একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ের মধ্য দিয়ে দেশের বিচারিক সংস্কৃতিতে আরেকটি বড় দৃষ্টান্ত স্থাপিত হল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধিদল আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়ের সম্মুখে অনুষ্ঠিত সন্ত্রাস বিরোধি সমাবেশে ন্যাক্কারজনক গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগ নেত্রী সাবেক প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২২ জনের মৃত্যু হয়। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীসহ আহত হন আরো কয়েকশ মানুষ। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে এই সন্ত্রাসী হামলার বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে নানাবিধ রাজনৈতিক বিতর্ক, ব্লেইট গেম, দীর্ঘ বিচারিক কার্যক্রম শেষে ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুতবিচার বিশেষ আদালত মামলার রায় ঘোষণা করেন । রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজজ্জামান বাবর ও উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের ফাঁসি, বিএনপি’র সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন এবং বেশ কয়েকজন সাবেক ঊর্ধ্বতন সরকারী কর্মকর্তাসহ ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। এ ধরনের পৈশাচিক হামলার ঘটনার বিচার যেমন জাতির জন্য স্বস্তির বিষয়, তেমনি মামলার রায়ে শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাজা এবং রায়ের পক্ষে-বিপক্ষে রাজনৈতিক অবস্থান সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহে এক ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলার তদন্ত, বিচারিক কার্যক্রমে যে সব পরিবর্তন ও প্রচারনা দেখা গেছে, তাতে মামলার কার্যক্রমে সরকারী ক্ষমতা ও রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়টি অস্বীকার করা যায়না। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বিরোধিদলের সমাবেশে এ ধরনের ভয়ঙ্কর হামলায় বিরোধিদলের নেতাকর্মী হতাহতের ঘটনায় সরকারের উপর দায় চাপানোর সুযোগ আছে। বিশেষত: তদন্ত ও বিচারিক কার্যক্রমে শৈথিল্য এবং জজ মিয়া নামক এক ব্যক্তিকে ঘিরে সৃষ্ট বিতর্ক বিচার প্রক্রিয়াকে সন্দেহযুক্ত করে তোলে। এমন একটি ঘটনার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও বিতর্কমুক্ত রাখতে ব্যর্থতার দায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এড়াতে পারেন না। ঘটনা সংঘটিত হওয়ার একদিনের মধ্যেই বিচারপতি মো: জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে এক সদস্য বিশিষ্ট্য বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন নি:সন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ ছিল। তবে তদন্ত রিপোর্ট অনুসারে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনায় গরমিল ও জজমিয়া নাটকের আর্বিভাব মামলায় বিতর্কের জন্ম দেয়। একইভাবে মামলার তৃতীয় ধাপে এসে তারেক রহমানসহ বিএনপি নেতাদের অন্তভর্’ক্তি মামলাটি নতুন করে রাজনৈতিক মোড়ক লাভ করে।
নানা কারণে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, আইনের শাসন এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখন চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বিশেষত বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির সুত্রপাত সম্পর্কেও দেশে রাজনৈতিক বিতর্ক রয়েছে। একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মত ঘটনা যে কোন গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য অনেক বড় হুমকি। দেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে হত্যার চেষ্টা এবং প্রায় দুই ডজন মানুষকে হত্যার মত বর্বরতার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। গ্রেনেড হামলা মামলার প্রথম তদন্ত থেকে সর্বশেষ রায় পর্যন্ত ঘটনার সাথে বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা ও জঙ্গিবাদি গোষ্ঠির সম্পৃক্ততার কথা জানা যায়। রাজনীতিতে সন্ত্রাস-সহিংসতা এবং বিদেশীদের নেপথ্য হস্তক্ষেপ ও নির্ভরতা দেশের নিরাপত্তা ও আত্ম মর্যাদার জন্য হানিকর। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের বর্বর হত্যাকান্ডের প্রায় তিন দশক পর আরেকটি নৃশংস হামলার টার্গেট হওয়ার পরও বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায় নিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক বিতর্ক যাই থাক, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি কোনভাবেই কাম্য হতে পারেনা। প্রাথমিক রায়ে পক্ষে-বিপক্ষে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এবং উচ্চ আদালতে আপীলের ঘোষণা এসেছে। সামগ্রিক বিষয় সামনে রেখে উচ্চ আদালতে গ্রেনেড হামলার প্রকৃত অপরাধীরা যথোচিত শাস্তি পাবে, এটাই জাতির প্রত্যাশা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন