মিঞা মুজিবুর রহমান
আমাদের দেশে তামাকের তৈরি বিভিন্ন ধরনের বিড়ি-সিগারেট এবং পানের সাথে জর্দ্দা, সরাসরি গুল, আলাপাতা ব্যবহারে সমাজের একটা বিরাট অংশ জড়িয়ে পড়েছে। কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা এই তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করছে। কোন কোন সময় শিশুদের একটা অংশের হাতের সিগারেট বা তামাকের অন্য দ্রব্যও পাওয়া যায়। এসব খাওয়ায় শরীরের চরম ক্ষতি হচ্ছে, কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিড়ি-সিগারেট খেয়ে অনেক সময় কাশতে কাশতে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
তামাক ব্যবহারের কারণে দেশে প্রতিবছর ৫৭ হাজার মানুষের মৃত্যু ও ৩ লাখ ৮২ হাজার মানুষ পঙ্গু হয়ে যায়। ধূমপান বিষপানের চাইতেও মারাত্মক। কারণ বিষপানে জীবনের মৃত্যু ঘটে কিন্তু ধূমপানে মানুষ ধুঁকে ধুঁকে মরে। এতে আর্থসামাজিক ও মানসিক বিপর্যয় ঘটে। এর ফলে ব্যক্তি ও সমাজ সুনিশ্চিত অকল্যাণের দিকে ধাবিত হয়। ধূমপান অন্যান্য নেশার মতো এক ধরনের নেশা। মানুষ কোনো খারাপ ব্যাপারে একবার অভ্যস্ত হয়ে পড়লে তা আর সহজে ত্যাগ করতে পারে না। তাই ধূমপায়ীরা মাদকাসক্ত বা অন্যান্য নেশাখোরদের মতো ক্রমাগত ধূমপান করে যায়। ধূমপায়ীদের মুখে দু’মুঠো অন্ন না জুটলেও তারা এক টুকরা সিগারেটের জন্য পাগলপারা হয়ে যায়। এ নেশা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে অশুভ ফল বয়ে আনে। ধূমপায়ী ও পরো ধূমপানের কারণে উভয়েরই স্ট্রোক, হার্টঅ্যাটাক, হƒদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার, ব্রংকাইটিস, যক্ষ্মা, কণ্ঠনালি ও শ্বাসযন্ত্রের রোগ, হাঁপানিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
অথচ ২০০৫ সালে ধূমপানবিরোধী আইনটি প্রনয়নের পর যত্রতত্র জরিমানার দৃশ্য দেখা গেলেও সেটা এখন আর দৃশ্যমান নয়। তবে এই আইনের প্রভাবে মানুষ এখন প্রকাশ্যে ধূমপান করতে অস্বস্তি ও লজ্জাবোধ করে। এটা জনসচেতনতারই প্রমাণ। পাবলিক প্লেসে প্রকাশ্যে ধূমপানের শাস্তি ৩০০ টাকা করার বিধান রেখে ২০০৫ সালের ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও সংশোধন বিল-২০১৩ সংসদে উপস্থাপন করা হয়। এফটিসি চুক্তিতে ধূমপানে উৎসাহীত হয় এমন কোন পদক্ষেপ না নিতে বলা হলেও আমাদের আইনের দুর্বলতায় সিগারেট কোম্পানিগুলো বিভিন্ন কৌশলে বিনামূল্যে ধূমপানের সুযোগ দিয়ে কিশোর-যুবকদের ধূমপানে উৎসাহিত করছে।
রাস্তার পাশে চাকা লাগানো টং-ঘরের মতো সিগারেটের দোকানগুলোর প্রকাশ্যে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন যেন আমাদের গাঁ-সহা হয়ে গেছে। আমাদের দেশে পান-জর্দার মতো ক্ষতিকর তামাকও প্রকাশ্যে বিক্রি ও সেবন হচ্ছে। আমাদের প্রতিবেশী নেপাল, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় সিগারেটের মোড়কে ভীতিকর ছবি ব্যবহার করা হলেও ভয় প্রদর্শনের এ রকম বিধান আমাদের নেই। দুর্ভাগ্য আমাদের, সিগারেট উৎপাদনকারী বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আমাদের আইনকে দুর্বল করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তাই বর্তমানের সংশোধিত আইনে পাবলিক প্লেসের সংজ্ঞা দেয়া হলেও ধূমপানের জন্য নেই নির্দিষ্ট কোনো এরিয়া। ধূমপায়ীরা তো অনেকটা নেশাগ্রস্তের মতোই। তাহলে আইনে তাদের ধূমপান বা তামাক সেবনের জন্য স্পষ্ট কোন নির্দিষ্ট জায়গার বিধান করে দিতে হবে।
আমাদের বর্তমানের সংশোধিত আইনে পাবলিক প্লেস বলতে বুঝানো হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বায়াত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি অফিস, প্রন্থাগার, লিফট, হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভবন, সমুদ্রবন্দর ভবন, নৌবন্দর ভবন, রেলওয়ে স্টেশন ভবন, দাঁড়ানোর লাইন, খেলার মাঠ, বাস টার্মিনাল ভবন, প্রক্ষাগৃহ, আচ্ছাদিত প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটার হল, বিপনী ভবন, রেস্টুরেন্ট, পাবলিক টয়লেট, শিশুপার্ক, জাতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত মেলা এবং স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক ঘোষিত অন্য যে কোনো পাবলিক প্লেস। পাবলিক প্লেসের সংজ্ঞায় নতুন করে বেসরকারি অফিস অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যা ২০০৫-এর আইনে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পাবলিক প্লেসে ধূমপানের শাস্তি ছিল ৫০ টাকা। বর্তমান আইনে সেটা বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে একই ব্যক্তি দ্বিতীয় বার বা বারবার একই অপরাধ করলে পর্যায় ক্রমিকভাবে দ্বিগুণ হারে অর্থদ-ে দ-িত হবেন। এছাড়া, পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহনের মালিক, তত্ত্বাবধায়ক, নিয়ন্ত্রণকারী বা ব্যবস্থাপক আইন লঙ্ঘন করলে তাকে অনধিক ৫০০ টাকা জরিমানা গুণতে হবে। বিলে গুল, জর্দ্দা, খৈনী, সাদাপাতাসহ চোষণ ও চিবানোর মাধ্যমে গ্রহণ করা তামাকজাত দ্রব্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আসলে বিশ্বে এখন আর ধূমপান নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটা নিষিদ্ধের পর্যায়ে চলে এসেছে। নিউজিল্যান্ড ২০২৫ সালের মধ্যে সে দেশে ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার আইন প্রণয়ন করেছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন দেশের মানুষের জীবন রক্ষার্থে ধূমপানের বিরুদ্ধে কঠোর আইন পাস করেন। ২০১০ সালে ভারতের প্রথম ধূমপানবর্জিত রাজ্যের স্বীকৃতি পায় সিকিম। তামাক চাষ, বিক্রয়, বিতরণ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভুটানে। অটোম্যান সাম্রাজ্যের ঐতিহ্যের প্রতীক হুক্কা এখন তুরস্কে নিষিদ্ধ হলেও আমাদের অভিজাত এলাকায় ক্রমবর্ধমান সীসা আর হুক্কা সেবনের নানারকমের পারলার, লাউজ্ঞ আর ক্যাফের জৌলুস দিন দিন কিন্তু ঠিকই বেড়েই চলেছে।
গবেষকদের মতে শরীরের ক্ষতিকর সিগারেটের চেয়ে অনেক গুণ বেশি ক্ষতি করে জর্দ্দা, গুল ও আলাপাতা। সিগারেটের ধোঁয়ায় শরীরে নিকোটিনের সৃষ্টি হয়। যা মারাত্মক ক্ষতিকর। কিন্তু জর্দ্দা, গুল ও আলাপাতা সরাসরি তামাক খাওয়ায় আরও বেশি ক্ষতিকর। সমাজের একটা বিরাট অংশ পানের সাথে জর্দ্দা দেদারসে খাচ্ছেন। সামাজিকভাবে সিগারেট খাওয়ার বিষয়টি বয়বৃদ্ধদের কাছে দৃষ্টকটু। কিন্তু একই লোকের সামনে পানের সাথে জর্দ্দা খেলে কোন সমস্যা নেই। গুল বা আলাপাতা খেলেও কোন দৃষ্টিকটু দেখায় না। দৃষ্টিকটু না হলে কি হবে, সবচেয়ে ক্ষতিকর জর্দ্দা, গুল ও আলাপাতা খাওয়া। সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এসব ধূমপান বা তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার থেকে নিজে নিজেই বিরত না হলে, কেউ বলে বা আইনের মাধ্যমে শাস্তি বা জরিমানা করলেই নিয়ন্ত্রণ হবে না।
অপরদিকে, যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা এনিজও ধূমপান বা তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণের জন্য মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মোটা অংকের অর্থ ব্যয়ের জন্য দেয়া হচ্ছে। তা সঠিকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না। নামকাওয়াস্তে কিছু অফিসে বিলবোর্ড, কোন বিশেষ দিনে ব্যানার ফেস্টুন তৈরি করে অংশগ্রহণ করে ছবি বা একটু প্রচারণার বিষয়টি সহায়তাকারী কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করেই দায়িত্ব শেষ। এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ বা অশিক্ষিত-স্বল্পশিক্ষিত মানুষদের নিয়ে কোন সভা-সেমিনার করা হয় বলে নজির নেই। অর্থ ব্যয় হচ্ছে, কিন্তু ফলাফল শূন্যের কোটায়। এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মনিটরিং জোরদার করলে হয়তো কিছু মানুষের সচেতনতার কাজে সফলতা আসতো। তাই এসব বিষয়ে সামাজিকভাবে সকলে এগিয়ে আসলেই ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হতে পারে বলে মত দিয়েছেন সচেতন মহল।
ধূমপানকে এক ধরনের সামাজিক অপরাধ বলা চলে। ধূমপানের ফলে পরিবেশও দূষিত হয়। আমাদের মতো দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য ধূমপান একটা অমানবিক আর্থিক অপচয়। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে ধূমপানের ক্ষতিকর দিক ব্যাপকভিত্তিতে তুলে ধরার সময় এসেছে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এবং একটা সুস্থ-সবল জাতি গঠনে ধূমপানের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা গড়ে তোলা আজ সময়ের অপরিহার্য দাবি।
ষ লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল ও চেয়ারম্যান বাংলাদেশ মিডিয়া অ্যান্ড ম্যানেজম্যন্ট ট্রেনিং ইনিস্টিটিউট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন