শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের অনুমোদন

| প্রকাশের সময় : ১৫ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

খেলাপী ঋণ, কু-ঋণ, অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জমান ব্যাংকিং সেক্টরকে স্বচ্ছ ও গতিশীল ধারায় ফিরিয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের বদলে মেয়াদের শেষ সময়ে এসে সরকার আবারো রাজনৈতিক বিবেচনায় ৩টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিতে যাচ্ছে বলে গতকাল একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকিং সেক্টরের বিদ্যমান বাস্তবতায় আর কোনো নতুন ব্যাংকের অনুমোদন না দেয়ার যৌক্তিক অবস্থান ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের জন্য শতাধিক নতুন ব্যাংকের জন্য আবেদন জমা পড়েছিল। সে সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন ব্যাংকের অনুমোদন না দিতে সরকারের কাছে যে সব বাস্তবসম্মত যুক্তি তুলে ধরেছিল সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী(মরহুম) সাইফুর রহমান তাতে সম্মত হওয়ায় নতুন ব্যাংক অনুমোদন থেকে বিরত থাকে সরকার। শুরুতে মহাজোট সরকারও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত অবস্থান সমর্থন করেছিল। তবে সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের চাপে তারা অবস্থান বদল করে। ২০১০সাল থেকে বেসরকারী নতুন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিতে শুরু করে সরকার। ২০১৩ সালে এক বছরেই ৯টি নতুন ব্যাংক অনুমোদন পেয়ে যাত্রা শুরু করে। এসব ব্যাংকের কোনোটিই বিনিয়োগ বা সেবার ক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাতে কোনো সু্িবধাজনক অবস্থান তৈরী করতে পারেনি। মাত্র ৫ বছরের মধ্যেই ব্যাংকগুলো হাজার হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের ভারে কাহিল হয়ে পড়েছে। সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাবাধীন ও ব্যবস্থাপনায় সরকারী-বেসরকারী পুরো ব্যাংকিং সেক্টর বড় ধরনের সংকটে পড়ে গেলেও সংকট নিরসনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ফার্মাস ব্যাংক দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে এক কল্ঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টি করেছে। খেলাপি ও ক-ুঋণে দেউলিয়া ব্যাংকটিকে রক্ষায় সরকারী চারটি ব্যাংক ও আইসিবি থেকে শত শত কোটি টাকার যোগান দিয়েও এর স্বাভাবিক গতিশীলতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ব্যাংকের মূলধনসহ গ্রাহকদের আমানতও লোপাট হয়ে যাওয়ায় এখন গ্রাহকদের আমানতও ফেরত দিতে পারছেনা ব্যাংকটি। এমনিতেই দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে এক ধরণের আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। ফার্মাস ব্যাংকের বেশুমার লুন্ঠন সে অনাস্থা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ইতিপূর্বে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দেশের বৃহত্তম সরকারী ব্যাংক সোনালী ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাওয়ার ঘটনার ধারাবাহিকতায় অন্যান্য সরকারী ব্যাংকেও হাজার হাজার কোটি টাকার খোলাপি ঋণ ও কু-ঋণের সাজানো নাটকের ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। এমনকি, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকেও বৈদেশিক মূদ্রায় শত শত কোটি টাকা লোপাট হওয়ার মত নজিরবিহিন ঘটনাও ঘটেছে। ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে যে ধরনের কার্যব্যবস্থা গ্রহণের দরকার ছিল সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা লুন্ঠনের মাধ্যমে দেশের বিনিয়োগ ও ব্যাংকিং সেক্টরে আস্থার সংকট সৃষ্টির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দৃষ্টান্ত না থাকায় গত দুই বছরে দেশে খেলাপি ঋণ ও ব্যাংকিং সেক্টরের দেউলিয়াত্ব আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে।
দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, শিল্পায়ণ ও সেবাখাতের অগ্রগতিতে ব্যাংকিং সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। সেখানে সরকারী-বেসরকারী ব্যাংকগুলো নানাবিধ সঙ্কটে জর্জরিত। ব্যাংকিং সেক্টরে বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা দূর করে স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্যোগ ও নির্দেশনা জারি করলেও ব্যাংক পরিচালনায় রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অগ্রাহ্য করার কারণে তার উদ্যোগ সফল হয়নি। রাজনৈতিক বিবেচনায় অন্তত ১৫টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ার সিদ্ধান্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিরোধিতাও ধোপে টিকেনি। সরকারী-বেসরকারী বড় ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনায় রাজনৈতিক বিবেচনায় বড় ধরনের রদবদল, মালিকানার পরিবর্তনসহ নানাবিধ উদ্যোগে পুরো সেক্টরে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ক্ষেত্রে অসহায় অথবা সরকারের আজ্ঞাবহ ভ‚মিকা পালন করেছে। দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে মন্দা, বৈদেশিক বিনিয়োগে কোনো সুখবর নেই। বাণিজ্য বৈষম্যও বেড়ে চলেছে। দেশে সম্পদের বৈষম্যও বেড়ে চলেছে। অর্থাৎ ধনী আরো ধনী এবং দরিদ্র অতি দরিদ্রে পরিনত হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ওয়েল্থ এক্স এর ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা ওয়েল্থ রিপোর্ট-২০১৮-এ বিশ্বের সব ধনী রাষ্ট্রকে পিছনে ফেলে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির হারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রথম স্থান লাভ করেছে। যেখানে জাতীয় অর্থনীতিতে তেমন কোনো সুবাতাস নেই সেখানে টাকা লোপাট হয়ে একদিকে ব্যাংকগুলো দেউলিয়া ও খেলাপি ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে টাকা পাচার অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকিং সেক্টরকে গতিশীল, বিনিয়োগবান্ধব ও গ্রাহকদের জন্য আস্থাশীল করতে ব্যর্থ হয়েছে। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ার অর্থ হচ্ছে, আরো কিছু ব্যক্তিকে জনগণের সম্পদ লুন্ঠণ এবং জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা পাচারের পথ করে দেয়া। দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্রান্তিকালে এ ধরনের সিদ্ধান্ত সমর্থনযোগ্য নয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন