মোহাম্মদ আবদুল গফুর : গতকাল (বুধবার) অনেকটা অনেকের অজ্ঞাতেই পার হয়ে গেল আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এমন এক কিংবদন্তি পুরুষের মৃত্যুবার্ষিকী, যাঁর জন্ম না হলে আজ যে আমরা বাংলাদেশ নামের এক স্বাধীন রাষ্ট্রের গর্বিত নাগরিক, সে রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের কথা কল্পনা করাও সম্ভব হতো না। তাঁর পুরো নাম আবুল কাসেম ফজলুল হক, সংক্ষেপে এ কে ফজলুল হক। শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কাছে তিনি ‘শেরেবাংলা’ নামে বিশেষভাবে পরিচিত হলেও বাংলার আপামর জনসাধারণের কাছে তাঁর প্রধান পরিচয় ‘হক সাহেব’ হিসেবে।
জাতীয় জীবনে ফজলুল হকের অবদান সম্যক অনুধাবন করতে হলে যে সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে তাঁর জন্ম, সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা অপরিহার্য। ১৭৫৭ সালে পলাশী বিপর্যয়ের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা-সূর্য অস্ত যাওয়ার পর নব্য শাসকদের অন্যতম নীতিই হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, জমিদারি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি জাতীয় জীবনের প্রতিটি গরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হতে বেছে বেছে মুসলমানদের উৎখাত করে সেসব স্থানে ইংরেজ-অনুগত হিন্দুদের বসানো। পলাশী বিপর্যয়ের মাত্র সাড়ে তিন দশকের মধ্যে ১৭৯৩ সালে পূর্বতন ভূমি-ব্যবস্থা “বদলিয়ে চিরস্থায়ী ব্যবস্থার” মাধ্যমে এমন একদল ইংরেজ-অনুগত নব্য জমিদার গোষ্ঠী গড়ে তোলা হয়, যার সিংহভাগই ছিল হিন্দু। ফলে অল্পদিনের মধ্যে এককালের সমৃদ্ধ মুসলিম সম্প্রদায় এক অসহায় নিঃস্ব জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়।
মুসলমানরাও কিছুতেই বিদেশি ইংরেজদের শাসনকে সহজভাবে মেনে নিতে পারছিলেন না। তারা পলাশীর পর একশ বছর পর্যন্ত স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকেন। এসব সংগ্রামের মধ্যে ছিল: মজনু শাহের নেতৃত্বাধীন ফকির বিপ্লব, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার সংগ্রাম, শরীয়তুল্লাহ-দুদুমিয়ার নেতৃত্বাধীন ফরায়েজী আন্দোলন ছাড়াও ত্রিপুরার শমশের গাজী, সন্দ্বীপের আবু তোরাব, রংপুরের নুরুদ্দিন প্রমুখ কৃষক নেতার সশস্ত্র সংগ্রাম ও নীল চাষিদের আন্দোলন এবং সর্বশেষে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ। কিন্তু বৃহৎ প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের অসহযোগিতার কারণে স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে পরিচালিত এসব সশস্ত্র সংগ্রাম ব্যর্থ হয়। মুসলমানদের এসব স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্যর্থ হওয়ায় একশ্রেনীর হিন্দু বুদ্ধিজীবী উল্লাসে ফেটে পড়েন। এদের মধ্যে ছিলেন সাহিত্য স¤্রাট বঙ্কিম চন্দ্র, কবি ঈশ্বরগুপ্ত প্রমুখ।
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার ফলে মুসলমানদের ওপর নতুন করে নির্যাতনের ষ্টীম রোলার চালানো শুরু হয়। এ পরিস্থিতিতে তদানীন্তন উত্তর ভারতের সৈয়দ আহমদ খান, বাংলার নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখ মুসলিম নেতৃবর্গ সাময়িকভাবে হলেও শাসক ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের মত আধুনিক শিক্ষা ক্ষেত্রে মুসলমানদের এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যান। এই সহযোগিতা যুগের এক পর্যায়ে প্রধানত প্রশাসনিক কাজের সুবিধার লক্ষ্যে ১৯০৫ সালে তদানীন্তন বাংলা-বিহার উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত বিশাল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে বিভক্ত করে ঢাকা রাজধানীসহ ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামে একটি নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়। এতে দীর্ঘ অবহেলিত পূর্ববঙ্গের উন্নতির কিঞ্চিৎ সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় পূর্ববঙ্গের নেতৃবৃন্দ একে স্বাগত জানান। কিন্তু কলকাতা-প্রবাসী হিন্দু জমিদাররা এতে পূর্ববঙ্গে অবস্থিত তাদের জমিদারির ওপর তাদের প্রভাব হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কায় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বিরাট আন্দোলন গড়ে তোলেন। যে হিন্দু নেতৃবৃন্দ পলাশীর পর থেকে সবসময় ইংরেজদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এসেছেন, তাদের এ আকস্মিক রুদ্র মূর্তি ইংরেজ শাসকদের বিস্মিত ও হতবাক করে তোলে। ফলে মাত্র ছয় বছরের মাথায় বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করে কলকাতা-প্রবাসী হিন্দু জমিদারদের মনস্তুষ্টি সাধনের চেষ্টা চালায় সরকার। ইংরেজ সরকারের এ ঘোষণায় খুশি হয়ে ইংরেজ স¤্রাটের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে রবীন্দ্রনাথ একটি গান রচনা করেন যার অংশবিশেষ নি¤œরূপ :
‘জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে
ভারত ভাগ্য বিধাতা।’
বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ায় খুশি হতে পারেননি তদানীন্তন পূর্ববঙ্গের অবিসংবাদিত নেতা নবাব সলিমুল্লাহ। তিনি ছিলেন মুসলমানদের সহযোগিতা-যুগের অন্যতম শেষ নেতা। তাঁকে খুশি করতে ইংরেজ সরকার তাঁর অন্যতম দাবি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ওয়াদা ঘোষণা করে। এতে অসন্তুষ্টি হন হিন্দু নেতৃবৃন্দ। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তাদের যুক্তি ছিল, বঙ্গবঙ্গের ফলে নাকি বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদের মতো পাপ হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে এবার তাদের যুক্তি হলোÑ এর দ্বারা বঙ্গ-সংস্কৃতি বিভক্ত করা হবে। তবে এটা যে তাদের আসল যুক্তি নয়, তা প্রকাশ পেয়ে গেল তাদের অপর এক ব্যাখ্যায়। যাতে বলা হলো : পূর্ববঙ্গের জনগনের অধিকাংশই মুসলমান চাষাভুষা, তাই তাদের উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ যারা অশিক্ষিত চাষাভুষা আছে তারা অশিক্ষিত চাষাভুষাই থাকুক। তাদের শিক্ষা বা উচ্চশিক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রতিবেশী সমাজের বাধাদানের ফলে ১৯১১ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াদা বাস্তবায়িত হতে ১০ বছর পিছিয়ে যায়। নবাব সলিমুল্লাহ তার স্বপ্ন অপূরিত থাকার এক বুক বেদনা নিয়ে ১৯১৫ সালে ইন্তেকাল করেন। সলিমুল্লাহর অবর্তমানে ১৯২১ সালের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় যাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় তারা হচ্ছেন সলিমুল্লাহর দুই সহযোগী নবাব আলী চৌধুরী ও এ কে ফজলুল হক।
আগেই বলেছি সিপাহি বিদ্রোহের ব্যর্থতার পটভূমিতে মুসলমানদের একটা সংক্ষিপ্ত সহযোগিতা-যুগ এসেছিল। সলিমুল্লাহর মতো সেই সহযোগিতা যুগের অন্যতম নেতা ছিলেন নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সহযোগিতা যুগের অবসানে প্রথম সংগ্রামী জননেতাই ছিলেন এ কে ফজলুল হক।
ফজলুল হকের জন্ম ১৮৭৩ সালে বরিশাল জেলার সাতুরিয়া গ্রামে তাঁর মাতুলালয়ে। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল একই জেলার চাখার। শিক্ষা জীবনে আগাগোড়া মেধাবী ছাত্র ফজলুল হক ১৮৯৫ সালে গণিত শাস্ত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। অতঃপর ১৮৯৭ সালে ডিস্টিংশন-সহ বিএল পাস করে তিনি প্রথমে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অধীনে শিক্ষানবিস এবং শিক্ষানবিসী শেষে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। এর পর একপর্যায়ে বরিশাল জজকোর্টে আইন-ব্যবসার পাশাপাশি সাপ্তাহিক ‘বালক’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এ সময় তিনি বরিশাল মিউনিসিপ্যালিটির সদস্যও নির্বাচিত হন।
১৯০৬ সালে ঢাকায় যে নিখিল ভারত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তার প্রস্তুতি কমিটির যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ফজলুল হক। নবাব সলিমুল্লাহর প্রতিনিধি রূপে ঐ সম্মেলনের ব্যাপারে সমগ্র উপমহাদেশ ভ্রমন করে মুসলিম নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দেশের পরিস্থিতি ও তাদের করণীয় সম্পর্কে আলোচনার সুযোগ পান। ১৯০৬ সালে ঐ শিক্ষা সম্মেলনের শেষ পর্যায়ের এক বিশেষ অধিবেশনেই গঠিত হয় উপমহাদেশীয় মুসলমানদের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক সংগঠন নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। সেই নিরিখে ফজলুল হক ছিলেন ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ এই রাজনৈতিক সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, পরবর্র্তীকালে যিনি এই মুসলিম লীগের অবিসংবাদিত নেতা রূপে আবির্ভূত হন সেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকেও ১৯০৬ সালের এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তখন তিনি কংগ্রেসের বাইরে অন্য কোনো সংগঠন প্রতিষ্ঠা স্বাধীনতা আন্দোলনে অনৈক্য সৃষ্টি ঠিক হবে না বিবেচনায় ওই সম্মেলনে যোগদান করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন।
মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠার পর এই সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হয়েও ১৯০৬ সাল থেকে কিছু দিন ফজলুল হক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি করেন। ১৯১১ সালে তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। অতঃপর সলিমুল্লাহর আহ্বানে ১৯১২ সালে তিনি পুনরায় রাজনীতিতে যোগদান করেন। ১৯১৩ তিনি সালে ঢাকা বিভাগীয় কেন্দ্র থেকে উপনির্বাচনে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। একই বছর তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নিখিল ভারত মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯১৫ সালে তিনি তার জীবনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য কৃষক প্রজা আন্দোলন শুরু করেন। ১৯১৮ সালে তিনি একই সাথে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এসব ঘটনা প্রমাণ করে রাজনীতি ক্ষেত্রে তার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা কত ব্যাপক ছিল।
রাজনীতি ক্ষেত্রে বাস্তবতা বিবেচনাকে ফজলুল হক সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। ১৯২০ সালে কলকাতায় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ও খেলাফত সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেন। কংগ্রেসের সঙ্গে তার রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও তিনি কংগ্রেসের অন্যান্য নেতার সুরে সুর না মিলিয়ে এই উভয় সম্মেলনে তিনি ছাত্রদের স্কুল-কলেজ বর্জনের কংগ্রেসি আহ্বানের প্রকাশ্য বিরোধিতা করেন। কারণ তিনি মনে করতেন, এতে করে শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা মুসলমানদের চরম ক্ষতি হবে। ১৯২২ সালে তিনি খুলনার উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সঙ্গে বিখ্যাত ‘বেঙ্গল অ্যাক্ট’ স্বাক্ষর করেন এবং ১৯২৪ সালের ১ জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হন। পরে ওই বছরের জুনে কংগ্রেস আইন সভা বর্জন করায় তাকে শিক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে পদচ্যুত হতে হয়। কিন্তু ওই ছয় মাসের মন্ত্রিত্বকালেই তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠার মতো ঐতিহাসিক কার্য সম্পন্ন করেন।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন গৃহীত হওয়ার ফলে বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রাদেশিক সরকারের আওতাধীনে আসে। ১৯৩৭ সালের ১ এপ্রিল মুসলিম লীগ ও তাঁর কৃষক প্রজা কোয়ালিশন সরকার হলে তিনি প্রাদেশিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন। এ সময়ে ১৯৩৮ সালে ঋণ সালিশী বোর্ড, ১৯৩৮ সালে প্রজাতন্ত্র আইন পাস করে বাংলার কৃষক সমাজকে জমিদার ও সুদখোর মহাজনদের শোষণ থেকে মুক্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন। এসব ঘটনা প্রমাণ করে সুযোগ আসা মাত্র দ্রুতগতিতে সাধারণ মানুষের কল্যাণে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ ছিল তার জীবনের অন্যতম নীতি। শুধু জনকল্যাণমূলক আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে নয়, বাগ্মী হিসেবেও তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। এর অন্যতম কারণ ছিল জনকল্যাণে তার গভীর আন্তরিকতা। আন্তরিক অনুভূতির কারণে তার বাগ্মিতা দিয়ে তিনি সহজে জনগণের হৃদয় স্পর্শ করতে পারতেন। ১৯৩৪ সালের অক্টোবর মাসে লক্ষেèৗতে মুসলিম লীগের সম্মেলনে তার উদ্দীপনাময়ী বাগ্মিতায় মুগ্ধ হয়ে জনগণের পক্ষ থেকে তাকে ‘শেরেবাংলা’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সেই থেকে তার আসল নাম চাপা পড়ে তিনি শেরেবাংলা নামেই পরিচিত হতে থাকেন।
১৯৪০ সালের নিখিল ভারত মুসলিম লীগের লাহোরে অনুষ্ঠিত যে অধিবেশনে স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তিরূপী ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয় সে সময় শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের জনপ্রিয় নেতা। ওই অধিবেশনে মূল প্রস্তাব উত্থাপনের ভার পড়েছিল শেরেবাংলার ওপর। এ মহতী দায়িত্ব পালনে ফজলুল হক মঞ্চে উঠে দাঁড়ালে জনগণের মধ্য হতে এমন ভাবে মুহূর্মুহু শেরেবাংলা জিন্দাবাদ স্লোগান ওঠা শুরু করে যে অধিবেশনের স্বাভাবিক কাজকর্ম এগিয়ে নেয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। ফলে অধিবেশনে সভাপতির চেয়ার থেকে জিন্নাহ সাহেব বলতে বাধ্য হন আপনাদের শেরেবাংলাকে শান্তিপূর্ণভাবে তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে দিন। নইলে তার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা হবে। এর পর জনতা শান্ত হয় এবং শেরেবাংলা কর্তৃক ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উন্থাপিত হলে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
এই লাহোর প্রস্তাবের কোথাও পাকিস্তান শব্দের উল্লেখ না থাকলেও পরদিন হিন্দু সংবাদপত্রগুলো “পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত” শিরোনামে খবরটি ছাপে। পরবর্তীতে এই লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের আন্দোলন পাকিস্তান আন্দোলন নামেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য যে ১৯৪৭ সালের এই প্রস্তাবের আংশিক বাস্তবায়ন এবং ১৯৭১ সালে বাকি অংশ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্ভব হয়।
পাকিস্তান আন্দোলন চলাকালে ১৯৪২ সালে এক পর্যায়ে শেরে বাংলা মুসলিম লীগ পরিত্যাগ করেন। ফলে ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে তার দলের শোচনীয় পরাজয়বরণ হয়ে পড়ে করুন বাস্তবতা, যদিও তিনি ব্যক্তিগতভাবে আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হতে সক্ষম হন। পরবর্তীকালে তিনি মুসলিম লীগে তাকে পুনঃ গ্রহণের আবেদন জানালে তাকে মুসলিম লীগে ফিরিয়ে আনা হয়।
ফজলুল হক বিশেষ পরিস্থিতিতে জীবনে কিছু কিছু ভুল করলেও দীর্ঘ জীবনের সিংহভাগ কেটেছে এদেশের দুঃখী মানুষের মুক্তি ও কল্যাণ সাধন। বিশেষ করে ইসলামিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা, ঋণ সালিশী বোর্ড, প্রজাস্বত্ব আইন, লাহোর প্রস্তাব প্রভৃতি ছিল লাল হরফে লিখে রাখার মতো কিছু ঐতিহাসিক কীবির্ত, যা জাতি আজীবন স্মরণ রাখবে।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর মুসলিম লীগ যখন বৃহত্তর জনগণের সাথে সম্পর্কবিহীন একটি পকেট প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় তখন তার নেতাদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় জনগণের ওপর অত্যাচার চালিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা। তখন ১৯৫৪ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে লীগবিরোধী যে যুক্তফ্রন্ট গড়ে ওঠে, তাতে সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, মওলানা আতাহার আলী প্রমুখ আরও অনেক নেতা থাকলেও সে নির্বাচনে জনগণ একচেটিয়া যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে প্রধানত শেরেবাংলার কথায়। এমন কি শেখ মুজিবের মতো নেতা পরবর্র্তীকালে কল্পনাতীত জনপ্রিয়তা অর্জন করেন, তাকেও ‘শেরেবাংলার লোক’ পরিচয়ে ভোট পেতে হয়।
সেই নিরিখে বলা যায়, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম গণমুখী জননেতা। তাঁর জীবন ও কীর্তি থেকে এ যুগের নেতাদের শিক্ষা গ্রহণের অনেক কিছু রয়েছে। আজ যদি বাঙালি মুসলমানের জাগরণের অতীত ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যায় তা হলে দেখা যায়, সেই ইতিহাসে এমন একটা পর্যায় ছিল, যখন বাঙালি মুসলমানের কোনো জনসভায় আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে গাওয়া জাতীয় কবি নজরুলের জাতি জাগানিয়া গান এবং শেরেবাংলার ওজস্বিনী বক্তৃতা ছাড়া কোন জনসভাই জমে উঠত না। এতেই বোঝা যায় আমাদেও জাগরণের ইতিহাসে শেরেবাংলার অবদান। জাতির জীবনে শেরেবাংলার এই ঐতিহাসিক অবদানকে ভুলে যাওয়া বা অবমূল্যায়ন করা হবে মহাঅপরাধের শামিল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন