মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

মার্কিন রাজনীতি : সাবেক রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

প্রকাশের সময় : ৩ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আবদুল আউয়াল ঠাকুর

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী হিসেবে হিলারি ক্লিনটন ও রিপাবলিকান দলের প্রার্থী হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পই মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। নির্বাচনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের নিজস্ব বিষয় হলেও নানা কারণে বিশ্বজুড়ে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। এ নির্বাচন কেন বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা রয়েছে। এ নিয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ ও মত রয়েছে। সময় ও বাস্তবতা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসবেও পরিবর্তন এসেছে। এবার নির্বাচনের আগেই কোনো কোনো প্রার্থী বিশ্বজুড়ে সমালোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছেন। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং জাতিসংঘের মহাসচিবও এ নিয়ে কথা বলেছেন। বিদ্বেষ ছড়াতে বারণ করেছেন। এটা বলা দরকার, রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বুশের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বে যে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে তা মোকাবিলায় ডেমোক্র্যাটরা বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যে বুদ্ধিদীপ্ত এবং কৌশলী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তার সুফল পেতে শুরু করেছে মার্কিনিরা। বিশেষভাবে লক্ষণীয় হচ্ছে, এই পরিবর্তনের মূল সূত্র অনুসন্ধান করে যে বিশেষ ব্যবস্থা ওবামা প্রশাসন নিয়েছে তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে রিপাবলিকানরা। এবার নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ে এই বিভাজনের রেখা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সুনির্দিষ্ট করেই বলা যায়, ৯/১১এর ঘটনায় টুইন টাওয়ারের ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই মূলত চাপা পড়ে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ করে সিআইএর সাথে মোশাদের গোপন আঁতাত। এখানটাতেই অনেক বেশি পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সেটাই ধরা পড়েছে এবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দুই দলের ক্যাম্পেইনে। এর প্রভাব কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয় বরং বিশ্বের অনেকাংশেই পড়ছে বা পড়তে শুরু করেছে।
বিশ্ব পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জার্মানিতে পুনরায় বলেছেন, মুসলমানসহ সবাইকে স্বাগত জানালে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র আরও নিরাপদ হবে। এর আগে ব্রিটেনে যুবকদের সাথে মতবিনিময়কালে ইসলাম ধর্মকে যারা বিকৃত করছে তাদের সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে চরমপন্থা মোকাবিলায় আমাদের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য রয়েছে, যেখানে মুসলিম আমেরিকানরা আমাদের সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি আরো বলেছেন, ইসলাম বিদ্বেষ কেবল ভুলই নয়, বাস্তবিক অর্থে এটা আত্মপরাজয়মূলক আচরণও। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, মুসলমানদের সম্পর্কে ভাষা ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে এবং লোকজনদের ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট এমন এক সময়ে এমন সব দেশে এসব আহ্বান জানালেন যখন কোনো কোনো মহল মুসলমান নাম শুনলে বা আরবি ভাষা শুনলেই অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে। এমনকি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্পও বেছে নিয়েছেন ইসলাম ও মুসলমান বিদ্বেষকে। ঠিক সে সময়ে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে স্যান্ডার্স কিন্তু আঘাত হেনেছেন বিশ্বসংঘাতের মূল হোতা ইহুদিদের ওপর। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, আমরা যদি ন্যায়বিচার ও শান্তির অন্বেষণ করে থাকি তাহলে একটা সময় আসবে যখন আমাদের বলতে হবে যে, নেতানিয়াহু (ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী) সব সময় সঠিক নন। যদি শান্তি চাই তাহলে ফিলিস্তিনিদের শ্রদ্ধা ও মর্যাদার সাথে বিবেচনা করতে হবে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, তার কথা শেষ না হতেই উপস্থিত দর্শকদের জোর উচ্ছ্বাস আর মুহুর্মুহ করতালিতে ছিল এক ভিন্নবার্তার ইঙ্গিত। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় তিনি আরো বলেছেন, আমাদের আর একতরফা থাকলে চলবে না। এ ইস্যুতে পক্ষ আছে দুটো। প্রার্থী দৌড়ে স্যান্ডার্স টিকে থাকতে না পারলেও তার এ কথার মধ্য দিয়ে কার্যত ডেমোক্র্যাটদের আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন ঘটেছে। এ কথার মধ্য দিয়ে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, তারা মুসলমানদের রক্ষার জন্য মাঠে নেমেছেন বা মুসলমানদের রক্ষার জন্য তাদের কোনো প্রয়োজন রয়েছে। মুসলমানদের টিকে থাকা বা বিজয়ের মূল চাবিকাঠি হচ্ছে পবিত্র কোরআন ও রাসূল (সা.) বর্ণিত বিধান। যেভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল বলেছেন, যতদিন মুসলমানরা আল্লাহর কোরআন ও রাসূলের সুন্নত আঁকড়ে থাকবে ততদিন তাদের পতন নেই। সততা এবং আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থাই হচ্ছে মুসলমানদের টিকে থাকার পথ ও পদ্ধতি। দুনিয়াজুড়ে মুসলমানরা যখন শাসন করেছে এবং অন্যদের সভ্য বানিয়েছে তখনকার পর্যালোচনায় গেলে একজন শাসকও পাওয়া যাবে না যারা মিথ্যাশ্রয়ী ছিলেন। আজকের দুনিয়ায় মিথ্যাশ্রয়ী গোয়েন্দা ব্যবস্থার প্রবর্তনের কিছু মাশুল হয়তো মুসলমানদের দিতে হচ্ছে, তবে অবশ্যই তা সাময়িক। একজন সালাউদ্দীন আইয়ূবিই যথেষ্ট। তাহলে হয়তো ট্রাম্পরা বুঝতে পারত কত ধানে কত চাল। সে আলোচনা আজকের বিষয়বস্তু নয়। আলোচনার এবং বোঝার বিষয় হচ্ছে মার্কিন নির্বাচনে মার্কিনিদের রাজনীতির শত্রু-মিত্রের প্রসঙ্গে যে ইসরাইল ইস্যু উঠেছে এর মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, তাদের নিজেদের বাঁচার জন্য ভুল শোধরানো জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। যে বিশেষ ইহুদি চক্র মার্কিন প্রশাসন বিশেষ করে সিআইয়ের সাথে একাট্টা হয়ে একই ঢিলে মার্কিনি এবং দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি করতে চেয়েছিল তাদের হাত থেকে তারা মুক্তির পথ খুঁজছে।
বিষয়টি বিদ্যমান বাস্তবতাতেও দৃশ্যমান। গত কয়েক বছরের মার্কিন কূটনীতি যদি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে, অতীতের তুলনায় মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। এক্ষেত্রে সফলতার মাত্রাও কম নয়। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বুশের নির্দেশনায় তৈরি করা সিআইয়ের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে ইরাক-আফগানিস্তানে আক্রমণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া হিসেবে মার্কিন অর্থনীতি প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ছিল। অন্যদিকে মার্কিনিরা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল। তাদের কথিত তথাকথিত জঙ্গি তত্ত্ব যখন নিজ দেশে এবং জাতিসংঘে হাস্যকর বাস্তবতায় পরিণত হয়েছিল তখন নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন ও ইমেজ পুনরুদ্ধারের বিবেচনা থেকেই মার্কিন জনগণ নির্বাচিত করেছিল বারাক ওবামাকে। সময়ের বিবেচনায় বলা যায়, প্রেসিডেন্ট ওবামা অনেকটাই সফল। অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনার উদ্যোগের মধ্য দিয়ে মার্কিন অর্থনীতিতে যতটুকু ইতিবাচক পরিবর্তন তিনি আনায়ন করতে পেরেছেন তার চেয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইমেজ প্রতিষ্ঠায় তার সফলতা অনেক বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক সময়ের পুরনো বন্ধু ইরানের শাহের পতন ও আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে বিল্পবের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট কার্টারের আমল থেকে ইরানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে শীতলতম সম্পর্ক চলছিল প্রেসিডেন্ট ওবামার আমলে তার অনেকখানি অবসান হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে কোনো ধরনের রক্তপাত ছাড়াই পরিস্থিতির অনেকখানি গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। মার্কিন কূটনীতির অনেক বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে মিয়ানমারে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে দীর্ঘ পাঁচ দশক পর গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতিষ্ঠায়। মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘসহ যেসব আন্তর্জাতিক মহল একান্ত ঐকান্তিক ও নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা চালিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মধ্যে অন্যতম। সেখানকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইস্যুর কোনো সমাধান এখনো হয়নি। তবে এ ব্যাপারে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি যেহেতু মানবাধিকার সংরক্ষণের পক্ষে তাই আশা করা অনুচিত নয় যে, সন্তোষজনক ও ন্যায়ানুগ সমাধানই করতে হবে দেশটির নয়া কর্ণধার অং সান সু চিকে। অন্যদিকে ইরানের সাথে নয়া মার্কিন সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় সৌদি আরবের সাথে সম্পর্কের যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে তা নিরসনেও প্রেসিডেন্ট ওবামা সেখানে পৌঁছে গিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ওবামার অন্যতম বড় সফলতা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে প্রতিবেশী কিউবার সাথে সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়টি। তিনি সেখানে গিয়েও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন। এটাই হয়তো বাস্তব যে, ইহুদি চক্রান্ত সম্পর্কে সতর্ক অবস্থানের কারণেই হয়তো তার কূটনৈতিক সফলতা কিছুটা হলেও হয়েছে। এই বিবেচনাকে সামনে রেখে বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত হাওয়ার্ড শেফারের অভিমত বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য বহু দেশের সঙ্গে ভারতের পার্থক্য হচ্ছে, ভারত চায় কোনো সমালোচনা ছাড়াই আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকুক। ২০১৪ সালে যেভাবে বাংলাদেশের নির্বাচন হয়েছিল তারও তারা কোনো সমালোচনা করেনি। এই আলোচনায় ভারতের সাথে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের বিষয় তিনি মনে করেন ভারত শেষ পর্যন্ত আমেরিকাকেই হয়তো বেছে নেবে।
ভারত আমেরিকা সম্পর্ক এখন কোন মাত্রায় রয়েছে বা এ সম্পর্কের পরিণতি কোনদিকে গড়াবে সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে অবশ্যই বিবেচনায় রয়েছে দুই দেশের সাম্পর্কিক দৃষ্টিভঙ্গি কি অভিন্ন? আমেরিকা যেখানে তার প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্কোন্নয়নে উদগ্রীব ভারত সেখানে প্রতিবেশী দেশের ওপর আধিপত্য বিস্তারে উৎসাহী। যে নির্বাচনের কথা সাবেক রাষ্ট্রদূত উল্লেখ করেছেন তা নিয়ে এযাবৎকাল বিস্তর ও বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। ওই নির্বাচনের শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলে আসছে এটি কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নয়। শুরু থেকে এ পর্যন্ত একই ভাষায় বলে আসছে যে বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জরুরি। ভারতের সাবেক কংগ্রেস সরকার যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বাংলাদেশের ২০১৪ সালে অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনকে সমর্থন করে থাকুক না কেন বর্তমান সরকারের অবস্থান তার থেকে খুব একটা পাল্টেছে সে কথা বলা যাবে না। সে অর্থে মার্কিনিরা যদি সম্পর্ক বলতে জনগণের সাথে জনগণের কথা বুঝিয়ে থাকে তাহলে ভারতীয়রা বুঝাচ্ছে জনগণের বিপরীত সম্পর্ক। অবশ্যই এটা বোঝার সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে যে, আধুনিক বিশ্বে কখনই জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না এবং তা একদিকে যেমনি স্থায়ী হয় না অন্যদিকে এ থেকে কার্যকর কোনো সুফলও পাওয়া সম্ভব নয়। কেবলমাত্র বাংলাদেশকে নিয়েই নয় বরং ভারত তার অন্য প্রতিবেশীদের সাথেও একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করছে। সে কারণেই হয়তো সাবেক রাষ্ট্রদূত মনে করছেন ভারত হয়তো চীনের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রকেই অধিকতর পছন্দ করবে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক দুই দেশের সরকারের মধ্যে কোন পর্যায়ে রয়েছে সেটি মূলত সরকারি ভাষ্য। সাধারণের বিবেচনায় বাংলদেশের জনগণের সাথে ভারতের সম্পর্ক সর্বশেষ তলানীতে ঠেকেছে। কেবল যৌথ নদ-নদী থেকে বাংলাদেশের পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়া বা সীমান্তে নির্বিচার বাংলাদেশিদের হত্যার কারণেই এমনটা হয়েছে তা নয় বরং ২০১৪ সালের নির্বাচন ও গত কয়েক বছরে এত কিছু ঘটেছে বা ঘটছে যার ফলে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে জনগণের সম্পর্কের যে কথা বলা হয় তা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। প্রাসঙ্গিকতায় সিকিম-ভুটানের কথা না তুলেও নেপালের সাম্প্রতিক আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক নয়। ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল নেপালের জনগণ। নেপালের জনগণের প্রতিরোধ ভারতের আগ্রাসী নীতির মুখোশ উন্মোচিত করেছে। একটি ল্যান্ডলকড কান্ট্রি হিসেবে ভারত নেপালের ওপর যে ধরনের দাদাগিরি ফলাতে চেয়েছিল তার পরিণতি হচ্ছে নেপাল এখন বিকল্প বন্ধু হিসেবে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এটা মূলত অস্তিত্বের প্রয়োজনেই বাস্তবতার আলোকে করতে হয়েছে বা হচ্ছে। মার্কিনিরা যেখানে ইহুদিপ্রভাবমুক্ত হয়ে নিজ দেশে মুসলিমদের সাথে সম্পর্ক গড়ার তাগিদ অনুভব করছে সেখানে ভারতীয়রা মুসলমানসহ অন্যদের প্রতি অমানবিক আচরণের রেকর্ড করতে ব্যস্ত। তাদের হিন্দুত্ববাদী আচরণ ক্ষুব্ধ করে তুলেছে ভারতের সকল মানুষকে। সেখানকার বর্ণবাদী ও বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে সকল নির্যাতিত শ্রেণী-পেশার মানুষ। সে বাস্তবতায় বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের বিবেচনায় ভারত-মার্কিন সম্পর্ক অবশ্যই বিশেষভাবে ভাবার রয়েছে। একবার সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা ইনকিলাব অফিসে বেড়াতে এলে তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম প্রতিবেশী একটি দেশের সরকারের বাংলাদেশের সরকারের অগণতান্ত্রিক কর্মকা-ে দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের পরেও কি আপনি মনে করেন বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব? পুরো উত্তর তিনি না দিয়েও বলেছিলেন, আমরা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অক্লান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছি। এরপর অনেক পানি গড়িয়েছে। অনেক ঘটনা ঘটেছে। সময় ও বাস্তবতায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশে এখনো গণতন্ত্র তথা জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। উপরন্তু চলমান তৃণমূল নির্বাচন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ভোটের অধিকার নয় গুলিবিদ্ধ হওয়ার অধিকার অর্জিত হয়েছে। অন্যদিকে যে নির্বাচনের কথা বাজারে চালু রয়েছে সে ক্ষেত্রেও এর চেয়ে ভিন্নতর কিছু ঘটবে না বলে বিশিষ্টজনরা মনে করছেন। আর এসবই হয়েছে হতে পারছে মূলত ভারতীয় অন্ধ সমর্থনের কারণে। পরিস্থিতি কতটা গুরুতর আকার ধারণ করেছে তার একটি প্রমাণ হচ্ছে জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার।
বাংলাদেশ মেধা মননে ঐতিহ্যে সংস্কৃতিতে একটি সমৃদ্ধ দেশ। এদেশকে বলা হয় কবির দেশ। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা তো বটেই স্মরণকালের মধ্যেও বোধহয় এ ধরনের কোনো কেলেঙ্কারি হয়নি যে, ভারতীয় বা অন্য কোনো দেশের লেখকের গল্প চুরি করে তা দিয়ে সিনেমা বানানোর পর সেটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হয়েছে। কথিত বৃহন্নলাটি যখন এটিএন বাংলার দেয়ালে টাঙ্গানো ছিল তখনই মনে প্রশ্ন উঠেছিল হিন্দি হরপের আদলে বাংলা বর্ণমালা কেন? কথায় কথায় যারা অনুচর খোঁজেন তাদের চোখের সামনেই এসব টাঙ্গানো ছিল। হয়তো তারা দেখেননি বা দেখতে চাননি। সেটি হয়তো এখন বড় কথা নয়। ভারতীয় কাহিনী চুরি প্রমাণিত হওয়ার পর আভিনেতা রাজ্জাক গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, পুরস্কার বাতিল করার ঘটনা এর আগে কখনো শুনিনি। আমি বলতে চাই, এই ছবির চিত্রনাট্য যখন জমা পড়েছিল তখনই এটা ভালোভাবে দেখার দরকার ছিল। খুব বিস্তৃত আলোচনা করে লাভ নেই। আলোচ্য ছবির জন্য মোটা অংকের রাষ্ট্রীয় অনুদানও দেয়া হয়েছে। এর সাথে যুক্ত ছিল টিভি চ্যানেল এটিএন বাংলা। এটা না বললেও বোঝা যায়, একটি বিশেষ প্রভাবশালী মহল পুরো বিষয়টির সাথে যুক্ত ছিল। সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির পরিচায়ক। নববর্ষে অপসংস্কৃতি বা বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রসঙ্গ এলেই আমাদের কেউ কেউ নানা গন্ধ খুঁজেন। এত বড় জাতীয় কেলেঙ্কারির পর তো টু শব্দটিও শোনা গেল না। এটাই হচ্ছে দাসত্বের নিদর্শন। গলায় যাদের বেড়ি পড়েছে তাদের পক্ষে এটা উদ্বেগের বিষয়। সম্প্রতি এক আলোচনায় প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছেন, ... সফল হতে হলে বন্ধুত্বের প্রতিও চাপ প্রয়োগ করতে হবে। কোথায় কী করলে কীভাবে কেমন করে করা যাবে সেটি বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে, বাংলদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ ও বাস্তবতা তৈরি করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত যা বলেছেন তার বিশ্লেষণ বিবেচনায় নিয়েই সমস্যার দ্রুত ও গ্রহণযোগ্য সমাধান প্রয়োজন।
awalthakur@gmail.com

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন