‘ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন’ এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। সর্বত্রই নামটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক চলছে। বিএনপি ও ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেপথ্যের অন্যতম এই কারিগর এখন কারগারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টাকে গ্রেফতার, কারাগারে প্রেরণ, নারী সাংবাদিককে কটুক্তি, ক্ষমা চাওয়ার দাবি এবং দলবাজ নারী সাংবাদিকের উষ্কানিমূলক প্রশ্ন, টিভি টকশোতে মইনুলকে না নেয়ার অ্যাডকোর সিদ্ধান্ত, নারী নেত্রীদের সংবাদ সম্মেলন, অর্ধশত সাংবাদিকের বিবৃতি, আদালতে মুক্তির দাবিতে আইনজীবীদের বিক্ষোভ, সংবিধান বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ, সারাদেশ থেকে মিডিয়া অফিসে ফোন করে তার খবর জানতে সাধারণ মানুষের আগ্রহ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তর্ক-বিতর্কে তোলপাড় চলছে। আবার এই ইস্যুতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির বিপরীতমুখী বক্তব্য যুদ্ধে নেমেছেন। এতে দেশ-বিদেশের সবকিছু ছাপিয়ে এখন শিরোনাম হচ্ছে ‘ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেন’ খবর। টিভি টকশোতে সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে ‘চরিত্রহীন’ বলায় রংপুরে একটি মামলা দায়েরের পর পরই ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম কায়সারুল ইসলামের আদালতে শুনানির পর জামিন নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। এর আগে দু’টি মামলায় হাইকোর্টে জামিন নিলেও ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে ময়মনসিংহে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাসহ জামালপুর, কুমিল্লা, কুড়িগ্রাম, ভোলা, রংপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কক্সবাজারে মামলা হয়েছে। জামিন নাকচ হয়ে যাওয়ার পর গতকাল আদালত প্রাঙ্গণে ব্যাপক হৈ চৈ হয়। শ্লোগানে শ্লোগানে উত্তপ্ত করে তোলে আইনজীবীরা। বিক্ষোভ করে তারা মইনুলের পক্ষ্যে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেয়। মইনুল হোসেনকে গ্রেফতারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘মইনুলকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে মামলার কারণে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে তার সংশ্লিষ্টতা এখানে কোনো বিষয় নয়। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সে জন্য গ্রেফতার করাটাই জরুরি ছিল’। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এই গ্রেফতারকে ‘নজীরবিহীন’ অবিহিত করে মুক্তির দাবী জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘তিনি আইনের প্রতি প্রদ্ধাশীল একজন ব্যক্তি। অপশাসনের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলাটাকেই তার অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। মানহানি মামলায় প্রথমে গ্রেফতারি পরোয়ানার নজির নেই। এই গ্রেফতার সম্পূর্ণ বেআইনি’। এদিকে সাবেক এমপি হওয়ার পরও অ্যাটর্নী জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে কারাগারে সাধারণ বন্দীদের মতোই রাখা হবে; কোনো ডিভিশন নয়। অবশ্য গত সোমবার প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিককে ব্যারিস্টার মইনুলের কটূক্তি নিয়ে মন্তব্য করেন। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা প্রতিবাদ করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যা করার করবে। আপনারা মামলা করেন, আমরা যা করার করব।’
মইনুল হোসেনের গ্রেফতার ও কারাগারে পাঠানো ইস্যু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বিতর্কের ঝড় বইছে। এনিয়ে নানা জনের নানান ধরণের মন্তব্য করছেন, বক্তব্য দিচ্ছেন। টিভি টকশোগুলোতেও চলছে বিতর্ক। তবে সাধারণ মানুষের ওই সব তর্ক-বির্তক পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, মানুষের মতামত হলো সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত ওই টিভি’র টকশোতে প্রশ্নকর্তা মহিলা সাংবাদিকের উদ্দেশ্যে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন যে ‘চরিত্রহীন’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন তা শোভন ছিল না। আবার ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে যে স্টাইলে প্রশ্ন করেছেন মাসুদা ভাট্টি নামের সাংবাদিক সেটাও ছিল অশোভন। প্রশ্নটি ছিল পক্ষপাতিত্ব ও উস্কানিমূলক। ঐক্যফ্রন্ট গঠন করার পর এধরণের প্রশ্ন কেবল ক্ষমতাসীন দলের নীতি নির্ধারকদের খুশি করতেই উত্থাপন সম্ভব।
অপ্রীতিকর ওই ঘটনার পর ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ফোন করে এবং একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার প্যাডে চিঠি লিখে নিজের বক্তব্যের জন্য মাসুদা ভাট্টির কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। এমনকি মাসুদা ভাট্টির দাবির প্রেক্ষিতে তিনি আশ্বাসও দিয়েছেন যে ‘যদি টেলিভিশনে সুযোগ হয় আমি সেখানেও দুঃখ প্রকাশ করবো’। কিন্তু হঠাৎ করে কিছু পরিচিত বুদ্ধিজীবী, নারী নেত্রী, সাংবাদিক ব্যারিস্টার মইনুলকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার আহবান জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন; বিবৃতি দেন। এ অবস্থায় বেকে বসেন মাসুদা ভাট্টি; বলেন পরিস্থিতি এখন আমার একার এক্তিয়ারে নেই। নারী নেত্রী ও সাংবাদিকদের এই ভুমিকা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপি সমর্থন পরিষদের নেতা ডা. সাখাওয়াত শায়স্ত। যে টিভিতে ‘মইনুল-মাসুদা ভাট্টি’ অপ্রীতিকর বিতর্ক হয়েছে সেই টিভির টকশোতে ডা. সাখাওয়াত শায়স্ত বলেন, নারী নেত্রী-বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিকদের কয়েকজন নারী সাংবাদিকের মানহানির অভিযোগে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে ক্ষমা চাইতে বলছেন। নারীর সম্মান রক্ষায় তারা উদগ্রীব। অথচ শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বই মেলাসহ বিভিন্ন যায়গায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে বহু নারী, ছাত্রী নির্যাতিত হয়েছে; সচিত্র সে খবর মিডিয়ায় প্রচার হয়েছে; অথচ তখন এরা নীরব ছিলেন; প্রতিবাদ করেননি। এদের কাছে কী ওই মেয়ে-ছাত্রী-নারীদের সম্মানহানী অমর্যাদকর মনে হয়নি?
নারী সাংবাদিককে নিয়ে মইনুল হোসেনের কটুক্তি নিয়ে যখন ঘটনার ঘনঘটা তখন ভারতের অবস্থান করা একজন ইসলাম বিদ্বেষী বিতর্কিত লেখিকা হিসেবে পরিচিত একজন লেখিকা লিখেছেন ‘মাসুদা ভাট্টি একটা ভীষণ রকম চরিত্রহীন মহিলা..। এছাড়াও ওই বিতর্কিত লেখিকা মাসুদা ভাট্টি সম্পর্কে যে সব অশ্লীল শব্দ লিখেছেন; তা পত্রিকায় ছাপার যোগ্য নয়। আবার ওই বিতর্কিত লেখিকার বক্তব্য খন্ডন করতে গিয়ে আলোচিত মাসুদা ভাট্টি ‘মিনমিনে স্বরে’ জবাব দিয়েছেন বলে সাধারণ মানুষ অভিযোগ তুলেছেন ফেসবুক-ব্লগ-টুইটারে।
যে মামলায় মইনুলকে গ্রেফতার করা হয় রংপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তা দায়ের করেন মিলি মায়া। আদালতে জামিন চেয়ে মইনুলের আইনজীবী বিএনপিপন্থী খন্দকার মাহবুব উদ্দিন শুনানিতে বলেন, এই মামলা হয়েছে জামিনযোগ্য ধারায়। সুতরাং মইনুল হোসেনকে জামিন দেওয়া যায়। বাদীপক্ষে আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের নেতা কাজী নজিবুল্যাহ হীরু জামিনের বিরোধিতা করে বলেন, এ মামলার ধারা জামিনযোগ্য হলেও দেশ ও সমাজের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে আদালত তা নামঞ্জুর করতে পারে। মেয়ের বয়সী মাসুদার কাছে তিনি লিখিতভাবে ক্ষমা চাইতে পারতেন। তিনি তা করেননি। তার স্ট্যাটসের লোকের এ রকম কটূক্তি শোভা পায় না। তার উক্তি গোটা নারী সমাজের বিরুদ্ধে গেছে। নারী সমাজ অপমানিত হয়েছে।
এদিকে মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা গ্রেফতার ও কারাগারে পাঠানো নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে শুরু হয়েছে তীব্র বাদানুবাদ। শুধু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীই নন; দুই দলের নেতারা যেন বাকযুদ্ধে নেমে গেছেন। মইনুল হোসেনের গ্রেফতারের যৌক্তিকতা তুলে ধরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে গ্রেফতার না করলে নারী সমাজ ক্ষুব্ধ হতো। টকশোতে সরকারের বিরুদ্ধে তিনি অনেক কথা বলতেন; তখন কিন্তু তাকে আমরা গ্রেফতার করিনি। গ্রেফতার করা হয়েছে টকশোতে সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে যা বলেছেন তাতে শুধু তার মানহানি হয়েছে তা নয়; বাংলাদেশের নারী সমাজ মনে করে তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাটি পুরো নারী সমাজকে অপমানিত করেছে। সেখান থেকে মামলা হয়েছে’। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ব্যারিস্টার মইনুল বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে রাজনৈতিক জোট করে। এরপর তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাজনীতি করেন। ব্যারিস্টার মইনুল ২০০৫ সালে স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের অনুষ্ঠানে গিয়ে সেই দলের ও কর্মীদের প্রশংসা করেছিলেন। যে লোক ’৭১ এর খুনি, লুণ্ঠনকারী, ধর্ষকদের প্রশংসা করতে পারে, ’৭৫ এর খুনিদের সঙ্গে রাজনৈতিক আঁতাত করতে পারে, সে অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে চরিত্রহীন।’ বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কারণ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের ৫ ঘণ্টার মধ্যে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এটা মানতেই হবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এই গ্রেফতার। অথচ যে কারণে তাকে গ্রেফতার করা হলো সেই কারণ আদালত আমলে নিয়ে তাকে পাঁচ মাসের জামিন দিয়েছিল’। মইনুল হোসেনকে নিয়ে তর্ক-বিতর্ক এখনো চলছেই। #
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন