কুরআন মাজীদে পঁচিশজন নবী-রাসূলের নাম সুস্পষ্ট ভাষায় এসেছে। নাম ছাড়া প্রসঙ্গ এসেছে আরো কয়েকজনের। আল্লাহ তাআলা এই নবী ও রাসূলদের মধ্যে কারো কথা সংক্ষিপ্ত ভাবে বলেছেন। আবার কারো বিবরণ বিস্তারিতভাবে দিয়েছেন। তন্মধ্যে অনেক নবী-রাসূলের কাহিনীতে রয়েছে, তার জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তে, বিভিন্ন স্বস্তি ও সংকটকালে, আনন্দ বা বেদনার সময় বিশেষ ভাষায় আল্লাহ পাকের নিকট মুনাজাত বা প্রার্থনা করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাদের সেসব মুনাজাত কবুল করেছেন। যেহেতু নবী-রাসূলগণ আল্লাহ পাকের মনোনীত ও নির্বাচিত মহান দূত ও প্রেরিত পুরুষ ছিলেন, তাই তারা যে পরিস্থিতিতে যে শব্দে বা ভাষায় দুআ করেছেন, সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে আমরাও যদি হুবহু ওই শব্দে মহান আল্লাহ পাকের নিকট মুনাজাত করি, তবে আশা করা যায়, আমাদের দুআ ও কবুল হবে। কুরআন মজীদে যে সব নবী-রাসূলের দুআ উল্লেখিত হয়েছে, যুগ ও এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করে তাঁদের দুআ উল্লেখিত হল।
হজরত আদম (আঃ)-এর দু’আঃ আল্লাহ তাআলা হজরত আদম আলাইহিস সালাম ও মা হাওয়াকে সৃষ্টি করার পর উভয়কে বললেন, তারা জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা অবস্থান করতে পারবে এবং জান্নাতের সবকিছু থেকে উপকৃত হতে পারবে। একটি নির্দিষ্ট বৃক্ষের দিকে ইঙ্গিত করে বলে দেওয়া হল এই বৃক্ষের ফল আহার করবে না। এমনকি সেই বৃক্ষের কাছেও ঘেঁসবে না। কিন্তুু শয়তানের কুমন্ত্রনায় তারা সেই নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করে ফেলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ পাক তাদের কে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলেন। পৃথিবীতে এসে তারা তাঁদের কৃত ভুলের কথা স্মরণ করে আল্লাহর দরবারে রোনাযারি করতে থাকেন। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাদেরকে প্রার্থনাবাণী শিখিয়ে দেওয়া হল। তারা বললেন: “হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করেছি, যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন তবে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অর্ন্তভুক্ত হব” (সূরা-আরাফ ২৩)।
হজরত নূহ (আঃ)-এর দু’আঃ হজরত নূহ আলাইহিস সালাম সাড়ে নয়’শ বছর যাবৎ তার কওমকে হেদায়েতের দিকে আহবান করতে থাকেন। কিন্তু তার কওম তার আহবান প্রত্যাখ্যান করত, তাঁকে ভীতি প্রদর্শন করত এবং তাঁকে লক্ষ করে বলত, এতো এক পাগল। তখন তিনি আল্লাহ পাকেকে আহবান করে বললেন, “হে আল্লাহ, আমি অসহায়। অতএব আপনি প্রতিবিধান করুন” (সূরা-কামার ১০)। অল্পকিছু লোক ব্যতীত অধিকাংশরা যখন তাঁকে প্রত্যাখানই করতে থাকে তখন তিনি দুআ করেন, “হে আমার প্রতিপালক, আমার সম্প্রদায় আমাকে মিথ্যাবাদী বলছে। অতএব আমার ও তাদের মধ্যে কোন ফয়সালা করে দিন এবং আমাকে ও আমার সঙ্গী মুমিনদেরকে রক্ষা করুন” (সূরা-শুআরা ১১৭-১১৮)। তিনি পরিশেষে যখন তাদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরাশ হলেন এবং বুঝতে পারলেন। তাদের সীমালংঘনের শাস্তি অবধারিত তখনই তিনি তাদের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে আল্লাহ পাকের নিকট প্রার্থনা করলেন, “হে আমার রব, আপনি পৃথিবীতে কোন কাফের গৃহবাসীকে রেহাই দিবেন না। যদি আপনি তাদেরকে রেহাই দেন তবে তারা আপনার বান্দাদেরকে পথভ্রষ্ট করবে এবং জন্ম দিতে থাকবে কেবল পাপাচারী, কাফের” (সূরা-নূহ ২৬-২৭)। তারপর হজরত নূহ (আঃ) মুমিনদের জন্য প্রর্থনা করে বলেন, “হে আমার পালনকর্তা, আপনি ক্ষমা করুন আমাকে, আমার পিতামাতাকে এবং যারা মুমিন হয়ে আমার গৃহে প্রবেশ করে তাদেরকে এবং সকল মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীকে” (সূরা-নূহ ২৮)। সবশেষে তিনি কাফেরদের বেলায় কঠোরতর ভাষায় বদদুআ করে বলেন, “আর আপনি জালেমদের শুধু ধ্বংসই বৃদ্ধি করুন” (সূরা-নূহ ২৮)। হজরত নূহ (আঃ) মুমিনদের জন্য নেকদুআ এবং কাফেরদের জন্য বদদুআ করেছিলেন। তার উভয় প্রার্থনা কবুল হয়েছিল। আল্লাহ পাক তাঁকে একটি নৌযান তৈরি করার নির্দেশ দেন। তারপর সেই নৌযানে মুমিনদেরকে নিয়ে আরোহণের হুকুম হল। তিনি তা-ই করলেন তিনি নৌযানে আরোহণের সময় বললেন, “আল্লাহ পাকের নামেই এর গতি ও স্থিতি। নিশ্চয়ই আমার রব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু” (সূরা-হুদ ৪১)। হজরত নূহ (আঃ) সকল মুমিন মুসলমানকে নিয়ে নৌযানে আরোহণের পর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে নিন্মোক্ত দুটি দুআ পাঠ করতে বললেন, “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি আমাদেরকে জালেম সম্প্রদায় থেকে উদ্ধার করেছেন” (সূরা-মুমিনূন ২৯)। “হে আমার রব, আমাকে এমনভাবে অবতরন করিয়ে দিন যা হবে কল্যাণকর; আর আপনিই শ্রেষ্ঠ অবতরণকারী” (সূরা-মুমিনূন ২৯)।
হজরত হুদ (আঃ)-এর দু’আঃ হজরত হুদ আলাইহিস সালাম অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তাঁর কওমকে হেদায়াতের দিকে আহবান করেছিলেন। তাঁর কথায় ওরা কর্ণপাত না করায় তিনি তাদেরকে আল্লাহ পাকের শাস্তির ভয় দেখান। কিন্তু তাঁর সম্প্রদায় আরও ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে তাঁকে মিথ্যাবাদী বলল। তখন হজরত হুদ (আঃ) আল্লাহ পাকের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে বলেন, “হে আমার রব, তারা আমাকে মিথ্যাবদী প্রতিপন্ন করেছে। সুতরাং আপনি আমার সাহায্য করুন” (সূরা-মুমিনূন ৩৯)। সূরা মুমিনূনের ছাব্বিশতম আয়াত থেকে বুঝা যায়, এই দুআখানি হজরত নূহ (আঃ) ও করেছিলেন।
হজরত ইবরাহীম (আঃ)-এর প্রার্থনাঃ হজরত ইবরাহীম (আঃ) এর অনেক গুলো দুআ পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। তিনি নবুয়াতের দায়িত্ব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার পিতা ও কওমকে মূর্তিপূজা বর্জন করে এক আল্লাহর ইবাদত করতে বলেন। তিনি এক পর্যায়ে বলেন, তোমরা যেগুলোর পূজা করো এগুলো আমার শত্রু । জগৎগৃহের প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহতাআলাই আমার প্রভু। যিনি আমাকে সঠিক পথের সন্ধান দেন। আমাকে আহার্য এবং পানীয় দেন এবং আমি অসুস্থ হলে রোগমুক্ত করেন। যিনি আমাকে মৃত্যু দেবেন এবং পুনরায় জীবিত করবেন। তারপর ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহ পাকের নিকট প্রার্থনা করেন- “হে আমার পালনকর্তা, আমাকে প্রজ্ঞা দান করুন এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করুন এবং আমাকে পরবর্তীদের মধ্যে যশস্বী করুন, আমাকে সুখময় জান্নাতের অধিবাসীদের অর্ন্তভুক্ত করুন” (সূরা- শুআরা ৮৩-৮৫)। হজরত ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহ পাকের নির্দেশে দুগ্ধপোষ্য পুত্র ইসমাঈল ও স্ত্রী হাজেরাকে মক্কার অনাবাদী ঊষর মরুপ্রান্তরে রেখে নিজ আবাসস্থল ফিলিস্তিনে ফিরে আসছিলেন। তিনি চলতে চলতে এক পর্বতশীর্ষে আরোহণ করলেন, যেখান থেকে স্ত্রী ও প্রিয় পুত্রধনকে দেখা যাচ্ছিলনা। তখন কাবা শরীফের দিকে মুখ করে আল্লাহপাকের নিকট প্রর্থনা করলেন। (“ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী, আলজামিউস সহীহ, ১/৪৭৫ (কিতাবুল আম্বিয়া); মওলানা হিফুযুর রহমান সিউহারবী, কাসাসুল কুরআন ১/২২৭;”)
“হে আমাদের প্রতিপালক, আমি আমার বংশধরদের কতককে আপনার পবিত্র গৃহের সন্নিকটে অনাবাদ উপত্যকায় বসবাস করালাম। হে আমাদের প্রতিপালক, তা এই জন্য যে, তারা যেন সালাত কায়েম করে। অতএব, আপনি কিছু লোকের অন্তর তাদের প্রতি অনুরাগী করে দিন এবং ফলাদি দ্বারা তাদের রিযিকের ব্যবস্থা করুন, যাতে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। হে আমাদের পালনকর্তা, নিশ্চয়ই আপনি জানেন আমরা যা গোপন করি এবং যা প্রকাশ করি। আল্লাহর নিকট আকাশ-ভূমির কোন কিছুই গোপন নেই।” হজরত ইবরাহীম (আঃ) কিছুকাল মক্কা নগরীতে অবস্থান করেন। তিনি আল্লাহ পাকের একজন রাসূল হিসেবে নিজেকে ও নিজের সন্তানকে মূর্তিপূজা থেকে মুক্ত রাখার এবং তাদের আবাসস্থল পবিত্র মক্কা নগরীকে নিরাপদ শহরে পরিণত করার প্রার্থনা করে বলেন, “হে আমার প্রতিপালক, এই নগরীকে শান্তিময় শহর করে দিন এবং আমাকে আমার পুত্রগণকে মূর্তিপূজা থেকে দূরে রাখুন। হে আমার প্রতিপালক, এই সকল মূর্র্তি তো বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। সুতরাং যে আমার দলভুক্ত, আর কেউ আমার অবাধ্য হলে আপনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু” (সূরা-ইবরাহীম ৩৫-৩৬)। হজরত ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহ পাকের নিকট নেক সন্তানের জন্য প্রার্থনা করে বলেন,“হে আমার রব, আমাকে এক সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান করুন”। (সূরা- সাফফাত ১০০)। আল্লাহ পাক তার প্রার্থনা মঞ্জুর করে তাঁকে একজন স্থিরবুদ্ধি পুত্রের সুসংবাদ দান করেন। এর অল্পদিন পর হজরত ইসমাঈল (আঃ) জন্ম লাভ করেন। হজরত ইসমাঈলের পর হজরত ইবরাহীম (আঃ) এর প্রথম স্ত্রী হজরত সারা-এর গর্ভে ইসহাক নামক দ্বিতীয় পুত্র জন্মগ্রহন করেন। হজরত ইবরাহীম (আঃ) একশ বছর বয়সে দুই পুত্রের পিতা হয়ে আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করেন। “কাসাসুল কুরআন ১/২৩১;” “সকল প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য, যিনি আমাকে বার্ধক্যে ইসমাঈল ও ইসহাককে দান করেছেন। আমার প্রতিপালক অবশ্যই প্রার্থনা শুনে থাকেন। হে আমার প্রতিপালক, আমাকে ও আমার বংশধরদের থেকে সালাত কায়েমকারী করুন। হে আমাদের রব, আমার প্রার্থনা কবুল করুন। হে আমার প্রতিপালক, যেদিন হিসাব হবে সেদিন আমাকে আমার পিতামাতা কে এবং মুমিনদেরকে ক্ষমা করুন” (সূরা-ইবরাহীম ৩৯-৪১)। হজরত ইবরাহীম (আঃ) মক্কা নগরীর নিরাপত্তা এবং মক্কার মুমিন অধিবাসীদের জন্য জীবিকা প্রার্থনা করে আরও দুআ করেন, “হে আমার প্রতিপালক, মক্কাকে নিরাপদ শহর করুন, আর এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী তাদেরকে ফলমুল থেকে জীবিকা প্রদান করুন” (সূরা-বাকারা ১২৬)। আল্লাহ পাক হজরত ইবরাহীম (আঃ) কে আল্লাহর গৃহ কাবা শরীফ নির্মাণ করার নির্দেশ দেন। হজরত ইবরাহীম (আঃ) পুত্র ইসমাঈলকে সঙ্গে নিয়ে আল্লাহর ঘর নির্মাণ করেন। “কাসাসুল কুরআন, ১/২৪২;” নির্মাণ কার্য সমাপ্ত করার পর পিতাপুত্র দুআ করেন, “হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের এই কাজ গ্রহণ করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা। হে আমাদের প্রতিপালক আমাদের উভয় কে আপনার একান্ত অনুগত করুন এবং আমাদের বংশধর থেকে আপনার এক অনুগত উম্মত করুন। আমাদেরকে ইবাদতের নিয়মপদ্ধতি দেখিয়ে দিন এবং আমাদের তওবা কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু” (সূরা-বাকারা ১২৭-১২৮)। পবিত্র কুরআনে সূরায়ে মুমতাহিনায় রয়েছে, হজরত ইবরাহীম (আঃ) তার কাফের ও মুশরিক স¤প্রদায়কে লক্ষ্য করে বলেছেন তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা কর তাদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান না আনলে তোমাদের ও আমাদের মধ্যে চিরকালের জন্য শত্রুতা-বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়ে রইল। তখন ইবরাহীম (আঃ) তার অনুসারীগণ আল্লাহ পাকের নিকট সকাতর প্রার্থনায় বলেছেন, “হে আমাদের রব, আমরা তো আপনারই উপর নির্ভর করেছি, আপনারই অভিমুখী হয়েছি এবং প্রত্যাবর্তন তো আপনারই নিকট। ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি আমাদেরকে কাফেরদের জন্য পরীক্ষার পাত্র করবেন না। হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করুন। নিশ্চই আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়” (সূরা- মুমতাহিনা ৪-৫)।
হজরত লুত (আঃ)-এর দু’আঃ হজরত লুত (আঃ) হজরত ইবরাহীম (আঃ)-এর পরামর্শে দাওয়াত ও হেদায়েতের উদ্দেশ্যে মৃতসাগরের দক্ষিণ পাশের অঞ্চলে এসে অবস্থান গ্রহণ করেন। এখানে সাদূম ও আমূরা গোত্রদ্বয়ের বসতি ছিল। “ডক্টর শাওকী আবু খলীল, আতলাসুল কুরআন ৬১;” তিনি এখানে এসে দেখলেন, এখানকার লোকেরা এক প্রকার অতি কুৎসিৎ কুকর্মে লিপ্ত। তিনি সকলকে এ ধরনের অপকর্ম থেকে বিরত থাকতে কঠোরভাবে সতর্ক করলেন। কিন্তু তারা তার কথায় বিন্দু মাত্র কর্ণপাত করল না: বরং তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করতে লাগল। হজরত লূত (আঃ) এই সংকট কালে দুটি দুআ করেন। তিনি মুমিনদের জন্য প্রার্থনা করলেন, “হে আমার রব, আমাকে ও আমার পরিবার-পরিজনকে এহেন দুস্কর্ম থেকে রক্ষা করুন” (সূরা-শুআরা ১৬৯)। তার অপর দুআটি হল, “হে আমার প্রতিপালক, বিপর্যয়সৃষ্টিকারী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাকে সাহায্য করুন” (সূরা-আনকাবুত ৩০)। আল্লাহ পাক তার দুআ কবুল করলেন। তাঁকে ও তার অনুসারীদেরকে রক্ষা করলেন এবং অপরাধীদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিলেন।
হজরত ইউসুফ (আঃ)-এর মুনাজাত : মিসর-অধিপতির স্ত্রী হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। অল্প দিনের মধ্যেই এ কথা রাষ্ট্র হয়ে যায় যে, আযীযের স্ত্রী তার ক্রীতদাসের প্রতি প্রেমাসক্ত হয়ে পড়েছে। আযীযের স্ত্রী এ দুর্নাম আপনোদনের জন্য মিসরের নারীদেরকে দাওয়াত করলেন মিসরের নারীগণ হজরত ইউসুফের রূপ-গরিমা দেখে অভিভূত হয়ে গেল। সকলেই হজরত ইউসুফের প্রতি অনুরাগী হয়ে পড়ল এবং তাঁকে বলল, তুমি আযীযের স্ত্রীর অনুগত্য কর। ঈমানের এরূপ কঠিন পরীক্ষার মুহূর্তে হজরত ইউসুফ (আঃ) আল্লাহ পাকের মহান দরবারে দুআ করলেন, “হে আমার প্রতিপালক, এই নারীরা আমাকে যার প্রতি আহবান করেছে তা আপেক্ষা কারাগার আমার নিকট অধিক প্রিয়” (সূরা-ইউসুফ ৩৩)। আল্লাহ পাক হজরত ইউসুফের এই বিনীত প্রার্থনা কবুল করেছেন। হজরত ইউসুফকে তাঁর ভাইরা কেনআনের কূপে ফেলে দিয়েছিল। আল্লাহ পাক তাকে কূপ থেকে উদ্ধার করে মিসর নিয়ে গেলেন। মিসরে এক মিথ্যা অপবাদে তাঁকে কারাগারে যেতে হয়। আল্লাহ তাআলা তাঁকে কারাগার থেকে মুুক্তি দিয়ে মিসরের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করে দিলেন। পিতা-মাতা ও আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে দীর্ঘ দিন পর তার সাক্ষাৎ হল। তিনি ইহকালীন জীবনে সর্বদিক থেকে আল্লাহ পাকের রহমত ও নেয়ামত লাভ করার পর জীবনসায়াহ্নে এসে আল্লাহ পাকের নিকট নিবেদন করলেন, “কাসাসুল কুরআন ১/২৯৫;” “হে আমার রব, আপনি আমাকে রাজ্য দান করেছেন এবং স্বপ্ন ও অন্যান্য কথার ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছেন। হে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা, আপনিই ইহলোক ও পরলোকে আমার অভিভাবক। আপনি আমাকে মুসলিমহিসেবে মৃত্যু দিন এবং আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত করুন” (সূরা-ইউসূফ ১০১)।
হজরত শুয়াইব (আঃ)-এর প্রার্থনাঃ মাদাইয়ানবাসীর নিকট হজরত শুয়াইব আলাইহিস সালাম নবীরূপে প্রেরিত হয়েছিলেন। তিনি তার কওমকে বললেন, তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর। তেমরা পরিমাপ ও ওজন ঠিকভাবে দিও। আল্লাহর প্রতি যারা ঈমান আনে, তাদেরকে আল্লাহর পথে বাধা দিও না। তখন তার সম্প্রদায়ের দাম্ভিক ও অতি দুরাচার নেতৃবর্গ বলল, হে শুয়াইব, তোমরা আমাদের ধর্মাদশে ফিরে না আসলে আমরা তোমাদের কে আমাদের জনপদ থেকে অবশ্যই বহিষ্কার করে দেব। তখন হজরত শুয়াইব আল্লাহ পাকের সাহায্য প্রার্থনা করে বললেন, “হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের ও আমাদের সম্প্রদায়ের অপরাধীদের মধ্যে ন্যায্যভাবে মীমাংসা করে দিন এবং আপনিই মীমাংসাকারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ” (সূরা-আরাফ ৮৯)। আল্লাহ পাক তার দু’আ কবুল করে অপরাধীদের ধ্বংস করে দিলেন।
হজরত মূসা (আঃ)-এর দু’আঃ হজরত মূসা (আঃ)-একবার মিসরের এক পথ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে দেখতে পেলেন, জনৈক স্থানীয় ব্যক্তি একজন ইসরাঈলীর উপর জুলুম করছে। তিনি সে স্থানীয় ব্যক্তিকে প্রথমত জুলুম থেকে বিরত থাকতে বললেন, কিন্তু সে তার কথা অমান্য করল। তিনি তৎক্ষাণাৎ এই অপরাধীকে হাত দিয়ে আঘাত করলেন। তাতে সে মারা গেল। হজরত মূসা (আঃ)-এর তাকে হত্যা করার ইচ্ছা ছিলনা। তিনি সঙ্গে সঙ্গে লজ্জিত হলেন এবং বললেন, নিশ্চয় এটি শয়তানের কাজ। তারপর তিনি ,আল্লাহ পাকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেন, “হে প্রভু আমি নিজের উপর জুলুম করেছি। অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন” (সূরা- কাসাস ১৬)। আল্লাহ পাক তাকে ক্ষমা করে দিলেন। তিনি তখন তওবা করে বললেন, “হে আমার প্রতিপালক, যেহেতু আপনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, আমি কখনো অপরাধীদের সাহায্যকারী হব না” (সূরা- কাসাস ১৭)।
হজরত মূসা আ. কতৃক জনৈক মিসরী কিবতীকে হত্যার সংবাদ দ্রুতবেগে জানাজানি হয়ে গেল। ফেরাউনের পরিষদবর্গ হজরত মূসা আ. কে হত্যা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে তাঁকে খুঁজতে শুরু করল। তিন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সেখান থেকে বের হয়ে পড়লেন এবং আল্লাহর কাছে দুআ করলেন, “হে আমার রব, আপনি জালেম সম্প্রদায় থেকে আমাকে রক্ষা করুন” (সূরা-কাসাস ২১)। হজরত মূসা আ. মিসর থেকে পালায়ন করে লোহিত সাগরের পূর্ববর্তী অঞ্চল মাদাইয়ানে চলে আসলেন। তার জন্য মাদাইয়ান সম্পূর্ণ নতুন জায়গা। পথ-ঘাট ও মানুষজন একেবারে অপরিচিত। তিনি মুসাফির, কপর্দকহীন। এমন অসহায় অবস্থায় তিনি আল্লাহ পাকের মহান দরবারে বিনয়াবনত হয়ে প্রার্থনা করেন। “হে আমার পালনকর্তা, আপনি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ করবেন, আমি তারই কাঙ্গাল। আল্লাহ পাক তার দুআ কবুল করলেন। আল্লাহ পাকের নবী হজরত শুয়াইবের গৃহে স্থায়ীভাবে তার থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।
আলাহ তাআলা হজরত মূসা আ. কে নবুওয়াত দান করে সর্বাগ্রে ফেরাউনের নিকট দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে যাওয়ার জন্য বললেন। কারন সে সীমাহীন উদ্ধত নাফরমান ও স্বৈ রাচারী। সে চরম পর্যায়ের দাম্ভিকতাবশত বনী ইসরাঈলকে গোলাম বানিয়ে রেখেছে। এত বড় জালেম ও অংহকারী বাদশাহর নিকট দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে যাওয়ার মতো কঠিন দায়িত্ব পেয়ে হজরত মূসা আ. আল্লাহ পাকের নিকট প্রার্থনা করলেন, “হে আমার প্রতিপালক, আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন। আমার জিহবার জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে ” (সূরা-ত্বহা ২৫-২৮)। হজরত মূসা আ. এর ভাষায় জড়তা ছিল। ফেরাউনের নিকট স্পষ্ট ভাষায় দাওয়াত পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে তখন তিনি তার মনের ও কথার শক্তি বৃদ্ধির জন্য একজন সহযোগী প্রার্থনা করে আল্লাহ পাকের নিকট দুআ করলেন, “ আমার জন্য আমার স্বজনবর্গের মধ্যে থেকে একজন সাহায্যকারী স্থির করুন, আমার ভ্রাতা হারুনকে, তার দ্বারা আমার শক্তি সুদৃঢ় করুন এবং তাকে আমার কর্মে অংশীদার করুন। যাতে আমরা প্রচুর পরিমাণে আপনার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষনা করতে পারি এবং আপনাকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করতে পারি। আপনি তো আমাদের সম্যক দ্রষ্টা” (সূরা-ত্বহা ২৯-৩৫)। আল্লাহ তাআলা হজরত মূসা আ.-এর উভয় দুআই কবুল করেন।
হজরত মূসা আ. যখন আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে বনী ইসরাঈল স¤প্রদায়ের জন্য হেদায়তের গ্রন্থ হিসেবে তাওরাত গ্রহণ করতে তুর পাহাড়ে গমন করলেন, তখন বনী ইসরাঈল গোষ্ঠী সামেরী নামক মুনাফিকের পরামর্শে বাছুরপূজা শুরু করল। হজরত মূসা আ. তাওরাত নিয়ে তাদের নিকট পৌঁছার আগেই আল্লাহ পাক তাকে একথা জানিয়ে দেন। তিনি ক্রদ্ধ ক্ষুব্ধ হয়ে এসে প্রথমেই তার স্থলাভিষিক্ত আপন ভাই হজরত হারুন আ. এর কেশাগ্র স্পর্শ করে টানতে শুরু করলেন। হজরত হারুন আলাইহিস সালাম বললেন, তাদেরকে আমি বাধা দিয়েছি। কিন্তু তারা আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে। সে কঠিন মুহুর্তে আমি খুব অসহায়ত্ব বোধ করেছি। সুতরাং আমার সঙ্গে এমন কোন আচরণ করো না যার ফলে শত্রুরা খুশি হয়। আর আমাকে জালেমদের অন্তর্ভূক্ত গণ্য করো না। হজরত মূসার ক্রোধ প্রশমিত হলে তিনি আল্লাহ পাকের নিকট দুআ করলেন, “হে আমার প্রতিপালক, আমাকে ও আমার ভ্রাতাকে ক্ষমা করুন এবং আমাকে আপনার রহমতের মধ্যে দাখিল করুন। আর আপনিই শেষ্ঠ দয়ালু” (সূরা-আরাফ ১৫১)। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন