সিএনজি গ্যাস সিলিন্ডার ও রিফুয়েলিং নিয়ে কুমিল্লায় চলছে ভয়াবহ অনিয়ম। সংযোজনের পাঁচ বছরের মাথায় সিলিন্ডারগুলোর রি-টেস্ট বাধ্যতামূলক হলেও বাস্তবে প্রতিফলন নেই। একইভাবে ফিলিং স্টেশনে রিফুয়েলিংয়ের আগে সিলিন্ডার মেয়াদোত্তীর্ণ যাচাইয়ের কথা থাকলেও কেউ তা না মানায় দিন দিন গ্যাস সিলিন্ডারে বিস্ফোরণে মৃত্যু ঝুঁকি বেড়েই চলছে।
গত কয়েক বছরে কুমিল্লায় সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। ঘটছে প্রাণহানিও, অপচয় হচ্ছে সম্পদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানহীন ও সময়মত পুনঃপরীক্ষা না করানোই এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ। নিয়ন্ত্রক সংস্থা রুপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি-আরপিজিসিএল দায় চাপাচ্ছে বিআরটিএ’র কাঁধে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলাচলরত প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, ট্রাক, অটোটেম্পো, বাস-মিনিবাস, হিউম্যানহলার ও ডেলিভারি ভ্যানসহ বেশিরভাগ গাড়ি সিএনজিতে কনভারশন করা। জ্বালানি তেলের চেয়ে খরচ কম ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় গাড়িগুলো সিএনজিতে কনভারশন করা হয়। ২০০২ সাল থেকে দেশে সিএনজি চালিত গাড়ি চলাচল শুরু করে। সিএনজি গ্যাসের সিলিন্ডার কোরিয়া ও ইতালি থেকে আনা হয়। কোরিয়ার সিলিন্ডারগুলো ১৫ এবং ইতালির সিলিন্ডার ৩০ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। প্রতি তিন থেকে পাঁচ বছর পরপর পরীক্ষা করার নিয়ম থাকলেও অনেক পরিবহন মালিক টাকা বাঁচাতে গাড়িতে জাহাজের বাতিল গ্যাস ও অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগাচ্ছেন। এ ছাড়া সিলিন্ডারগুলো নির্দিষ্ট সময় পরপর পুনঃপরীক্ষাও করা হচ্ছে না। এমনকি নামসর্বস্ব অনেক কনভারশন কারখানায় অক্সিজেন সিলিন্ডারকে সিএনজি সিলিন্ডার বানানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনিয়মের সুযোগে কুমিল্লায় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার গাড়ি মেয়াদোত্তীর্ণ এবং বিপজ্জনক সিলিন্ডার নিয়ে চলাচল করছে বলে জানা গেছে। সিএনজি নিয়ে অনিয়ম চললেও দেখভালের দায়িত্বে থাকা বিস্ফোরক অধিদপ্তর অনেকটাই নির্বিকার। গত এক বছর ধরে নকল সিলিন্ডারের বিরুদ্ধে কুমিল্লায় কোনো অভিযানও হয়নি। তবে এ বিষয়ে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আব্দুল হাকিম বলেছেন, সিএনজি গাড়ির অনিয়মের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস লিমিটেডের (আরপিজিসিএল)। কিন্তু সবাই দায় চাপায় বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ওপর। তবে লোকবল সঙ্কটের কারণে অনেকদিন অভিযান চালানো যায়নি বলেও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন।
বিস্ফোরক অধিদপ্তর সূত্রে আরো জানা গেছে, কুমিল্লায় চলছে ১৫ হাজারের মত গাড়ি। বেশিরভাগই সিএনজি, ট্যাক্সি ও প্রাইভেট কার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, সিএনজিতে রূপান্তরিত এসব গাড়ির পাঁচ বছরের প্রাথমিক মেয়াদ অতিক্রম হয়ে গেছে। শতকরা একভাগ গাড়িও রি-টেস্টের জন্য আসেনি। কুমিল্লায় সাড়ে ৫ হাজারেও বেশি সিএনজি চালিত গাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলাচল করছে। বেশিরভাগ সিলিন্ডার গাড়ির পেছন দিকে বা মাঝামাঝিতে থাকায় দুর্ঘটনা ঘটলে ভয়াবহ প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে। সরকার শিগগিরই কঠোর পদক্ষেপ না নিলে আগামী এক বছরে সিএনজি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা অনেক বেড়ে যেতে পারে। গত দেড় বছর ধরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। নকল সিলিন্ডার, মানহীন সিলিন্ডার বাল্ব ও এসেস পাইপের পরিবর্তে এমএস পাইপ ব্যবহারের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে বেশি। বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও আরপিজিসিএল সূত্র জানায়, সিএনজি সিলিন্ডারগুলোর ধারণক্ষমতা ৩ হাজার পিএসআই (প্রেসার পার স্কয়ার ইঞ্চি)। কিন্তু রিফুয়েলিং স্টেশনে গ্যাসভর্তি করা হয় প্রায় ৫ হাজার পিএসআইয়ে। প্রতিনিয়ত বাড়তি চাপ নিতে হয় বলে পুরু ইস্পাতে সিলিন্ডারগুলো তৈরি করা হয়। একেকটি সিলিন্ডারের সর্বোচ্চ মেয়াদ ২০ বছর হলেও বাড়তি চাপের কারণে ৫ বছর অন্তর অন্তর রি-টেস্ট জরুরি। কিন্তু সে নিয়ম কেউ মানছে না। তবে এর চেয়েও ঝুঁকির বিষয় হলো অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে গ্যাস সিলিন্ডার বানানো। একটি সূত্র জানায়, কুমিল্লা মেয়াদোত্তীর্ণ অক্সিজেন সিলিন্ডার ও শিপইয়ার্ড থেকে গ্যাস সিলিন্ডার সংগ্রহ করে বিভিন্ন ওয়ার্কশপে অবৈধভাবে সিএনজি সিলিন্ডার বানানোর ঘটনা ঘটছে। মাত্র ৫-১০ হাজার টাকা কমের জন্যই গাড়ি মালিকরা নকল সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন। সিএনজি কনভারশন সেন্টারের এক মালিক তোফাজ্জল বলেন, সিএনজি সিলিন্ডারের তুলনায় অক্সিজেন সিলিন্ডারের ধারণ ক্ষমতা অর্ধেক। তাই দুর্ঘটনার ঝুঁকিও অনেক বেশি। একই প্রসঙ্গে কুমিল্লা সিএনজি অটোমোবাইলস ওয়ার্কশপের আলমগীর জানান, সিলিন্ডার কনভারশনের সময় হাইপ্রেসার, শাটার, সুইচ মিটার ওয়েরিং, ক্লাম্প, ক্লিপ ও টাইনিং রিলে লাগাতে হয়। দীর্ঘদিনের ব্যবহারের ফলে এগুলোর কোনোটি নষ্ট হলে সিলিন্ডার বিম্ফোরণ ঘটতে পারে। নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি সিলিন্ডার ৫ বছর অন্তর পরীক্ষা করানোর কথা থাকলেও তা মানছে না কোন চালক। এতে মালিক ও চালক তাদের ইচ্ছেমত পরীক্ষা করাচ্ছেন বা পরীক্ষা ছাড়াই চলছে একেকটি চলন্ত বোমা। আর ঘটছে দুর্ঘটনা। তবে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি আরপিজিসিএল নিজেদের দায় এড়িয়ে বললেন শুধু সচেতন হতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন বিআরটিএ থেকে ফিটনেস নেয়ার সময় যদি রিটেস্ট বা পুনঃপরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয় তাহলে কমবে ঝুঁকি আর বাঁচবে জীবন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন