মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

নৈতিক মূল্যবোধের এই অবক্ষয় কেন

প্রকাশের সময় : ২৯ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কামরুল হাসান দর্পণ
বাংলাদেশের মানুষ কি দিন দিন চিরায়ত কৃষ্টি, সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতা, পারিবারিক-সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় বিধিনিষেধ ও অনুশাসন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? এ প্রশ্ন এখন খুব বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এর কারণ দেশের বিভিন্ন জনপদে একের পর এক যেসব অকল্পনীয় ও শিউরে ওঠার মতো ঘটনা ঘটে চলেছে, এসব ঘটনা কোনোভাবেই এদেশের মানুষের আচার-আচরণের সঙ্গে মেলে না। এদেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, আদব-কায়দা ও মায়া-মমতার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করা। পরিচিত হোক আর অপরিচিত হোক, একের দুঃখে অপরের দুঃখিত হওয়া, সহমর্মিতা প্রকাশ করা, পাশে দাঁড়িয়ে সান্ত¦না দেয়া। তরুণ সমাজ বেয়াদবির পথে ধাবিত হলে তাকে বারণ করা। সমাজে  অসঙ্গতি দেখা দিলে, সামাজিকভাবে তা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া, এমনকি পারিবারিক কলহ মিটাতেও এগিয়ে আসা। মানুষের বৈশিষ্ট্য তো এই যে, তারা সমাজ ও পরিবারে শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে সবসময়ই সচেতন। এমনকি অতিথিপরায়ণতার দিক থেকেও অতুলনীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। একদা গাঁয়ের পথ ধরে কোনো তৃষ্ণার্ত পথিক যদি কোনো বাড়িতে গিয়ে এক গ্লাস পানি চাইত, দেখা যেত শুধু এক গ্লাস পানি নয়, সঙ্গে একবাটি মুড়ি-মিঠাই দেয়া হতো। চেনা নেই জানা নেই, এমন ব্যক্তিকে অতিথি ভাবার মতো এমন মানুষ কি দুনিয়ার আর কোথাও আছে? এই সময়ে এসে মানুষের মধ্যে কেন এমন সব ঘটনা ঘটছে, যা কল্পনাও করা যায় না। দেড়-দুই দশক আগেও যে দুয়েকটি অকল্পনীয় ঘটনা ঘটত, সেগুলো তোলপাড় সৃষ্টি করলেও বিচ্ছিন্ন বলে গণ্য করা হতো। এ ধরনের ঘটনা কালেভদ্রে ঘটত। এখন সামাজিক ও পারিবারিক অপরাধমূলক ঘটনা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে এগুলোকে আর বিচ্ছিন্ন বলে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। একটি ঘটনা ঘটছে তো এ ধারাবাহিকতায় আরেকটি ঘটনা এসে হাজির হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান এই ভয়ংকর প্রবণতার জন্যই প্রশ্ন উঠছে, আমরা কি দিন দিন নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার দিকে ধাবিত হচ্ছি? এর কারণ কি? এর অন্যতম প্রধান কারণ যদি ধরা হয় অর্থ এবং এর প্রতি মানুষের প্রবল আকর্ষণ, তবে এ কথাও তো বলা যায়, অর্থের টানাপড়েনের মধ্যে এদেশের মানুষ যুগযুগ ধরেই ছিল। সে সময় তো মানুষ তার নৈতিক চরিত্র হারায়নি। অভাবের মধ্যেও তার নীতি-নৈতিকতা বেশ টনটনে ছিল। বলাবাহুল্য, জীবনে অর্থের প্রয়োজনীয়তা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। তবে অর্থ রোজগার করতে গিয়ে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে জোরজবরদস্তির পথ বেছে নেয়া কি আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্টের সঙ্গে মেলে? আমরা এখন এমন এক সমাজে বসবাস করছি, যেখানে মান-সম্মান ইজ্জতকে আর তোয়াক্কা করছে না। অনেকের মধ্যে এমন একটা প্রবণতা বিরাজমান, ভালো মানুষ না হলেও অর্থ-বিত্তের মালিক হতে পারলে মানসম্মান কেনা যাবে। এর নজিরও কম নয়। দেখা যাচ্ছে, সমাজের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীরাই সমাজের নিয়ন্তা হয়ে বসে আছে। তার অর্থ আছে গায়ের জোরও আছে। তারা মনে করে এই দুই শক্তি থাকলে মানসম্মান এমনিতেই তাদের পায়ে লুটিয়ে পড়বে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, আমরা সম্মিলিতভাবেই এদের অবস্থানকে শক্ত করার সুযোগ করে দিচ্ছি। আমাদের মধ্যে যাদের এখনো একটু-আধটু সুকুমারবৃত্তি রয়েছে, তারা কোনোভাবেই এক হতে পারছি না। একেকজন যেন আলাদা হয়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপবাসী হয়ে বসবাস করছি। কে বাঁচল আর কে মরল, এ নিয়ে টুঁ শব্দ করি না। কীভাবে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে হয়, তা জেনেও উদ্যোগী হই না। আমাদের দুর্বলতার এ সুযোগটাই নিচ্ছে সমাজের মাথা হয়ে থাকা দুষ্টচক্র। শুধু সমাজের এই দুষ্টচক্র নয়, রাজনীতি থেকে রাষ্ট্র পরিচালকরাও এ সুযোগ নিচ্ছে। তারা আমাদের ভীতুর ডিম বানিয়ে রেখেছে। তারা জানে, হুমকি-ধমকি দিয়ে আমাদের ভীত করতে না পারলে কোনোভাবেই তাদের দুষ্কর্মের রাজত্ব কায়েম করতে পারবে না। আর আমরাও আমাদের নৈতিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য না দিয়ে ওইসব ভীতি সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর হুমকি মেনে নিচ্ছি। আর হুমকি-ধমকি প্রদানকারী চক্র তাদের প্রাধান্য ধরে রাখার জন্য একের পর এক এমনসব ইস্যু সৃষ্টি করছে, যাতে মানুষ তার চিরায়ত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ফিরে যেতে না পারে। এর ফলে আমাদের অবদমিত বৈশিষ্ট্য প্রায়ই ভয়ংকর আকার ধারণ করে। মা সন্তানকে, সন্তান পিতা-মাতাকে, স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে, শিক্ষক ছাত্রকে, ছাত্র শিক্ষককে হত্যার মতো ঘটনা অবলীলায় ঘটছে।
দুই.
বাংলাদেশের ৯২ ভাগ মানুষই মুসলমান। একটা সময় এদেশে শিক্ষার হার খুবই কম ছিল। বলা হয়, অশিক্ষিত জাতি ও বর্বর জাতির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য থাকে না। তবে এ কথা যে আমাদের দেশের মানুষ কোনো দিনই মানেনি, তা তাদের আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। তাদের শিক্ষার ভিত্তি হয়েছিল, ধর্মীয়, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ, বিধিনিষেধ এবং অনুশাসন। এসব গুণাবলী আঁকড়ে ধরে মানুষ অতুলনীয় মানবিকতার প্রতীকে পরিণত হয়। তারা নিজেদের আলাদা কোনো সম্প্রদায় মনে করেনি। আমরা বাংলাদেশি, এই একটি সম্প্রদায়েই বিশ্বাস করত। অসাম্প্রদায়িকতার কথা বা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে তাদের এই বিশ্বাসের মূলে যেন একটি শ্রেণী, সর্বোপরি রাষ্ট্র পরিচালকরাও আঘাত হেনে তছনছ করে দিচ্ছে। যে দেশের ৯২ ভাগ মানুষ মুসলমান, যারা কোনো দিনই সম্প্রদায়গত পার্থক্য করত না, সেই তাদের সামনেই বারবার অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ প্রসঙ্গ কেন তোলা হবে? যেখানে মানুষ এক বাটি দুধকে দুধই ভাবে, সেখানে এই দুধকে কেন অন্য কিছু বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে? তারা কেন দশ জনের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে একজনের মতামতকে গ্রহণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে? অসাম্প্রদায়িকতা মানে কি এই, প্রথম শ্রেণী থেকে শুরু করে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক থেকে মুসলমান লেখকদের গদ-পদ্য বাদ দিয়ে অন্য ধর্মের লেখক ও অন্য ধর্ম সম্পর্কিত গদ্য-পদ্যের আধিক্য থাকতে হবে? যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান, সে দেশের শিশু-কিশোরদের কি অন্য ধর্মের নীতি-আদর্শে দিক্ষিত করতে হবে? এক ধর্মের শিক্ষামূলক বিষয় ঝেটিয়ে বিদায় করে, অন্য ধর্মের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা কি অসাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মনিরপেক্ষতা? আবহমান কাল ধরে যে দেশের মানুষ ইসলাম ধর্মের নীতি-আদর্শের মধ্যে বেড়ে উঠেছে, সেখানে অন্য ধর্মের নীতি-আদর্শে অনুপ্রাণিত করা কি এই নয় যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নীতি-আদর্শকে দূরে ঠেলে দেয়া? হ্যাঁ, যে কোনো ধর্ম সম্পর্কে জানা দোষের কিছু নয়। যে কেউ যে কোনো ধর্ম সম্পর্কে জানতে পারে। তার অর্থ এই হতে পারে না, অসাম্প্রদায়িকতার নামে পাঠ্যপুস্তক থেকে এক ধর্মের নীতি-আদর্শমূলক লেখা ফেলে দিয়ে অন্য ধর্মের লেখা যুক্ত করতে হবে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং কিছু অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলা লোক কথায় কথায় বলে, ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার।’ অথচ আমরা যদি প্রাথমিক থেকে উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকের দিকে নজর দেই, তাহলে দেখব, ধর্মীয় লেখাই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে এবং তা করা হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম বাদ দিয়ে অন্য ধর্ম অন্তর্ভুক্ত করে। প্রাসঙ্গিকভাবে এ প্রশ্নও আসে, যে দেশের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম, সে দেশ এমন হয় কীভাবে? সাধারণভাবে এর অর্থ কি এই নয়, রাষ্ট্র ধর্ম সবারই পালন করতে হবে এবং তা না করলে সংবিধান অবমাননার মতো অপরাধের শামিল হবে? বাস্তবতা হচ্ছে, রাষ্ট্র পরিচালকরা যতই দেশকে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার কথা বলুক না কেন, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের কথা বিবেচনা করে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম বহাল রেখেছে। অন্যদিকে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে পাঠ্যপুস্তকে অন্য ধর্মের গদ্য-পদ্য সংযোজন করে রেখেছে। ভেতরে সাম্প্রদায়িকতার মনোভাব পোষণ করে মুখে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলা কি স্ববিরোধী আচরণ নয়? পাঠ্যপুস্তকে অন্য ধর্মের নীতি-আদর্শ যুক্ত করা কি সাম্প্রদায়িকতার পরিচায়ক নয়? দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এসব জেনেও রাষ্ট্রের রোষে পড়ার শঙ্কায় নিশ্চুপ রয়েছে। তারা জানে এসব কথা বলতে গেলেই বৈরী আচরণের শিকার হতে হবে। তাদের মধ্যে এখন এমন মনোভাব বিরাজ করছে, ইসলামের কথা বলে আবার না সাম্প্রদায়িক হয়ে যাই। বলার অপেক্ষা রাখে না, ইসলামী মূল্যবোধসম্পন্ন গদ্য-পদ্য বাদ দিয়ে অন্য ধর্মের নীতি শিশু-কিশোরদের পড়তে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে তাদের এক ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। তাদের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, বাবা-মা ঘরে যে ইসলামের কথা বা ‘গুনাহ হবে’ বলে ধর্মীয় অনুশাসনের কথা বলে, পাঠ্যপুস্তকের সাথে তার মিল নেই কেন? এর জবাব অভিভাবকরা কি দেবেন? আসলে অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার নামে আমাদের দেশে যা হচ্ছে, তা হীরা ফেলে কাচ তুলে নেয়ার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূল ¯্রােতের বিপরীতে সাঁতার কাটা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস ও আকিদাকে অবজ্ঞা করার একটি ট্রেন্ড চালু করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
তিন.
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কথা কেউ বিশ্বাস করে না বলে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে। অনেকেই শিশুর কথার সাথে তার কথার তুলনা করেন। শিশুদের কথা যেমন মানুষ গুরুত্ব দেয় না, তেমনি এরশাদের কথাও গুরুত্ব দেয় না। তবে মাঝে মাঝে শিশুরাও যে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে ফেলে, তার অজ¯্র উদাহরণ রয়েছে। এক সন্তান নিয়ে দুই মায়ের দাবি এবং শিশুটির আসল মা কে, এ নিয়ে  রাজা যখন গভীর চিন্তিত, তখন এর সমাধান দিয়েছিল এক শিশু। চিন্তিত রাজা যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন, তখন মাটিতে খেলারত এক শিশুকে বলতে শোনেন, ভাগ করে দিয়ে দিলেই তো হয়। এ কথা থেকেই রাজার বুদ্ধি খুলে যায়। তিনি রায় দেন, শিশুর মায়ের দাবিকারী দুই মাকেই শিশুটিকে কেটে সমান ভাগ করে দেয়া হোক। এ থেকে এক মা দাবি ছেড়ে দিয়ে বলেছিলেন, আমার সন্তান ভাগ করার প্রয়োজন নেই। আমি মায়ের দাবি ছেড়ে দিলাম। আমার সন্তান জীবিত থাকুক। রাজা আসল মাকে শনাক্ত করতে পারেন। এরশাদও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে সম্প্রতি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি প্রশ্ন তুলে বলেছেন, অসাম্প্রদায়িকতার মানেটা কি? এর মানে কি দেশে কোনো সম্প্রদায় থাকবে না? মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বলে কি কোনো সম্প্রদায় থাকবে না? এরা কি সম্প্রদায় নয়? সম্প্রদায় ছাড়া কি কোনো দেশ হয়? অত্যন্ত খাঁটি প্রশ্ন করেছেন এরশাদ। এর মাধ্যমে তিনি এটাই বোঝাতে চেয়েছেন, অসাম্প্রদায়িক কথাটাই ভুয়া। সম্প্রদায়ের বাইরে কোনো জাতি বা গোষ্ঠী হতে পারে না। যারা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা বলছেন, তারা এ শব্দটির প্রকৃত অর্থই জানেন না। বাংলাদেশের তথাকথিত প্রগতিবাদীরা এই শব্দটিকে ব্যবহার করেন শুধু মুসলমানদের হেয় ও কলঙ্কিত করার জন্য। যেভাবে পশ্চিমা দেশগুলো সারা বিশ্বের মুসলমানদের করছে। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাসের দিকে না তাকিয়ে তারা তাদের প্রভুদের দিকে তাকিয়ে কথা বলে। এটা এক ধরনের শক্তি প্রয়োগ ও স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। নিজেদের মত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা। দুঃখের বিষয়, যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, তারাও এসব সুবিধাবাদীর সাথে সুর মিলিয়ে কথা বলছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিষয়টি বিবেচনায় নিচ্ছে না। আমরা জানি, যুগে যুগে সুবিধাবাদীদের আয়-রোজগারের একটা বড় উৎস হয়ে রয়েছে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ইস্যু। অথচ আমরা যদি খেয়াল করি তবে দেখব, বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় আমাদের দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা অতি নগণ্য। পার্শ্ববর্তী ভারতের দিকে তাকালেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। সেখানে মুসলমানদের দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে। পান থেকে চুন খসলেই মুসলমানদের কচুকাটা করা হয়। মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব কোরবানি নিষিদ্ধ করা হয়। কথায় কথায় দাঙ্গা বাঁধিয়ে দেয়া হয়। মুসলমানসহ অন্যান্য ধর্মের মানুষকে জোর করে হিন্দু ধর্মে কনভার্ট করা হয়। বাংলাদেশে কি এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে? হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কি কোনো দাঙ্গা বাধে? জোর করে মুসলমান করা হয়? পূজা করতে বাধা দেয়া হয়? যারা অসাম্প্রদায়িক কথাটির সঠিক অর্থ জানে না তাদের মতো পেইড লোকজন উত্তেজনার বশে হয়তো বলে বসবেন, হ্যাঁ হয়। না হলেও অক্ষমের মতো পাহাড় ঠেলতে ঠেলতে বলতে হয়। হ্যাঁ, আমাদের দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের মতো দুয়েকটি ঘটনা যে ঘটে না, তা নয়। তবে তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের কোনো ভূমিকা থাকে না। এটা নিতান্তই দুষ্কৃত শ্রেণীর কাজ। আবার এসব ভাঙচুরের পেছনে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির বিষয়টিও থাকে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সংখ্যালঘুদের টার্গেট করা হয়। এ ধরনের হীন কাজ এদেশের মানুষ কখনই সমর্থন করেনি, গ্রহণও করেনি। তারপরও রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ইস্যুটি সৃষ্টি করা হয়। এই যে গত সপ্তাহে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, সংখ্যালঘু নির্যাতনে সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা জড়িত। এর মানে কি? মানে হচ্ছে, যে সরকার অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলছে, সেই সরকারের নেতা-কর্মীরাই হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে এবং সম্প্রদায়গত বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসছে। প্রতিপক্ষের হাতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ইস্যুটি তুলে দিচ্ছে এবং তা জিইয়ে রাখছে।
চার.
আমাদের নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অধঃপতনের কথা যে এখন উঠছে, এর মূল কারণই হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার মতো একটি হাইপোথ্যাটিক্যাল কথা বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মূল চেতনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধকে মূল্যায়ন না করে হেয়প্রতিপন্ন করা এবং একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর অসাম্প্রদায়িকতার কথাকে প্রাধান্য দেয়া। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনোজগতে এক ধরনের পরিবর্তন এবং অস্থিরতা ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। তা না হলে মা কর্তৃক সন্তান, সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতা হত্যার মতো অপরাধ সংঘটিত হবে কেন? যদি এসব ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট থাকত, তাহলে এ ধরনের অকল্পনীয় ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি পেত না। এখন রাষ্ট্র পরিচালকদের পক্ষ থেকেই বলা হয়, বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ  রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। অথচ এ দুটো শব্দের অর্থ সাধারণ মানুষের কাছে পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তারা কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। যারা বুঝতে সক্ষম, তাদের মধ্যে এ প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, ধর্ম নিরপেক্ষ মানে কি এই যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের বিশ্বাস প্রাধান্য পাবে না? আবার এই প্রশ্নও তো আসতে পারে, ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে যদি প্রত্যেক ধর্মের মানুষ পারস্পরিক সহাবস্থানে থেকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করা বোঝায়, তাহলে বাংলাদেশে কি এই পরিস্থিতি নেই? রাষ্ট্র পরিচালনায় যারাই থাকুক না কেন, তাদের ধর্মের প্রতিফলন কি তাদের কর্মের ওপর প্রভাব ফেলে না? যদি তা না হয়, তাহলে তো তাদের কর্মে সব ধর্মেরই প্রতিফলন থাকতে হবে। এটা কি সম্ভব? অথচ স্বাভাবিক নিয়মই হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষেই রাষ্ট্র পরিচালকদের থাকতে হয়। সারা বিশ্ব এ নিয়মেই চলছে। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা ভারতেও তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের ভিত্তিতেই পরিচালিত হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বীদের ভোটেই তারা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে। ইউরোপ-আমেরিকাসহ সারা বিশ্বে তাই হচ্ছে। আমাদের দেশেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ভোটেই সরকার নির্বাচিত হয়। কাজেই এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাসের কথা না বলে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলা কতটা যুক্তিসঙ্গত? এটা কি বাস্তবতাকে অস্বীকার করা নয়? সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মূল্যবোধ ও বিশ্বাস যখন রাষ্ট্র পরিচালকদের পক্ষ থেকে উপেক্ষিত হয়, তখন এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পুরো সমাজে পড়তে বাধ্য। সমাজে একের পর এক অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক। চাপিয়ে দেয়া কোনো ধরনের উদ্ভট মতবাদ নিয়ে কথা না বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিরায়ত বৈশিষ্ট্য ও মূল্যবোধকে উজ্জীবিত করতে পারলেই সমাজ থেকে মারাত্মক ঘটনা ঘটা কমে যাবে।  
darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন