মুহাম্মদ আলতাফ হোসেন খান
একটি সমাজে পরিবর্তন কেন এবং কীভাবে আসে, কোন শক্তি এই সামাজিক পরিবর্তনের পেছনে কাজ করে সমাজ বিজ্ঞানীদের কাছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমাজ বিজ্ঞানীগণ বিচিত্র গবেষণা চালিয়ে এই পরিবর্তনের বহু কারণ উল্লেখ করেছেন। হযরত আলী (ক.)ও সামাজিক পরিবর্তন সম্পর্কে তাঁর মূল্যবান দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন।
নাহজুল বালাগা হযরত আলী (ক.)-এর মূল্যবান সব বক্তব্যের সংকলন। মানুষ যে সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানের গুরুত্ব সম্পর্কে ছিল অচেতন সে সময় আলী (ক.) মানুষকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিকে আহ্বান জানাতেন। তাঁর সকল জ্ঞানেরই উৎস ছিল রাসূলে খোদা তথা আল্লাহ প্রদত্ত অহি। আলী (ক.)-এর জ্ঞানের সমৃদ্ধি সম্পর্কে স্বয়ং রাসূলে খোদা (সা.) বলেছেন : ‘আমি যে জ্ঞানের নগরী আলী সেই নগরীর দরোজা।’ তাঁর সেই সমৃদ্ধ জ্ঞানদীপ্ত বক্তব্যগুলো বিধৃত রয়েছে নাহজুল বালাগায়। ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, ব্যবস্থাপনা, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি সকল বিষয়েই বক্তব্য রয়েছে এই বইতে। আলী (ক.)-এর মতে, প্রশিক্ষণ এবং পরিচালনা বলতে বোঝায় সুস্থ পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা ও তার বিকাশের পথে যেসব অন্তরায় বা বাধা রয়েছে সেসব বাধা দূর করা, যাতে মানুষ তার মেধা ও প্রতিভা নির্বিঘেœ বিকাশ করার সুযোগ পায়।
সামাজিক পরিবর্তনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ যেসব চালিকাশক্তি কাজ করে বলে সমাজ বিজ্ঞানীগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন তার মধ্যে রয়েছে আদর্শিক মতবাদ, অর্থনীতি, প্রযুক্তি, বুদ্ধিজীবী মহল এবং নেতৃত্ব। কেউ কেউ আবার প্রতিভাবানদের উপস্থিতিকে সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে বলে মন্তব্য করেছেন। আবার অনেকে বলেছেন বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিও ইতিহাস পরিবর্তনের নেপথ্য চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। এই শ্রেণির বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন আমাদের যুগে জ্ঞানের প্রাচুর্যই পরিবর্তনের উৎসে পরিণত হয়েছে। আলী (ক.)-এর মতে ইসলামের আবির্ভাবের মধ্য দিয়েই সামাজিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে এবং মানবিক উচ্চ মর্যাদা এবং মূল্যবোধের বিকাশের সূত্রপাত ঘটেছে। তিনি এক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘যখন একটি সমাজের মানুষের মাঝে আকিদা-বিশ্বাস এবং ধর্মীয় মূল্যবোধগুলোর উপস্থিতি এবং প্রবাহ থাকবে না, তখন সমাজে বিচ্ছিন্নতা দেখা দেবে।’ যেমন বিচ্ছিন্নতা বিরাজমান ছিল নবীজীর আবির্ভাবের আগে জাহেলি সমাজে।
নবীজীর আবির্ভাব হলো, জাহেলি সেই সমাজের ওপর আল্লাহর নিয়ামত বর্ষিত হলো। রাসূলে খোদা (সা.) জনগণকে এক আল্লাহর আনুগত্যের আহ্বান জানালেন। আল্লাহর দিকে দাওয়াত প্রদানের মাধ্যমে নবীকারিম (সা.) সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করলেন। ফলে আল্লাহর নিয়ামতের বিস্তীর্ণ পাখা বিস্তৃত হলো সবার মাথার ওপরে। নির্মল সুখ-শান্তি-প্রশান্তির ঝর্ণাধারা যেন বয়ে গেল সবার অন্তরের গহীনে। আসলে একটি দ্বীন হলো আদেশ-নিষেধ, হুকুম-আহকাম, আকিদা-বিশ্বাস ইত্যাদির সমষ্টি। এগুলো মানুষকে একটি আচরণবিধি দিয়ে দেয় যা একটি সমাজে শৃঙ্খলা বিধান করে। মানুষে মানুষে সম্পর্কের বিষয়টিকে ছন্দোবদ্ধ রূপ দেয়। একটি সমাজের সদস্যদের মধ্যে যারা দ্বীন থেকে দূরে অবস্থান করে তারা চিন্তাচেতনাগত দিক থেকে মানসিক অস্থিরতায় ভোগে, আত্মিকভাবে উত্তেজিত থাকে এবং কর্মকা-েও এক ধরনের বিক্ষিপ্ত অবস্থার শিকার হয়। হযরত আলী (ক.) যখন দেখলেন নিজস্ব সমাজের মানুষই অনৈক্য আর বিচ্ছিন্নতার শিকার, তখন তিনি বললেন, ‘তোমরা কেমন মানুষ! আচ্ছা এমন কোনো দ্বীন কি নেই যে দ্বীন তোমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে?’
একটি দ্বীনি সমাজে জনগণের মধ্যকার পারস্পরিক বন্ধন থাকে মজবুত ও সুদৃঢ়। সঠিক পথ এবং সুস্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে ঐ সমাজ জনগণকে সর্বপ্রকার সন্দেহ, দ্বিধা দ্বন্দ্ব, দোমনাভাবসহ সার্বিক দুর্বলতা থেকে রক্ষা করে একাত্মতার দিকে, সামাজিক মর্যাদার দিকে পরিচালিত করে। ইসলামী বিধিবিধানের আবির্ভাবের পর জনগণের মাঝে সূচিত মৌলিক পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে হযরত আলী (ক.) বলেছেন : ‘দ্বীনের কল্যাণে তাদের জীবনযাপন পদ্ধতিতে শৃঙ্খলা এসেছে। তারা একটি শক্তিশালী সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় মর্যাদার শিখরে আরোহণ করেছে। তাদের কাজকর্মগুলোও দৃঢ়তা পেয়েছে এবং তাদের সরকার শক্তিশালী হয়েছে...।’ অবশ্য একটি দ্বীনি সমাজ পরিবর্তন ও আন্দোলনের চালিকাশক্তি সম্পন্ন। তবে শর্ত হলো ঐ দ্বীনি সমাজে জনগণের মাঝে ঈমান এবং আমল বিদ্যমান থাকতে হবে। সামাজিক পরিবর্তনের আরেকটি চালিকাশক্তি হলো জনগণের মাঝে নৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলোর বিকাশ ও বিস্তার। সমাজের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যদি সদগুণাবলিতে সজ্জিত হয় তাহলে তা মূর্তমান ঐতিহ্যে পরিণত হতে পারে। এই গুণাবলি যখন সমাজের মানুষের মাঝে ব্যাপক মাত্রায় বিরাজ করে, তখন তা একটি সামাজিক আদর্শে পরিণত হয়, যার ব্যাপক প্রভাব পড়ে সর্বত্র।
এরকম একটি সমাজের লোকজনের উন্নয়নের পেছনে যে আদর্শটি বিদ্যমান ছিল তার ফলে জনগণ কেমন আদর্শ মানুষে পরিণত হয়েছিল সে সম্পর্কে হযরত আলী (ক.) বলেছেন : ‘খোদার শপথ! মানুষগুলো ছিল পবিত্র দৃষ্টিসম্পন্ন, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার গুণে গুণান্বিত, সত্যবাদী, মন্দ কাজ এবং জুলুম, অত্যাচার থেকে দূরে অবস্থানকারী, সত্যের পথে অগ্রগামী এবং দ্রুতগামী। তাই বিজয়ের মধ্য দিয়ে চিরন্তন কল্যাণ ও মর্যাদায় ভূষিত হয়েছিল।’
হযরত আলী (ক.)-এর দৃষ্টিতে যে সমাজে ঈমানের আলো এবং চারিত্রিক সৌন্দর্য প্রগাঢ় নয়, সেই সমাজের অবস্থান হয় নড়বড়ে। মানুষের মধ্যকার সম্পর্কও হয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট এবং আত্মকেন্দ্রিক। নিজস্ব স্বার্থ ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে কেউ ভাবে না। এরকম সমাজে পবিত্র মানসিকতাসম্পন্ন ভালো মানুষের সংখ্যা থাকে হাতে গোনা। সত্য কথা বলার মতো সাহসী লোকেরও অভাব দেখা দেয়। এরকম সমাজের তরুণদের মাঝে নৈতিক অবক্ষয় দেখা দেয়। যার ফলে সহিংসতাসহ সর্বপ্রকার অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে তারা। তরুণদের মাঝে পরিবর্তনের যে মনোভাব থাকা উচিত, তাদের ভেতরে নতুন সমাজ গড়ার যে স্পৃহা এবং সাহসিকতা বিরাজ করার কথা সেগুলো তাদের মাঝ থেকে উধাও হয়ে যায়। এরকম সমাজে জ্ঞানীরা হয়ে পড়েন দাম্ভিক, তারা সত্যকে চেপে যান, এই সুযোগে শাসক শ্রেণি টাকা- পয়সা দিয়ে তাদের আধিপত্য পাকাপোক্ত করে এবং অত্যাচার চালায়। এরকম সমাজে ছোটরা বড়দেরকে সম্মান করে না, সম্পদশালীরা গরিবদেরকে সাহায্য করে না।
দেশ প্রতিরক্ষায় শক্তিশালী সেনাবাহিনীও সামাজিক পরিবর্তনের অপর একটি নিয়ামক শক্তি। পৃথিবীর কোনো দেশই সম্ভবত এই সত্যটিকে এখন আর বাস্তবে অস্বীকার করবে না। কেননা সবাই দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে নিজস্ব প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলেছে। নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক শাসনও সামাজিক পরিবর্তনের মৌলিক একটি শক্তি। শাসন ক্ষমতা প্রত্যেক সমাজের ওপরই প্রভাব বিস্তার করে। জনগণের চিন্তা-চেতনার সাথে যদি শাসন ক্ষমতার মিল থাকে তাহলে সমাজে তার প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। তাই শাসন ক্ষমতার অধিকারীগণ যদি নীতি আদর্শের দিক থেকে যথাযথ হন তাহলে সমাজেরই কল্যাণ। তা নাহলে সমাজ চলে যাবে অধঃপতনের অতল গহ্বরে।
ষ লেখক : প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন