আফতাব চৌধুরী
শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিক সংহতির দিন হল মে দিবস। আজকের মে দিবস বিশ্বায়ন ও উদার অর্থনীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের শপথ নেয়ার দিন। লগ্নি-পুঁজির প্রচ- দাপটে বিশ্বের তাবৎ শ্রমজীবী মানুষ আজ বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত। পুঁজিপতিদের প্রকৃত রূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ইস্তাহারে বলেছিলেনÑ ‘নিজেদের তৈরি করা পণ্যের জন্য অবিরত প্রসারমান এক বাজারের তাগিদে বুর্জোয়া শ্রেণী সারা পৃথিবীময় ছুটে বেড়ায়। সর্বত্র তাদের প্রবেশ করতে হয়, চেপে বসতে হয়, স্থায়িত্ব লাভের আশায় দুনিয়ার কোণে কোণে সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়।’
বিশ্বময় চষে বেড়ানো লগ্নি-পুঁজির দাপটে ও তার সহচর হিসাবে আন্তর্জাতিক অর্থভা-ার, বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নির্দেশে ভূম-লের প্রতিটি উন্নয়নকামী দেশ নিজেদের অর্থনৈতিক দ্বার বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রবেশের জন্য বাধ্য হয়ে খুলে দিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের আগ্রাসনে বিশ্বব্যাপী শ্রমিক শ্রেণী ও সাধারণ জনগণ এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বিশ্বায়ন বৈষম্যকে তীব্র থেকে তীব্রতর করছে। বিশ্বায়নের ফলে ধনী-গরীব দেশগুলোর মধ্যে পার্থক্য ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত ১৯৯০ সালের তুলনায় বর্তমানে প্রায় ৫০টি দেশ সাংঘাতিকভাবে দারিদ্র্যের কবলে পড়েছে। ২৫টি দেশের মানুষ ক্ষুধার যন্ত্রণায় হাহাকার করছেন। বিশ্বায়ন ও উদারীকরণের ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কর্মসংস্থান হচ্ছে না। দেশীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা বিদেশী শিল্পের দাপটে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। লক্ষ লক্ষ কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারী কাজ হারাচ্ছেন। পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ দ্রুত নেমে যাচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছে। গণবণ্টন ব্যবস্থা উঠে যাচ্ছে। উদার নীতির ফলে শ্রমিক-কর্মচারীর ন্যায় ভয়ানকভাবে কৃষকসমাজও আক্রান্ত। কৃষকদের গণআত্মহত্যার মতো হৃদয়বিদারক ঘটনা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। লে-অফ, লক-আউট, কর্মী সঙ্কোচনে উদারীকরণের ফলে পুঁজিপতিরা আরো বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। শ্রমিকদের রক্তস্নাত অর্জিত অধিকারগুলো কেড়ে নিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক লগ্নি-পুঁজির বিশ্বজয়ের দাপটের বিরুদ্ধে ভুবনময় শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্ব গণআন্দোলন এখন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। বিশ্বায়নের প্রবক্তারা কলাকৌশল নিরুপণের জন্য বিশ্বের যেখানেই সভা করছেন সেখানেই গণবিক্ষোভের সম্মুখীন তাদের হতে হচ্ছে। ১৯৯৯ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সিয়াটলে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সম্মেলনে অর্ধলক্ষ লোকের আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ সমাবেশ সংগঠিত হয়েছিল। দেশে দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক গণপ্রতিবাদ পাল্টে দিচ্ছে লাতিন-আমেরিকা। সমগ্র বিশ্বকে চমকিত করে সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বায়নের নাগপাশ ছিন্নভিন্ন করে লাতিন-আমেরিকা একটির পর একটি দেশে আত্মপ্রকাশ করছে বামপন্থী প্রগতিশীল সরকারÑ ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, নিকারাগুয়া। লাতিন আমেরিকার সংগ্রামী মানুষ বর্তমান বিশ্বকে ঘুরে দাঁড়ানোর দিশা দেখাচ্ছে।
১৮৮৬ সালের ১ মে দিবসের আন্দোলনের চারজন মহাসংগ্রামী নেতা ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর ফাঁসির মঞ্চ থেকে বলেছেনÑ এই মুহূর্তে আমরা ফাঁসির মঞ্চে। আমরা । আমরা চারজন। পার্সনস, আগস্ট স্পাইজ, ফিসার, এঙ্গেল। আর কয়েক পল পরে আমাদের শরীরে আর প্রাণস্পন্দন থাকবে না। আমাদের জীবনদীপ নিভিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু আমরা বেঁচে থাকব মে দিবসের আট ঘণ্টার কাজের দাবির সঙ্গে। আমরা বেঁচে থাকব। বেঁচে থাকব সমাজতন্ত্রের সংগ্রামের জন্য। আমরা বেঁচে থাকব লক্ষ-কোটি মানুষের চেতনা ও অধিকার বোধের সঙ্গে।
আমি পার্সনসÑ হে আমেরিকার মানুষ, আমি বলার অনুমতি চেয়েছিলাম। জনগণের কণ্ঠস্বর ধ্বনিত করতে চেয়েছিলাম।
আমি আগস্ট স্পাইজÑশাসকরা আমাদের টুঁটি টিপে ধরেছে। কিন্তু এমন দিন আসবে যে দিন আমাদের নীরবতা কণ্ঠস্বরের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেবে। এ মুহূর্তে আমাদের চোখের সামনে স্রোতের মত প্রবাহিত হচ্ছে আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে শ্রমিকদের একের পর এক ক্রমবর্ধমান সংগ্রাম। এক একটা মিছিল যেন মানুষের মহাসাগর। পাহাড়ে ঝরণা ধারা যেমন একের পর এক স্রোতকে মিলিত করে মহাসাগরের দুরন্ত পানিরাশিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠিক তেমন করেই সংগ্রামের ছোট ছোট প্রবাহ মিলিত হয়েছিল শিকাগো শহরের মহামিছিলে। আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে উত্তাল আমেরিকা। শিকাগো তার প্রাণভোমরা। জার্মান, পোল, রুশ, আইরিস, ইতালীয়, বোহেমিয়, নিগ্রো, ক্যাথলিক, প্রোটেস্টান্ট, ইহুদি, আনার্কিস্ট প্রজাতন্ত্রী, কমিউনিস্ট, গণতন্ত্রী, সোস্যালিস্ট জাতি-বর্ণ-ধর্ম ও ভাষা নির্বিশেষ শ্রমিকদের দিগন্তজোড়া সেই মিছিল।
সে দিন ছিল শনিবার, ১ মে। ১৮৮৬ সাল। যন্ত্রের চাকা বন্ধ। চিমনির কালো ধোঁয়া উড়ছে না। কারখানা সব খোলা কিন্তু শ্রমিকহীন। উৎপাদনের হাতিয়ার শ্রমিকরা কারখানার ভিতরে নেই। রাস্তায় মহামিছিলে। যানবাহনের চাকা বন্ধ। আমরা জনগণের কণ্ঠে কথা বললাম। ইংরেজি, বোহেমীয়, জার্মান, পোলিস ভাষায় আমাদের কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে গেল ইথারে ইথারে। জনকণ্ঠে ধ্বনিত হল ‘চূর্ণ কর দাসত্ব, জয় কর ভয়।’ ‘রুটিই তো স্বাধীনতা।’ ‘স্বাধীনতা রুটি।’
সকাল বেলা থেকেই সলতে না-পাকালে সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালানো যায় না। ১৮৮৬ সালের ১ মে-র মিছিলের আগে তেমনই ছিল পূর্ব প্রস্তুতি। কাজ হতো সূর্যোদয় থেকে সূূর্যাস্ত পর্যন্ত। ১৪, ১৬, ১৮ এমনকি ২০ ঘণ্টা কাজ। কোনো কোনো সংবাদপত্রে লেখা হয় মিশর দেশের ক্রীতদাস প্রথার চেয়েও দুঃসহ অবস্থার মধ্যে রুটি কারখানার কারিগররা বছরের পর বছর কাটিয়ে থাকেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গড়ে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা খাটতে হয়। সেটা ১৮৩৪ সাল। তখন রুটি কারখানায় ধর্মঘট চলছিল। তার অনেক আগে ১৮০৬ সালে ফিলাডেলফিয়ার ধর্মঘটী জুতা শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘট হয়েছিল। ১৮২০ সাল থেকে ১৮৪০ সাল গোটা আমেরিকার তল্লাটজুড়ে শুরু হয়েছিল ধর্মঘটের পর ধর্মঘট। তখন দাবি ছিল ১০ ঘণ্টা কাজের। ধর্মঘট করেছিলেন গৃহনির্মাণ শিল্পের শ্রমিকরা। এর মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় দুনিয়ার প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন ১৮২৭ সালে। ফিলাডেলফিয়ায় গড়ে উঠে ‘সিকানিক’-এর ইউনিয়ন। ১০ ঘণ্টার দাবিতে প্রথম সফলতা আসে ১৮৩৭ সালে রাষ্ট্রপতি ভ্যানবুয়েনের আমলে সরকারি কাজে যুক্ত শ্রমিকদের জন্য। ক্রমে কয়েকটি শিল্পেও এই দাবি স্বীকৃত হয়। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পরে ১৮৬৪-৬৫ সালে শ্রমিক আন্দোলন আরো তীব্র ও জঙ্গি হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন তার একটা বক্তৃতায় বলেন, ‘যা কিছু শ্রমিকদের ক্ষতি করবে আমেরিকার প্রতি তা বিশ্বাসঘাতকতা। দুটোর মধ্যে কোনো পার্থক্য তাই করা যায় না। যদি কেউ বলে যে সে আমেরিকাকে ভালোবাসে কিন্তু শ্রমিককে ঘৃণা করেÑ সে একজন মিথ্যাবাদী। যদি কেউ বলে সে আমেরিকাকে বিশ্বাস করে কিন্তু শ্রমিককে ভয় পায় তাহলে সে একজন নির্বোধ।... শ্রমিকরা যখন ইচ্ছা ধর্মঘট করতে পারে এমন একটা শ্রম ব্যবস্থা দেখে আমি খুশি।’
কিন্তু পুঁজিপতিরা তখন রক্তের স্বাদ পেয়ে গেছে। শ্রম ঘণ্টা চুরি করেই তাদের মুনাফা। তারই অনুষঙ্গ হিসেবে এল পুলিশ এবং গুলি। রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে গেল শ্রমিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যে ধর্মঘট ভাঙার জন্য জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে নবসাজে সজ্জিত করা হল। গড়ে উঠল ধর্মঘট ভাঙার সবচেয়ে শক্তিশালী ও হিংস্র সংস্থা ‘পিং কার্টন’। এরা পুঁজিপতিদের গু-া ভাড়া দিত। ভাড়া নিত বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও পুঁজিপতিরা। এরা ধর্মঘট ভাংত ও গুপ্তচরগিরি করত। প্রকাশ্যেই বলত যন্ত্র এবং শ্রমিকের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ফলে যন্ত্রের কাজ বেশি বলে তাকে বিশ্রাম ও মেরামতির জন্য সময় দিতে হয়। কিন্তু যেহেতু তাদের কাছে মানুষ বা শ্রমিকের দাম কম, বেকারত্বের জন্য সহজেই এদের ভাড়া পাওয়া যায়। তাই অসুখের চিকিৎসা বা বিশ্রামের জন্য সময় দেয়া হত না। তারা বলত এমন শক্তি এ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা দরকার যা তারা বংশানুক্রমিকভাবে মনে রাখবে। বলা হতো এদের উপর হাত গ্রেনেড ছোড়া উচিত। মালিকদের এই আক্রমণের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল সংবাদপত্রগুলো। পুঁজিপতিদের একজন পালের গোদা জে গোল্ড। তিনি দম্ভভরে ঘোষণা করেছিলেন, ‘শ্রমিক শ্রেণীর অর্ধেকটা আমি ভাড়া করতে পারি বাকি অর্ধেককে খুন করার জন্য।’
ফাঁসির মঞ্চে আমরাই প্রথম নই। ১৮৭৫ সালে ১০ জন জঙ্গি শ্রমিককে ফাঁসির কাষ্টে লটকে দেয়া হয়েছিল। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠল সংগঠন। ১৮৬৬ সালের ২০ আগস্ট বাল্টিমোরের ৬০টি ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা মিলিত হয়ে গঠন করেন ‘ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন’। আমেরিকার শ্রমিকদের জন্য প্রথম গড়ে উঠল দেশজোড়া সংগ্রামের সাধারণ মঞ্চ। ওই প্রতিষ্ঠা সভাতেই প্রথম প্রস্তাব নেয় ‘এই দেশের শ্রমিককে পুঁজিবাদী দাসত্বের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য প্রথম ও বিরাট প্রয়োজন এমন একটা আইন পাস করা যার ফলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত রাজ্যগুলোতে ৮ ঘণ্টাই যেন স্বাভাবিক কাজের দিন বলে গণ্য হতে পারে। যতদিন এ গৌরবময় ফল অর্জন করতে না পারি ততদিন আমরা আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগের সংকল্প নিচ্ছি।
এরপরে ১৮৭৮ সালের ৭ অক্টোবর তৈরি হল ‘ফেডারেশন অব অর্গেনাইজড ট্রেডস অ্যান্ড লেবার ইউনি য়ন অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অব কানাডা’। ১৮৮৬ সালে এদের নাম বদল হয় ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার।’ জন্মলগ্নেই এরা প্রস্তাব নেয় ১৮৮৬ সালের ১ মে থেকে সারা দেশের শ্রমিকরা আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে লড়াই করবে।
প্রস্তুতি চলল সারা দেশব্যাপী। সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিককেও সংগঠিত করার স্লোগান উঠল। এক বছরের মধ্যেই এদের সংগঠিত শ্রমিক সদস্য ১ লক্ষ থেকে ৭ লক্ষ ছাড়িয়ে গেল। ১৮৮৬ সালের বসন্তকালে আমেরিকার বড় বড় ধর্মঘট ও বিক্ষোভ-মিছিলে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ শ্রমিক অংশ নেন। এর অর্ধেকের বেশি ১ লক্ষ ৮৫ হাজার শ্রমিক আট ঘণ্টার কাজের অধিকার আদায় করেছিল। এ ছাড়া ২ লক্ষ শ্রমিকের কাজের সময় কমে ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা হয়েছিল।
আমি পার্সনসÑ আজ থেকে দশ বছর আগে যোগ দিয়েছিলাম সমাজতন্ত্রের আদর্শে গঠিত সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে। লুসি এলডিন গেঞ্জেলস আমার সহকর্মী, আমার স্ত্রী। আমার স্ত্রী আমেরিকান নন। তিনি মেক্সিকান। আমেরিকার আদিম অধিবাসী। যাদের রেড ইন্ডিয়ান বলা হয়, তাদেরেই একজন। আমার ছেলে অ্যালবার্ট আর মেয়ে লুলু। আমার বয়স এখন আটত্রিশ। আমি শিকাগো আট ঘণ্টা লিগের রেকর্ডিং সম্পাদক। আমি ছিলাম ‘অ্যালার্ম’ পত্রিকার সম্পাদক। আমার স্ত্রী আমার মতই মার্কসবাদে দীক্ষিত। তিনি ছিলেন শ্রমিক আন্দোলনের একজন সংগঠক।
শাসক শ্রেণী কত হিংস্র হতে পারে তা আমি দেখেছিলাম নিউইয়র্কের টমকিন স্কোয়ারে পুলিশ বর্বর আক্রমণ চালালে আর দেখলাম আমার ফাঁসির ঠিক আগে। আমি আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে উপস্থিত রাখার অনুরোধ জানিয়েছিলাম কর্তৃপক্ষের কাছে। ওরা উপস্থিত হয়েছিল ঠিকই। তবে তাদের রেখে দেয়া হয়েছিল রুদ্ধ কারা অন্তরালে। আমি তাই আমার সন্তানদের শেষবারের মত দেখতে না পেয়ে তাদের জন্য রেখে গেলাম এক পৃথিবী মানুষ।’
এই সময় প্রকাশিত সংবাদপত্রগেুলোতে এই সত্য প্রতিফলিত হয়নি। খবরের কাগজগুলো লিখেছিল যে, এরা হল আসন্ন ভূমিকম্পের সহচর কমিউনিস্ট। আমেরিকায় অ্যাবলিশনিস্ট নামে এক আতঙ্কজনক রোগের আবির্ভাব হয়েছিল। সংবাদপত্রে লেখা হতো যে, ‘কমিউনিস্ট’ শব্দটা অ্যাবলিশনিস্ট রোগের মতই এবং তা যাতে ছড়িয়ে না পড়ে।
সমগ্র আমেরিকায় শুরু হয়ে গেছে আট ঘণ্টার উন্মাদনা। যে সকল কারখানায় আট ঘণ্টার দাবি আদায় হয়েছে সেখানে এই আট ঘণ্টার নামকরণের জিনিসপত্র চালু হয়ে গেল। আট ঘণ্টার জুতো, আট ঘণ্টার চুরুট। আট ঘণ্টার জুতো পরে, আট ঘণ্টা চুরুট মুখে নিয়ে মিছিলে মিছিলে শুরু হল গানের ঝঙ্কার। কলকারখানা আর জাহাজের খালে খোলে মজুররা হাঁকছেÑ সপ্তাহে ছ’দিন। শ্রম আট ঘন্টা, বিশ্রাম আট ঘণ্টা, বাকি আট ঘণ্টায় আমরা স্বাধীন।
১৮৮৬ সালের ১ মে। আমরা জানি আমাদের আত্মদানের উৎস ধারায় একদিন সারা দুনিয়ায় মে দিবস উদযাপিত হবে। প্রত্যেক জাতি বা ধর্মের নিজস্ব উৎসব আছে। কিন্তু জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে পালিত হবে শ্রমিক শ্রেণীর নিজস্ব উৎসবÑ মে দিবস।
আমরা জানি মুক্তির মন্দির সোপানতলে বলিপ্রদত্ত আমরা। আমরা চারজন। আমরা জানি ভবিষ্যতে দেশ ও কালের সীমা অতিক্রম করে মে দিবস উদ্যাপিত হবে চির নতুনের ডাক দিয়ে। এ দিন শ্রমিকরা নিজের শিল্পের, নিজের দেশে, সারা পৃথিবীর এবং শ্রমিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অর্জিত অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে সংগ্রামকে আরো উন্নত করার রণকৌশল ঘোষণা করবে। মে দিবসে শ্রমিকরা শপথ নেবে নিজের শ্রেণীর, নিজের দেশ এবং গোটা দুনিয়াকে বদলে দেবার। সেই সূচনা। সূচনা হল দিনবদলের পালা।
১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা দিবস সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় যে, ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছর ১ মে পৃথিবীর সমস্ত দেশে শহরে শ্রমিক দিবস হিসেবে উদযাপিত হবে। পুঁজি একটি আন্তর্জাতিক শক্তি। তার বিরুদ্ধে দুনিয়াজোড়া শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশের দিন মে দিবস। দিনবদলের আলোকবর্তিকা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস- মে দিবস।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন