শরীফুর রহমান আদিল
কয়েক দিন আগে ফেনীতে এক শিক্ষকের ছাত্রের উপর নিষ্ঠুর আচরণ ও নির্যাতনের ঘটনা সারাদেশেই সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এমনিভাবে দেশের কোথাও না কোথাও কোন না কোন শিক্ষার্থী এভাবে তার শিক্ষক কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে; এমনকি হাসপাতালে ভর্তির খবরও সংবাদপত্রে আসছে। এই ধরনের অমানবিক ও নির্যাতনকারী শিক্ষক কিংবা নির্যাতন বা শাস্তির ব্যাপারে কঠোর আইন প্রণয়ন করা দরকার যা শিক্ষা আইনে রয়েছে। তবে এমন কোন আইন যেন না হয় যাতে শিক্ষককে ‘নিদি-রাম সর্দার’র পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়! শিক্ষক তার ছাত্রকে সামান্য প্রহার কিংবা মানসিকভাবে কিছুটা লজ্জিত করতেই পারে; যার উদ্দেশ্য হবে একমাত্র সংশ্লিষ্ট ছাত্রকে সংশোধন করা এবং সঠিক পথে নিয়ে যাওয়া। তবে শিক্ষকদেরও এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে যাতে এটি কোনভাবে নির্যাতন কিংবা অমানবিক নিষ্ঠুর আচরণের পর্যায়ে না যায়। কিন্তু সরকার জাতীয় শিক্ষানীতির যে খসড়া প্রকাশ করেছে সেখানে শারীরিক কিংবা মানসিক শাস্তি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে একে শিক্ষকের জন্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে উল্লেখ করেছে।
শিক্ষা আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, শ্রেণিকক্ষে কোন শিক্ষার্থীকে শিক্ষক কর্তৃক কোন শারীরিক শাস্তি কিংবা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না। আর এ বিধান ভঙ্গকারীকে অনধিক ১০ হাজর টাকা জরিমানা কিংবা তিন মাসের কারাদ- অথবা উভয় দ-ে দ-িত করা হবে! বর্তমানে সমাজে যেভাবে অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে কিংবা সমাজ যে কারণে আজ অনৈতিক হতে বাধ্য হচ্ছে তার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকার কর্তৃক বিভিন্ন আইন অনেকাংশে দায়ী। সরকার এসব অপরাধ দমনে শিক্ষকদের শক্তিশালী না করে শিক্ষার্থীদের কেন শিক্ষকদের অপমান করার হাতিয়ার তুলে দিচ্ছে? অথবা এ ধরনের আইনের ফলে শিক্ষককে কি আর কেউ সম্মান করবে? এ আইনের দ্বারা কি পরিমল জাতীয় শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে না? এই ধরনের আইনের দ্বারা শিক্ষক তার ছাত্রকে পড়াতে হবে না, বরং ছাত্রদের দেয়া কথা সব শিক্ষককে মানতে হবে। কারণ তা না-হলে যে শিক্ষকের এমপিও বন্ধ হয়ে যাবে।
বর্তমানে শহর ছাড়াও মফস্বল-গ্রামে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবকরাও অনেক ক্ষেত্রে অসচেতন থাকে, সেক্ষেত্রে এইসব অসচেতন শিক্ষার্থীদের কীভাবে পড়ায় মনোযোগী করা হবে? যেহেতু এটি একটি সম্বনিত শ্রেণিকক্ষ থাকে তাই এসব শ্রেণিকক্ষে দুষ্ট প্রকৃতির শিক্ষার্থীদের বুঝানোর চেষ্টা করবে কে? আর বুঝানোর পরও যদি সে শিক্ষার্থী না বুঝে এবং শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের সাথে বেয়াদবি কিংবা অন্যদের ডিস্টার্ব হয় এমন কিছু নোংরা আচরণ করতে থাকে তবে শিক্ষককে তবু চুপ থাকতে হবে? শিক্ষকের ক্লাসটা তার আওতায় রাখবে কী করে? একজন কিংবা একদল শিক্ষার্থী শিক্ষকের সামনে কোন ছাত্রীকে নির্যাতন করবে তবুও শিক্ষককে চুপ থাকতে হবে! শিক্ষক সকল শিক্ষার্থীর সামনে অপমানিত হবে তবুও তাকে সব কিছুকে মুখ বুঝে সহ্য করে নিতে হবে? যেখানে শিক্ষকের কোন মূল্যায়ন থাকবে না সেখানে শিক্ষারও কোন উন্নতি হবে না আর নৈতিকতা কিংবা মূল্যবোধ সেতো আকাশ-কুসুম স্বপ্ন হয়ে যাবে। এমনও হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে যে শ্রেণিকক্ষে পাঁচ-ছয় জন একসাথ হয়ে শিক্ষকের সামনে ভারতীয় গান কিংবা পর্নোগ্রাফি দেখবে কিংবা এ বিষয়ে মন্তব্য করবে কিন্তু শিক্ষক কিছু বলার সাহস পাবে না! আবার এমনও অনেক পরিবার আছে যাদের অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে মানুষ করতে না পেরে শিক্ষকের নিকট বিচার নিয়ে আসে কিন্তু এই আইন বাস্তবায়ন হলে শিক্ষক কি বিচার করবে? জেলখানা স্কুলের নাম আমরা মোটামোটি সবাই অবগত আর এও জানি এই ধরনের স্কুল কাদের জন্য এবং কেন এই জেল স্কুল প্রবর্তন হয়েছে; যদি এই আইনটি বাস্তবায়ন হয়েই যায় তবে জেল স্কুলের ধারণা মানুষকে ভুলে যেতে হবে। আবার এমন অনেক সচিব কিংবা ঊর্ধ্বতন কর্মকতা রয়েছেন যারা তাদের এতোদূর আসার পেছনে তাদের শিক্ষকের কোন মনসিক শাস্তির কথা স্বীকার করেন! আর সবচাইতে বড় কথা হলো শিক্ষক দ্বারা কতজন শিক্ষর্থী লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে অথচ ঢাবি, শাবি, জাবি, জবি, রাবিসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নির্যাতনের খবর হরহামেশাই হচ্ছে সেদিকে লক্ষ রেখে কোন সুরক্ষা আইন নেই! শিক্ষক যদি ছাত্রের কৃতকর্মের জন্য কোন লজ্জা বা ভয় না দেখাতে পারে তবে সে শিক্ষার্থী ভালো হবে কীভাবে? অত্র আইনে এমন বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে যাতে শিক্ষার্থীর সবকিছুতেই শিক্ষককে নতি স্বীকার করে বলতে হবে জ্বি হুজুর জ্বি হুজুর!
বিশ্লেষকদের মতে, সরকার একদিকে পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার বৃদ্ধি করার তাগাদা দিচ্ছে এবং পাসের হার কম হলে সেইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শোকোজ কিংবা এমপিও বন্ধ করে দিচ্ছে; অন্যদিকে শিক্ষার্থীদেরকে পরীক্ষা কিংবা পড়ার জন্য শিক্ষকের মানসিক আঘাত দেয়াকে অবৈধ করা হয়েছে যা সত্যিই দুঃখজনক। তবে যেসব শিক্ষকেরা এ ধরনের আইন প্রণয়ন করার কথা জোরগলায় আওয়াজ তুলছে তাদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সুতরাং তারা তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে মানসিক কিংবা সীমিত শারীরিক শাস্তি বন্ধে কথা বলছে কিন্তু এসব আইন প্রণেতাদেরও অবশ্যই প্রত্যন্ত অঞ্চলে কিংবা এমপিও বন্ধের আশংকা নিয়ে ক্লাস করাচ্ছেন না অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের সকল কিছু এসব শিক্ষকদের হাতে ন্যস্ত কিন্তু স্কুল কিংবা কলেজের শিক্ষকদের নিকট পাঠদান ছাড়া তাদের কিংবা তাদের অভিভাবককে বাধ্য করার মতো কিছুই নেই! আর কোন প্রতিষ্ঠান কোন শিক্ষার্থীর উপর কঠোর হলে সেই শিক্ষার্থী অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাওয়ার আস্ফালন দেখায়! যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে একেবারেই কোন সুযোগ নেই। এ বাস্তবতায় অনেক শিক্ষক এ ধরনের আইন করার পূর্বে প্রত্যন্ত অঞ্চলে শ্রেণিক্রমে পাঠদানরত দু’একজন শিক্ষকের অন্তর্ভুক্তি খুব ভালো এবং সময়োপযোগী ফল বয়ে আনবে। আর তা না হলে সরকারের নেয়া কল্যাণকর উদ্দেশ্য ভেস্তে যেতে পারে। তাই জাতীয় শিক্ষা আইনে শ্রেণিকক্ষে মানসিক কিংবা শারীরিক শাস্তির বিষয়টি পুনরায় বিবেচনা করা উচিত। কেননা, একেবারে শাস্তি বন্ধ করে দেয়া দেশগুলোর শ্রেণি কার্যক্রম কিংবা দেশের নৈতিক মূল্যবোধের দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে শ্রেণিকক্ষে শারীরিক কিংবা মানসিক শাস্তি পুরোপুরি বন্ধ করার কারণে সেখানে অপরাধের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৪২ শতাংশ। আর শিক্ষকের সাথে অসদ্ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে ৭২ শতাংশ। আবার অনেক দেশ যেসব দেশে বর্তমানে শারীরিক কিংবা মানসিক শাস্তিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সেসব দেশের অনেকেই পুনরায় শ্রেণিকক্ষে শারীরিক কিংবা মানসিক শাস্তি চালুর চিন্তাভাবনা করছে।
সুতরাং শিক্ষক শারীরিক শাস্তি দিলে তাকে তিরস্কার করা হোক কিন্তু শারীরিকভাবে বেশি আঘাত করা যাবে না এবং শারীরিক শাস্তির একটা সীমা নির্ধারণ করা উচিত। আর মানসিক শাস্তি দিতে পারার অধিকার শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গই থাকা উচিত। কেননা, এটি না দেওয়া হলে শিক্ষককে মানা কিংবা শিক্ষক ক্লাসে শিক্ষার্থীদের কোন কিছু থেকে বিরত রাখার আর কোন হাতিয়ার থাকবে না।
ষ লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন