মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

ভারতের বিদ্যুৎ প্রকল্পে যুক্ত হওয়া সমর্থনযোগ্য হতে পারে না

প্রকাশের সময় : ৩০ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুনশী আবদুল মাননান
ভারত সীমান্ত ও অভিন্ন নদীতে পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে চায়। জানা গেছে, এ ব্যাপারে ব্যাপক পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে তিস্তার উজানে গজলডোবার পর পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ে আরেকটি সেচ ও বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের কাজ শেষ করেছে দেশটি। তার পরিকল্পনায় রয়েছে আরও অন্তত ৩১টি প্রকল্প। এসব প্রকল্পের লক্ষ্য, আগামী দশ বছরের মধ্যে ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ। অভিন্ন নদীতে এভাবে বিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পানি প্রাপ্তির সম্ভাবনা যে আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়বে, সেটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
অভিন্ন বা আন্তর্জাতিক নদীর উজানে বাঁধ তুলে পানি প্রত্যাহার, বিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্প গ্রহণ আন্তর্জাতিক আইনবিধিসম্মত নয়। কোনো দেশকে এই সুযোগ ও অধিকার দেয়া হয়নি। স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ব্যাহত হয়, ভাটির দেশের ক্ষতি হয়, এমন কোনো স্ট্রাকচার, স্থাপনা ও প্রকল্প নির্মাণ বা বাস্তবায়ন আন্তর্জাতিক আইনবিধির লঙ্ঘন। উজানের দেশে ওই ধরনের কোনো কিছু করতে চাইলে আগে তাকে দেখতে হবে ভাটির দেশের কোনো ক্ষতি হয় কিনা। এ নিয়ে ভাটির দেশের সঙ্গে তার কথাবার্তা বলতে হবে এবং সম্মতি নিতে হবে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও বলতে হচ্ছে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত ৫৪টি অভিন্ন নদীর অধিকাংশ বাঁধ, গ্রোয়েন ও প্রতিবন্ধক নির্মাণ করে ভারত নির্বিচারে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং এর অবর্ণনীয় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হচ্ছে। এই যে বাঁধ, গ্রোয়েন ও প্রতিবন্ধক নির্মাণ করা হয়েছে সে ব্যাপারে ভারত কখনই বাংলাদেশের সঙ্গে পূর্বাহ্নিক কথাবার্তা বলার বা সম্মতি নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। এই পটভূমিতে এখন তার নজর পড়েছে সেচ-বিদ্যুতের যৌথ প্রকল্প গড়ে তোলার দিকে। এ নিয়ে পরিকল্পনা, প্রকল্প ও লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রেও বাংলাদেশকে ভারত কিছু জানিয়েছে কিনা, আমাদের জানা নেই। আমাদের জানা নেই, ভারতের পরিকল্পনা ও প্রস্তাবিত ও নির্ণীত প্রকল্পগুলো সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত আমাদের সরকারের কাছে আছে কিনা। মনে হতে পারে, সরকার এ বিষয়ে ওয়াকিহাল নয়। কিংবা ওয়াকিবহাল যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়ার পক্ষপাতী নয়।
ভারতের এই সেচ ও বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের বিপদ আরো কত বড় হয়ে দেখা দিতে পারে, তা আমরা বুঝতে না চাইলেও ভারত যে বিলক্ষণই বোঝে তাতে সন্দেহ পোষণের সুযোগ নেই। ভারত সম্ভবত এই দিকটি লক্ষ্য রেখেই বাংলাদেশকে তুষ্ট রাখার লক্ষ্যে তিনটি প্রকল্পে বাংলাদেশকে যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে। একে জুতা মেরে গরু দান বললেও খুব বেশি বলা হবে না। প্রস্তাবটি বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ওই প্রস্তাবে তিনটিতে পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পে বাংলাদেশকে যুক্ত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রকল্প তিনটি হলোÑ মিনটুডু, মপু ও তিস্তা-৪ প্রকল্প। তিনটি প্রকল্পে ১ হাজার ৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পে বাংলাদেশ পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারে। অথবা বিদ্যুৎ আমদানি করে যুক্ত হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী জানিয়েছেন, ভারতের সীমান্ত নদী ও বাংলাদেশ-ভারত অভিন্ন নদীতে পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প করার প্রস্তাব নিয়ে অনেক দিন ধরে আলোচনা হচ্ছে। তবে আমাদের পরিবেশে এবং নদ-নদীর প্রবাহে কোনো প্রভাব পড়বে কিনা, এসব বিষয় বিস্তারিত সমীক্ষা করতে হবে। তবেই সিদ্ধান্ত। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, দুই দেশের অভিন্ন ও সীমান্ত নদীর পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পে বাংলাদেশকে পুুঁজি বিনিয়োগ অথবা যুক্ত হতে প্রস্তাব দিয়েছে ভারত। তার প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে অনেক বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিভিন্ন ধরনের সমীক্ষার পর পর্যালোচনা করতে হবে। তারপর বিবেচনা করতে হবে প্রকল্পের যুক্ত হওয়া যাবে কিনা। এমনিতেই ভারতের সঙ্গে তিস্তাসহ একাধিক নদীর পানি বণ্টন নিয়ে সংকট রয়েছে। এ অবস্থায় অভিন্ন নদীগুলোতে পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প নতুন করে বাংলাদেশকে কোনো সংকটে ফেলবে কিনা সে বিষয়টিও দক্ষতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করতে হবে।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, প্রস্তাব পাওয়া গেছে। এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি সমীক্ষা-পর্যালোচনার ওপর নির্ভরশীল। বোঝাই যায়, চটজলদি কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চায় না সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। কিš ‘এই মর্মে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান দ্রুত ইতিবাচক সিদ্ধান্ত চান। সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্বের কারণে তিনি ক্ষুব্ধ। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টার বরাবরে তিনি একটি চিঠিও দিয়েছেন। ভারতের পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার পক্ষে তার জোর তাগিদ ও যুক্তি চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন। এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় যে প্রাথমিক মতামত দিয়েছে তার তিনি সমালোচনা করেছেন। একই সঙ্গে এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ‘সহযোগিতার সাথে অনাবশ্যক বাধা সৃষ্টি করা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতির পরিপন্থী।’
সমীক্ষা, পর্যালোচনা ও যথাযথ বিচার-বিবেচনা ছাড়া এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া বা দেওয়া কঠিন। একটি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে এ সিদ্ধান্ত দেওয়া আরো কঠিন। প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টাও তা জানেন। তারপরও তিনি এতটা আগ্রহী কেন, প্রভাব বা চাপ সৃষ্টিই বা আগ বাড়িয়ে করছেন কেন, তা একটি বড় প্রশ্ন। ভারত যে প্রস্তাব দিয়েছে, সেই প্রস্তাবের পেছনে ভারতের বিশেষ স্বার্থ ও লক্ষ্য থাকাই স্বাভাবিক। মাত্র তিনটি প্রকল্পের সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করার পেছনে সম্ভাব্য যে উদ্দেশ্যটি থাকতে পারে, তা হলো এর মাধ্যমে সীমান্ত ও অভিন্ন নদীগুলোতে যেসব সেচ বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলা হবে তার প্রতি ভিন্নভাবে হলেও বাংলাদেশের সমর্থন নিয়ে নেয়া। বাংলাদেশ তিনটি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হলে অন্য প্রকল্পগুলোর বিরুদ্ধে স্বভাবতই সোচ্চার হতে পারবে না। যদি এমন হতো, অভিন্ন নদীগুলোতে এ ধরনের যত প্রকল্প গড়ে উঠবে, তার প্রতিটির সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করা হবে, নিদেনপক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে তার সম্মতি নেয়া হবে, এই নিশ্চয়তা দেয়া হবে যে, বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না, তাহলে সেটাই হতো যৌক্তিক ও বাস্তবায়িত। ভারত সে পথে না গিয়ে সামান্য মুলা ঝুলিয়ে তার লক্ষ্য হাসিল নিশ্চিত করতে চায়। যে কারণেই হোক, প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ভারতের প্রস্তাবের পক্ষে ওকালতি বা চাপ সৃষ্টি করছেন। সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকেই নিতে হবে, দিতে হবে। সেজন্য সময়ের প্রয়োজন। এই সময় দিতে নারাজ কেন অর্থ উপদেষ্টা? অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, ভারত বাংলাদেশের কাছে ট্রানজিট চাইলে সরকারি মহলের অনেকেই ট্রানজিট দেয়ার পক্ষে ওকালতি করেছিলেন। সরকারও না-রাজি ছিল না। তারপরও এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা কথা ও প্রশ্ন উঠেছিল। কেউ কেউ বলেছিলেন, ভারতকে ট্রানজিট দিলে যে অর্থনৈতিক লাভ হবে তাতে অচিরেই বাংলাদেশ হংকং-সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে। তখন মাসুলের প্রসঙ্গটিও এসেছিল। এ বিষয়ে সেদিন ড. মসিউর রহমান বলেছিলেন, ট্রানজিটের বিনিময়ে মাসুল নেয়া অভদ্রতা। আসলে ভারত ইতোপূর্বে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ট্রানজিট সুবিধা নিয়েছে। তবে কোনো মাসুল দেয়নি। আমাদের ভদ্রতার বলিহারি দিতে হয়! ভারতের ত্রিপুরায় পালটান। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভারী যন্ত্রপাতি পরিবহনে বাংলাদেশের রাস্তাঘাটের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে যন্ত্রপাতি পারাপার সহজ করা হয়। এতে ক্ষতি হয় নদীর। এ ক্ষতি বাংলাদেশকে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার জন্য স্বীকার করতে হয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতে বিভিন্ন সময় খাদ্য পরিবহনে ভারত ট্রানজিট সুবিধা নিয়েছে। এ জন্য তাকে কানাকড়িও মাসুল দিতে হয়নি। যিনি বিনা মাসুলে ভারতকে ট্রানজিট দিতে চান, তার পক্ষে ভারতীয় প্রস্তাব বাস্তবায়নে আগ্রহ দেখানো, চাপ সৃষ্টি করা, বিলম্ব ক্ষুব্ধ হওয়া, কিংবা প্রধানমন্ত্রীর আরেক উপদেষ্টাকে উপদেশ দেয়া অস্বাভাবিক মনে হয় না। ড. মসিউর রহমান প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা। বাংলাদেশের নাগরিক ও গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী হিসাবে তিনি বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে থামবেন, বাংলাদেশের স্বার্থের পাহারাদার হিসাবে কাজ করবেন, এটা প্রত্যাশিত হলেও দেখা যাচ্ছে, তিনি নানা ক্ষেত্রে ভারতের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ উপেক্ষা ও বেতোয়াক্কা করছেন।
সীমান্ত ও অভিন্ন নদীতে সেচ ও বিদ্যুৎ প্রকল্প বা অন্য ট্রাকচার-স্থাপনা গড়ে তোলা ভারতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অংশ। এটি আন্তর্জাতিক নদী ও পানি সম্পদ সম্পর্কিত বিষয়। সুতরাং, বাংলাদেশকে ও রাজনৈতিক ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি বিবেচনা-পর্যালোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ২০১১ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে যে সহযোগিতা চুক্তি হয়েছে তাতে অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার দিক-নির্দেশনা আছে। অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহার ও নদী অববাহিকায় বসবাসকারী মানুষের সর্বোচ্চ সুবিধা ও কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য অবাবাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা আন্তর্জাতিকভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত হিসাবে স্বীকৃতি ও বিবেচনা লাভ করেছে। কাজেই অভিন্ন নদীতে যা কিছুই করা হোক না কেন, অবাবাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনার আওতাতেই করা উচিত। ভারত অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা এবং এই ভিত্তিতে ভিত্তিতে সব কিছুর ফয়সালা করার ব্যাপারে খুব আগ্রহী, তা প্রতীয়মান হয় না। যদি আগ্রহী হতো তাহলে অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনার বিষয়টি যথাযথ অগ্রাধিকার দিতো। তা না করে ভারত নিজ উদ্যোগে অভিন্ন নদীতে সেচ ও বিদুৎ প্রকল্প করছে এবং আরও করার পরিকল্পনা করছে। অন্যদিকে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্প করছে। নিজ ও যৌথ উদ্যোগের এসব প্রকল্পের বেনিফিট প্রায় ১৬ আনাই ভারতের খাতায় জমা হচ্ছে বা হবে। এই ধারাবাহিকতাতেই তিনটি পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পে বাংলাদেশকে যুক্ত করার প্রস্তাব ভারত দিয়েছে যাতে এ নিয়ে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে কথা বলার সুযোগ না পায়। অথচ প্রতিটি আন্তর্জাতিক নদীর ক্ষেত্রে অববাহিকতাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হলে সেচ, বিদ্যুৎ, রিজার্ভার ইত্যাদি সব ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সংশ্লিষ্ট সব দেশেরই ন্যায়সঙ্গত সুফল ও সুবিধা পাওয়া সম্ভব। ভারত অন্যান্য দেশকে এ সুযোগ-সুবিধা দিতে নারাজ। সে একই সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে চায়।
এই একতরফা ও একদেশদর্শী ভারতীয় পরিকল্পনা ও উদ্যোগ জাতীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থে বাংলাদেশ সমর্থন করতে পারে না। তাতে তার সহযোগিতা দান ও যুক্ত হওয়ারও কোন প্রশ্ন উঠতে পারে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, অভিন্ন নদীর উজানে সেচ-বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের নদীগুলোর পানি প্রবাহের সংকট আরো তীব্র হবে। সেই সঙ্গে প্রকৃতি, পরিবেশ, উৎপাদন, অর্থনীতি, জীব-বৈচিত্র্যসহ সকল ক্ষেত্রে ভয়াবহ বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের প্রথমত কাজ হবে, ভারত অভিন্ন নদীতে কোথায় কোথায় এবং কতটা সেচ-বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তুলতে যাচ্ছে তার খোঁজ-খবর নিয়ে, যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে পর্যালোচনা ও গবেষণা করা। বাংলাদেশে এসব প্রকল্পের প্রতিক্রিয়া কি হবে, কতটা হবে, অতঃপর তা নির্ণয় করতে হবে। যেহেতু এসব প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশের ক্ষতির আশংকাই প্রবল কাজেই এখনই এ নিয়ে ভারতের সঙ্গে কথাবার্তা বলা শুরু করতে হবে। তাকে বিরত রাখার চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। একই সাথে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির আলোকে অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।
‘সব নেবো’ ‘সব খাবো’, এ ধরনের একটি প্রবণতা ভারতের আগাগোড়াই রয়েছে। মুখে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা বাড়ানোর কথা বলা হলেও কার্যক্ষেত্রে ভারত তার নিজ স্বার্থছাড়া, অন্যের স্বার্থের কথা চিন্তা করে না। সাম্প্রতিককালে নেপালের সঙ্গে ভারত যে ব্যবহার করেছে, তার নজির বিরল। এর আগে শ্রীলংকার সঙ্গে এবং মালদ্বীপের সঙ্গে তার সম্পর্কও সংঘাতের বিষয়ও স্মরণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, স্বার্থের প্রশ্নে বাংলাদেশকে ভারত এতটুকু ছাড় দেয়নি। সম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে শর্তহীন সহযোগিতা আদায় করে নিয়েছে, ট্রানজিট-করিডোর সুবিধা নিয়েছে, বন্দর ব্যবহারের সুযোগ নিশ্চিত করেছে, কানেকটিভিটির নামে আরও নানা সুবিধা নেয়ার বন্দোবস্ত সম্পন্ন করেছে। বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছুই পায়নি। পানির মামলার কিছু হয়নি। তিস্তা চুক্তি হয়নি। সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধ হয়নি। বাণিজ্য অসমতা কমেনি।
পানি সমস্যা বাংলাদেশের জীবন-মরণের সমস্যা। ভারত সেভাবে অভিন্ন নদীর পানি সরিয়ে নেয়ার একের পর এক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে, তাতে এমন এক সময় আসতে পারে, যখন উজান থেকে শুকনো মওসুমে পানি আসা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে। নদীগুলো সম্পূর্ণ মার খাবে।  গঙ্গাচুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশ পানি পায় না। তিস্তাচুক্তি শিকেই উঠেছে। অন্যান্য নদীর পানি নিয়েও কোনো কথাবার্তা নেই। ইতোমধ্যেই খবর পাওয়া গেছে, ভারত সারদা নদীর পানির লিংক প্যানেলের মাধ্যমে সবরমতি নদীতে নিয়ে যাওয়ার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সরদা গঙ্গার পানির অন্যতম উৎস। এই পানি সবরমতিতে টেনে নেয়া হলে উষর গুজরাট শস্য-শ্যামলা হয়ে উঠেবে হয়তো কিন্তু গঙ্গা পদ্মার পানি প্রবাহ কমবে। বাংলাদেশে মরু বিস্তার দ্রুতায়িত হবে। সম্প্রতি দিল্লীতে ইন্ডিয়া ওয়াটার ফোরামের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বৈঠকে ভারতের পানি সম্পদমন্ত্রী উমা ভারতী জানিয়েছেন, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন ছাড়া ভারতের কোনো গতি নেই। প্রাথমিকভাবে ভারতের লক্ষ্য, মানস-সংকোশসহ ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা। স্মরণ করা যেতে পারে, বাংলাদেশের পানির প্রধান উৎস ব্রহ্মপুত্র। উভয় মওসুমে সবচেয়ে বেশী পানি আসে ব্রহ্মপুত্রে থেকে। ভারত বহুদিন ধরে ব্রহ্মপুত্রের পানি সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সেটা সম্ভব হবে। উজান থেকে ব্রহ্মপুত্রের পানি টেনে নেয়া হলে বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে পানি বঞ্চনার শিকার হবে। ওদিকে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের কাজও চলছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে মেঘনা অববাহিকা মারাত্মক পানি সংকটে পড়বে। এভাবে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের সব নদী ও অববাহিকা থেকে পানি সরিয়ে নিলে কী বিপর্যয় নেমে আসবে বা আসতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
যখন বাংলাদেশকে পানিতে মারার সবরকম ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত চলছে তখন সরকার নিরব, রাজনৈতিক দলগুলো নিশ্চুপ, বিশেষজ্ঞ ও বিদ্বত সমাজ রুদ্ধবাক। বিস্মত হতে হয় যে, এ নিয়ে কারো কোনো উদ্বেগ-বিচলন নেই। জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে এহেন অমনোযোগ ও অবহেলা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আমরা আশা করবো, পানির বিষয়টি অন্যান্য সকল বিষয়ের ওপর স্থান দেয়া হবে। গোটা জাতিকেই এ ব্যাপারে সতর্ক ও সোচ্চার হতে হবে। যে কোনো প্রচেষ্টায় পানির নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন