২২ সেপ্টেম্বর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নাগরিক সমাবেশে ঐক্য প্রক্রিয়া, যুক্ত ফ্রন্ট এবং বিএনপির নেতৃবৃন্দসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। লক্ষণীয় বিষয় হলো তাদের সকলের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও প্রয়োজন এক। আর সেটি হলো একটি সুন্দর নির্বাচন, যাতে মানুষ নির্ভয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ ও ভোটকেন্দ্রে গমন ও প্রত্যাশিত ফললাভ করতে পারে। প্রায় দশ বছরের দুঃশাসনে মানুষ অতিষ্ট। দলমত নির্বিশেষে সব মানুষ নিজেদের স্বাধীনতা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। সেদেশের নাগরিক সমাবেশে বক্তারা প্রায় সমস্বরে অত্যাচার, নির্যাতন ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহবান জানান। ঘোষণাপত্রে ন্যায় বিচারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে অন্যায়ভাবে কারারুদ্ধ সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার আইনগত ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়। কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী ছাত্র-ছাত্রীসহ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দাবি করা হয়। এখন থেকে নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো নেতাকর্মীকে গ্রেফতার না করার দাবিও জানানো হয়। দাবিগুলো খুবই যৌক্তিক, যা বাস্তাবায়ন করে দেশকে শান্তির পথে ফেরানো উচিত বলে আমরা মনে করি। খালেদা জিয়া যে মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, দেড়মাস পরে হলেও তার জামিন মঞ্জুর করা হয়েছে। অবশ্য দেশে আইনের শাসন থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যে জামিন হবার কথা ছিল। কিন্তু সুশাসনের অভাবে জামিন পেতে দেড় মাস সময় লেগেছিল। আশা ছিল, তিনি জামিনে মুক্ত হয়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবেন। কিন্তু তিনি আজও কারাগারে বন্দি। শ্যোন এরেস্ট দেখিয়ে একের পর এক মামলায় তাঁকে আটকে রাখা হয়েছে। এসব মামলায় তাঁকে আটকে রেখে সরকার মানবাধিকার লংঘন করে চলেছে। নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালতে বিএনপির আইনজীবীরা দৌড়ঝাপ করেও কূলকিনারা করতে পারছেন না। প্রখ্যাত ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সত্যিই বলেছেন, আইনী প্রক্রিয়ায় বেগম জিয়াকে মুক্ত করা যাবে না। আন্দোলন সংগ্রাম করে তাঁকে মুক্ত করতে হবে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও কোটা সংস্কার আন্দোলন কোন রাজনৈতিক বিষয় নয়। অথচ এসব আন্দোলন কী নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে দমন করা হলো, দেশবাসী তা প্রত্যক্ষ করেছে। ছেলেদের ওপর হেলমেটধারীদের তান্ডব দেখে মানুষ হতবাক ও বিস্মিত হয়েছে। নিরাপরাধ আন্দোলনকারীদের অনেককে গ্রেফতার করে, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে সরকার নিন্দা ও ধিক্কার কুড়িয়েছে।
বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, নিপীড়ন করা এখন অতি সাধারণ ঘটনা। গত ১ সেপ্টেম্বরে বিএনপির সমাবেশে লক্ষ লক্ষ লোকের উপস্থিতি দেখে সরকার দিশেহারা হয়ে নব উদ্যোমে ভৌতিক মামলা দিয়ে যাচ্ছে। এ ক’দিনে বিএনপির কয়েক লাখ নেতাকর্মী গ্রেফতার ও হাজার হাজার মামলা দেয়া হয়েছে যা সত্যিই অবাক করার মতো। মৃত মানুষকে আসামী করা হয়েছে। হজ্জ্বব্রত পালনকারীকেও ছাড় দেওয়া হয়নি। যার গায়ে বিএনপির গন্ধ আছে তার নিস্তার নাই। এভাবে মামলা-হামলা করে বিএনপি নেতাকর্মীকে ব্যতিব্যস্ত রেখে ৫ জানুয়ারি মার্কা প্রহসনের নির্বাচন সেরে নেবার পাঁয়তারা করছে সরকার। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নাগরিক সমাবেশে এসব অনিয়ম ও দুঃশাসনের প্রতিকার চাওয়া হয়েছে। সমাবেশে যেসব গুণীব্যক্তি উপস্থিত হন, তাঁরা দেশবাসীর অত্যন্ত সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব। দেশবাসী তাঁদের সম্মান ও শ্রদ্ধা করে। তাঁদের বোধশক্তি, বিবেচনা শক্তি ও কর্মদক্ষতায় দেশবাসীর চরম আস্থা রয়েছে। দেশবাসী বিশ্বাস করে এসব ব্যক্তি নিশ্চয় একটি সমাধান বের করে আনতে পারবেন।
সরকার অবশ্য তাঁদের কর্মকান্ডকে সুনজরে দেখছে না। সরকার তাঁদের কর্মকান্ডের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের গন্ধ পাচ্ছেন। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এসব নেতার তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে বিএনপির ক্ষতির আশংকা ব্যক্ত করছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ ঐক্য প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে বলেছেন, জনসমর্থনহীন অজনপ্রিয় এসব নেতার সাথে থেকে বিএনপি আরও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। বলাই বাহুল্য, বিএনপি ক্ষতিগ্রস্থ হবে না লাভবান হবে তা জনগণ নির্ধারণ করবে। ড. কামাল হোসেন, বি. চৌধুরীর সাথে জনগণ নাই একথার প্রমাণ কী? দেশের এই ভয়াবহ সংকটকালে ড. কামাল হোসেন, বি. চৌধুরী, আ স ম আব্দুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখ নেতার জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থনের অভাব হবে না। দেশের এতবড় সংকটকালে জাতিকে রক্ষার ব্রত নিয়ে যেসব নেতা এগিয়ে এসেছেন তাদেরকে জাতি ভুলবে না। ড. কামাল হোসেন ও ডা. বদরুদ্দোজা নৈতিক বাধ্যতাবোধ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতীয় কর্তব্য পালনে এগিয়ে এসেছেন। সরকারি তরফ থেকে তাঁরা ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। ড. কামাল হোসেন, ডা. বদরুদ্দোজা স্বস্ব ক্ষেত্রে খুবই স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। তাদেরকে নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য না করে সরকারের উচিত ঐক্য প্রক্রিয়ার দাবি দাওয়ার প্রতি সম্মান জানিয়ে সকল রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা শুরু করা। একটি প্রবাদ আছে, সিকির মতো সিকি হলে দুই সিকিতেই টাকা। ড. কামাল হোসেনরা হাজার হাজার জন্মান না। তারা ক্ষণজন্মা এবং জাতিকে উন্নয়ন, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি ও আলোর পথ দেখান। তাঁদের কাজকে যথাযথ গুরুত্ব ও মর্যাদা দেয়া উচিত। দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ড. কামাল হোসেন যথার্থই বলেছেন, আমরা ক্ষমতার রাজনীতি করি না। আমরা জনগণের ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী। জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়াই আমাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য। আমরা জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে চাই। তিনি আরও বলেছেন, বাংলাদেশ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ইতিহাস যেমন আছে, গণতন্ত্রকে হত্যা করে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করার ইতিহাসও আছে। তিনি অবাধ লুটপাট, যেমন প্রকল্পের নামে জনগণের টাকা অপচয়, ব্যাংক লুট, শেয়ার বাজার লুট, অর্থনৈতিক বৈষম্য, জনশক্তি রফতানি হ্রাস, বিনিয়োগে ভাটা প্রভৃতি বিষয় উল্লেখ করে ঐক্য প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিএনপি তথা ২০ দলীয় ঐক্যজোটেরও লক্ষ্য হলো জনগণের ভোটাধিকার জনগণকে ফিরিয়ে দেওয়া। তার জন্য ১০ বছর ধরে খালেদা জিয়া ও ২০ দলীয় জোট সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। ‘৯০ এ সৈরাচার হটিয়ে বেগম জিয়া যে, গণতান্ত্রিক আবহ ও ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন তা আজ বহুদূরে। গণতন্ত্রের প্রতীক বেগম জিয়া যে কোন মূল্যে ঐক্য প্রক্রিয়াকে বেগবান ও কার্যকর করার পক্ষে। তিনি দেশে গণতন্ত্র দেখতে চান। ড. কামাল হোসেনও জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য ঐক্য প্রক্রিয়া জোরদার করার পক্ষে। প্রশ্ন হলো, সকলে যেখানে একমত, সেখানে ঐক্য প্রক্রিয়ায় বাধাটা কোথায়?
স্বাধীনতার স্বপক্ষের ঐক্য হলে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান হবে বলে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। ঐক্য প্রক্রিয়া গঠন ও বিএনপির ৩০ সেপ্টেম্বরের জনসভার পর থেকে সরকারের কাঁপুনি শুরু হয়েছে বলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, রিজভী মন্তব্য করেছেন। ঐক্য প্রক্রিয়া স্লোগান ছিল ‘নবীন প্রবীণ আয়রে ভাই, দেশবাঁচাতে ঐক্য চাই’। জাতীয় ঐক্য এ মুহূর্তে খুবই আবশ্যক। জামায়াত কোনো বাধা হতে পারে না। জামায়াত নিবন্ধিত দল নয়। বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে হবে এমন দাবি কেবল অযৌক্তিক নয়, অনৈতিকও বটে। বিএনপি কার সাথে নির্বাচনী কৌশল করবে, সেটি কেউ চাপিয়ে দিতে পারে না। জামায়াত অবশ্য জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেনি। তাদের কারণে ঐক্য প্রক্রিয়া যেন ব্যাহত না হয় সে বিষয়টি তারা পরিষ্কার করেছে। অতএব, বৃহত্তর ঐক্যের ক্ষেত্রে জামায়াত কোনো অন্তরায় নয়।
দেশ বর্তমানে বহুমুখী সংকটে নিপতিত। দেশে আইনের শাসন, জবাবদিহিতা, দায়বদ্ধতা, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা, প্রশাসন ও আইনশৃংখলা বাহিনীর পক্ষপাতিত্ব এবং সরকারের উদারতার অভাব প্রকটভাবে অনুভূত হচ্ছে। লুটপাট, চৌর্যবৃত্তি, জালিয়াতি, খুন, জখম, গুম, রাজনৈতিক মামলা দিয়ে বিরোধীদল দমন প্রভৃতি কর্মকান্ডের অবসান হওয়া দরকার। সরকার ক্ষমতার মোহে পড়েছে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরে সরকার ভয় পাচ্ছে। সেকারণে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় গঠিত সর্বদলীয় মোর্চা পারবে এ সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করতে। শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সম্মিলিত চাপই পারবে দেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধানে কার্যকর ও ফলপ্রসূ বাস্তব ফলাফল আনতে।
লেখক: প্রফেসর, দশর্ন বিভাগ ও সাবেক ডিন, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন