পরিচয়: বারো আউলিয়ার পূণ্যে ভূমি হিসেবে খ্যাত চট্রগ্রামে শাহানশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী (ক.) ১০ পৌষ, ১৩৩৫ বঙ্গাব্দ; ১২ রজব, ১৩৪৭ হিজরী এবং ২৫ ডিসেম্বর, ১৯২৮ সাল রোজ মঙ্গলবার সুবহে সাদেকের সময় মাইজভান্ডার দরবার শরীফ, ফটিকছড়ি, চট্রগ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। ১৯৮৮ সালের ১২ অক্টোবর রোজ বুধবার দিবাগত রাত ১২ টা ২৭ মিনিটে চট্রগ্রাম শহরের বন্দর হাসপাতালে ইহলোক ত্যাগ করেন। হযরত জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী (ক.) হলেন অছিয়ে গাউছূল আজম খাদেমুল ফোকরা শাহ সূফী হযরত সৈয়দ দেলোয়ার হোসাইন মাইজভান্ডারী (ক.) জোষ্ঠ্য পুত্র এবং গাউছ‚ল আজম হযরত গোলামুর রহমান মাইজভান্ডারী (ক.) এর দৌহিত্র। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয়েছিল বদিউর রহমান। তাঁর নাম রাখার কয়েক দিন পর মাইজভান্ডারীয়া ত্বরিকার প্রধান পুরুষ গাউছূল আজম হযরত মাওলানা শাহ সূফী সৈয়দ আহম্মদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.) কর্তৃক স্বপ্নে নির্দেশিত হয়ে বদিউর রহমান নাম পরিবর্তন করে জিয়াউল হক রাখা হয়। জিয়াউল শব্দের অর্থ হলো আলো এবং হক শব্দের অর্থ হলো সত্য। জিয়াউল হক শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো সত্যের আলো। শাহানশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী (ক.) সত্যিকারের জ্যোতি হিসেবে ধরাধামে এসেছিলেন।
কঠোর রিয়াজত: কোরআনে এরশাদ হয়েছে,‘হে মানুষ তুমি তোমার রবের নিকট পৌছানো পর্যন্ত কঠোর সাধনা করতে থাকো। পরে তুমি তাহার সাক্ষাৎ লাভ করিতে পারিবে।’ (সূরা ইনশিকাফ, আয়াত:৬)। হযরত জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী (ক.) দুনিয়াবি ভোগ বিলাস মাটির ধুলোয় মিশিয়ে কঠোর ত্যাগ ও সাধনার জীবন অতিবাহিত করেছেন। মনীষীরা বলেছেন ‘এমন জীবন হবে করিতে গঠন, মরিলে হাসিবে তুমি, কাঁদিবে ভুবন।’ শাহানশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী (ক.) কঠোর রিয়াজতের মাধ্যমে ফানাফিল্লাহ ও বাকাবিল্লাহর স্তরে পৌঁছে ছিলেন। তিনি মাঝে মধ্যে একাধারে ৮/১০ দিন ঘরের দরজা খুলতেন না। হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যেতেন। কাউকে না বলে হঠাৎ মাইজভান্ডার থেকে পায়ে হেঁটে চট্রগ্রাম শহরের বিভিন্ন জায়গায় চলে যেতেন। পৌষ মাঘের কন কনে শীতের মধ্যে বাড়ির আন্দির পুকুরে দিনের পর দিন ডুবে থাকতেন। কবি নজরুল যথার্থই বলেছেন, ‘তুমি বুঝিবেনা হায়, আলো দিতে পোড়ে কত প্রদীপের প্রাণ।’
হালালের উপর গুরুত্ব প্রদান : শাহানশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী (ক.) এর বাণী ছিল, “হালাল খাও, নামাজ পড়, আল্লাহ আল্লাহ জিকির কর, সব সমস্যা মিটে যাবে”। ইবাদত কবুলের পূর্ব শর্ত হলো হালাল রুজি খাওয়া। হালাল রুজি না খেলে আমল ইবাদত কবুল হয় না। এছাড়া আত্মার পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রে হালাল রুজি খাওয়া অত্যন্ত জরুরি। কোরআনেও হালাল খাবারের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
নামাজ ও জিকিরে প্রতি তাগিদ দেয়া: শাহানশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী (ক.) নামাজ পড়া ও আল্লাহর জিকির করার জন্যে তাগিদ দিতেন। কেউ সুস্থতার জন্য দোয়া চাইতে গেলে বলতেন, ‘নামাজ পড়েন সব ঠিক হয়ে যাবে।’ হৃদরোগের সুস্থতার জন্য দোয়া চাইলে সূরা ইয়াছিন তেলাওয়াতের নির্দেশ দিতেন।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য: হযরত জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী (ক.) এর চরিত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিলো রাসূল (সা) এর আদর্শকে যথাযথভাবে অনুসরণ করা। তিনি নির্বিলাশ সাদাসিদে জীবন যাপন করেছেন। তাঁর মতো বিনয়ী ও উদার প্রকৃতির মানুষ কমই দেখা যায়। পার্থিব জীবনের চেয়ে পরকালীন জীবনকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করেছেন। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে পরকাল ছেড়ে পৃথিবীতে মশগুল রয়েছে। তার জন্য পরকালে কঠিন শাস্তি আর বিশ্বাসীদের জন্য রয়েছে আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুুষ্টি। পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ বিলাশ ছাড়া কিছুই নয়।’ (সূরা হাদীদ : ২০ )। শাহানশাহ সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী (ক.) এর জীবনে পার্থিব মোহ লোভ লালসা বলতে কিছুই ছিল না। তিনি বলতেন, ‘নিজের ভিতর দৃষ্টি দাও, বহির্জগতের চেয়েও অপরূপ সুন্দর দৃশ্যাবলী দেখতে পাবে।’
শিক্ষা কার্যক্রম: দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শাহানশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী (ক.) ট্রাস্ট নিয়ন্ত্রণাধীন ২৩টি স্কুল ও মাদরাসায় ২৯৪২জন ছাত্র-ছাত্রী পড়াশুনা করছেন।
বৃত্তি তহবিল: চট্রগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালনাধীন উচ্চ বিদ্যালয় সমূহ ও চসিক ৭ ও ৮ নং ওয়ার্ড এর প্রান্তিক এলাকা সম্পৃক্ত করে শিক্ষামূলক কর্মকান্ডে এ পর্যন্ত ৭৩৫ জন দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীকে ২১ লক্ষ টাকা প্রদান করা হয়েছে।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ: ট্রাস্টের নিয়ন্ত্রণাধীন ২৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জ্ঞান ও শিক্ষা দানের আধুনিক কলা-কৌশল শিক্ষা প্রদানের লক্ষে এ পর্যন্ত ২৫০ জন শিক্ষককে সৃজনশীল পদ্ধতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য সেবা: মাইজভান্ডার দরবার শরীফ হোসাইনী দাতব্য চিকিৎসালয় অসহায় ও দু:স্থ ব্যক্তিবর্গের বহি:বিভাগীয় চিকিৎসা সেবায় বিনামূল্যে চক্ষু অপারেশনসহ ৩২ হাজার রোগীকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। পাইলট প্রকল্প-১ এর অধীনে সৈয়দ নুরুল বখতেয়ার শাহ দাতব্য চিকিৎসালয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণের মাধ্যমে নারী, শিশু ও প্রসূতি মায়ের বিনামূল্যে ঔষধসহ নিয়মিত চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়।
দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প: দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষে শাহানশাহ হযরত ছৈয়্যদ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী (ক.) ট্রাষ্টের যাকাত তহবিল গঠন করা হয়েছে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকল্পে ১৫৬৪ জনকে ৩,৮৭,৪৪,৯৩০/- টাকা বিতরণ করা হয়েছে। পাইলট প্রকল্প-২ এর অধীনে সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে দক্ষ নারী উন্নয়ন কর্মসূচীর অধীনে ১০টি সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
গবেষণা ও প্রকাশনা: বাংলায় প্রকাশিত তাসাউফ বিষয়ে বহুমূখী গবেষণা ও বিশ্লেষণমূলক জার্নাল ‘মাসিক আলোকধারা’ নিয়মিত প্রকাশিত হয়। ট্রাস্টের প্রকাশন ‘আলোকধারা বুকস’ কর্তৃক ২০টি বই প্রকাশ হয়েছে।
উরস ও খোশরোজ: কবি নজরুল এর ভাষায়,‘ আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভূলিতে।’ প্রতি বছর ২৬ আশ্বিন বার্ষিক উরস শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। ১০ পৌষ পবিত্র খোশরোজ শরীফ উদযাপিত হয়। দেশ বিদেশের অসংখ্য ভক্ত আশেকান শাহানশাহ হযরত ছৈয়্যদ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী (ক.) এর উরস ও খোশরোজ শরীফে যোগদানের উদ্দেশ্যে মাইজভান্ডার দরবার শরীফ, ফটিকছড়ি, চট্রগ্রামে আসেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন