ি, জমিজিরাত ভেঙ্গে নি:স্ব করে দিচ্ছে। এভাবে এ দেশে আগামী দিনের প্রাণপ্রকৃতি, কৃষি এবং খাদ্য নিরাপত্তা চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এহেন বাস্তবতায় টেকসই উন্নয়নের রূপকল্প বাস্তবায়ন অসম্ভব। বিশেষত: সামাজিক নিরাপত্তা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং সুশাসন নিশ্চিত না করে উন্নয়নের কোন মানদন্ডই রক্ষা করা সম্ভব নয়। হাজার মিথ্যা মামলা, গায়েবী মামলা, মুক্তভাবে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের অধিকার, স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার ও আইনের শাসনকে নিয়ন্ত্রিত রাখা স্বাধীনতার লক্ষ্য ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশন থেকে দেশে ফিরে গণভবনে নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে দেয়া বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েকটি ইঙ্গিতপূর্ণ দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের ব্যাপারে নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার কথা বলেছেন। জনগনের কাছে সরকারের সাফল্য তুলে ধরার নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি আত্মতুষ্টিতে না ভুগে বিজয় নিশ্চিত করতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য ও দিক নির্দেশনা দলীয় রাজনৈতিক বিষয় হলেও এতে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, আগামী সরকারী দলের নেতাকর্মীরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন। আত্মতুষ্টি মানে পতন এ কথাও বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের রাজনীতির চলমান বাস্তবতায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের অনিশ্চয়তা এখনো বিদ্যমান। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রবলভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিরোধি মত দমনে নানামাত্রিক নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা, ক্রসফায়ার-বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবর্হিভ’ত হত্যাকান্ড, সাদা পোশাকে অভিযানের নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে ফোর্স ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সের এন্তার অভিযোগ বাংলাদেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি বার বার দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নেতিবাচক মন্তব্যের সম্মুখীন হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন স্বাধীন মত ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর নতুন খড়গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজেদের বিজয় নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য সবকিছু করতে মরিয়া আচরণ করছে সরকার। যেখানে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সব রাজনৈতিক দল ও জনগনের আস্থাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণের কথা, সেখানে বিরোধিদলের লাখ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে নতুন নতুন মামলা দিয়ে নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণকে কার্যত: অসম্ভব করে তোলা হচ্ছে। দলের শীর্ষ নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম, খালেদা জিয়াকে জেলে নেয়ার পরও বিএনপি কোন কঠোর আন্দোলনে যায় নি। ফেব্রæয়ারীর ৮ তারিখে জেলে নেয়ার সময় নেতা-কর্মীদের শান্ত থাকার এবং কোন সহিংস আন্দোলনে না যাওয়ার নির্দেশ ছিল খালেদা জিয়ার। সেদিন ঢাকার রাজপথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রণমূর্তি ও অঘোষিত কার্ফিউর মধ্যেও খালেদা জিয়ার জন্য হাজার হাজার নেতাকর্মী রাজপথে নেমে এসেছিল। এরপর খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবীতে বিএনপির প্রতিটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশে লাখো জনতার ঢল নামতে দেখা গেছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর সহরাওয়ার্দি উদ্যানের সমাবেশ ২৪ ঘন্টা আগেও অনিশ্চিত ছিল। মাত্র ২৪ ঘন্টা আগে অনুমোদন, বহু শর্ত, পথে পথে বাঁধা সর্বোপরি হাজার হাজার মামলা এবং নতুন মামলা ও গ্রেফতারের ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে সহরাওয়ার্দি উদ্যানের সমাবেশটি বিএনপি নেতা-কর্মীদের সরব উপস্থিতিতে জনসমুদ্রে পরিনত হওয়া সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ ও চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ শেষ হওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই জেলের বাইরে থাকা বিএনপি’র শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে নতুন মামলার খবর জানা গেল। মির্জা ফখরুল ইসলাম, মওদুদ আহমদ, ড.মঈন খান, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ, রুহুল কবির রিজভীসহ শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাজে বাঁধা দেয়ার অভিযোগে পুুলিশের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে। যদিও বিএনপি’র সমাবেশকে ঘিরে কোন সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা বা পুলিশের কাজে বাধা দেয়া দেয়ার মত কোন তথ্য মামলার আগে জানা যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে পুলিশ এমন কিছু মামলা দিয়েছে গণমাধ্যমে যা’ গায়েবী মামলা বলে অভিহিত হয়েছে। সহরাওয়ার্দি উদ্যানের সমাবেশের পর চাঙ্গা বিএনপি নেতাকর্মীদের ভয় ধরিয়ে দিতে শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে নতুন গায়েবী মামলা দেয়া হচ্ছে বলে বিএনপি’র পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।
একদিকে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের অন্যতম বড় দল ও জোটকে নির্বাচনের বাইরে রাখার জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করা হচ্ছে। বিরোধিদল যখন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট দাবী দাওয়া তুলে ধরার পাশাপাশি আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষনা করেছে, সে সব দাবী নিয়ে আলোচনা করে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করার বদলে সরকারী দল রাজপথ দখলে রাখার পাল্টা কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে। শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় দেশকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের পথ রুদ্ধ করে আরেকটি একপাক্ষিক নির্বাচন অথবাবিরোধি দল ও জোটের প্রতি রাজপথের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দাবী আদায়ের শক্তি পরীক্ষার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে সরকার। আমরা ধরে নিচ্ছি বিগত সময়ের মত বিরোধিদলের সামনের আন্দোলনও পুলিশ দিয়ে দমনের চেষ্টা করা হবে। সেখানে সংঘাত-সহিংসতা অনিবার্য হয়ে দেখা দিতে পারে। অত:পর বিএনপি আন্দোলনে ব্যর্থ হয়েছে বলে দাবী করে আরেকটি একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামীলীগ তৃতীয়বারের মত ক্ষমতায় আসার রেকর্ড সৃষ্টি করবে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আইনের শাসন, মানবধিকার , বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও টেকসই উন্নয়নের সব রূপকল্প বড় ধরনের সংকটে নিপতিত হতে পারে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন এবং ক্ষমতাসীনদের অধীনে অবাধ নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অসম্ভব। এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে দেশে একটি জাতীয় ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, অবাধ নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপক জনপ্রত্যাশার বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী যে কোন রাজনৈতিক শক্তি একদিন ইতিহাসের আস্তাকুঁেড় নিক্ষিপ্ত হতে বাধ্য।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
কামরুজ্জামান ৩ অক্টোবর, ২০১৮, ৩:৩৪ এএম says : 0
কবে যে তারা এটা বুঝবে
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন