মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতা ও সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত তারামন বিবি আর নেই। শুক্রবার দিবাগত রাত দেড়টায় কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার কাচারীপাড়ায় তার নিজ বাড়ীতে ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)। তার মৃত্যুতে প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
গতকাল শনিবার দুপুর ২টার দিকে রাজিবপুর উপজেলা পরিষদ মাঠে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এসময় উপস্থিত ছিলেন কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন, পুলিশ সুপার মেহেদুল করিম, বীর মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী বীর বিক্রম, মুক্তিযোদ্ধা মেজর তাজ, মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম টুকুসহ স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পরে ঐ মাঠেই দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে জানাজা শেষে তাকে রাজিবপুর উপজেলার কাচারীপাড়া গ্রামে তার পারিবারিক কবর স্থানে দাফন করা হয়।
বীরপ্রতীক তারামন বিবি দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুস, ডায়েবেটিস আর শ্বাসকষ্ট রোগে ধরে ভুগছিলেন। শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ৮ নভেম্বর কুড়িগ্রামের রাজীবপুর থেকে ময়মনসিংহ সিএমএইচ (সেনা ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসকদের পরামর্শে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে শারীরিক কিছুটা উন্নতি হলে গত সপ্তাহে রাজিবপুরের নিজ বাড়ীতে ফিরে আসেন।
শুক্রবার রাত ১০টার দিকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে রাজিবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ দেলোয়ার হোসেন বাড়ীতেই তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেন। রাত দেড়টায় তার শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হয় এবং তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বীরপ্রতীক তারামন বিবির জন্ম কুড়িগ্রাম জেলার চর রাজিবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামে। বাবার নাম আবদুস সোহবান এবং মা কুলসুম বিবি, স্বামীর নাম আবদুল মজিদ। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে।
১৯৭১ সালে তারামন বিবি ১১ নং সেক্টরে নিজ গ্রামে ছিলেন। তখন ১১ নং সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের। মুহিব হাবিলদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। যিনি তারামনের গ্রামের পাশের একটি ক্যাম্পের দায়িত্বে¡ ছিলেন। তিনি তারামনকে ক্যাম্পে রান্নাবান্নার জন্য নিয়ে আসেন। তখন তারামনের বয়স ছিলো মাত্র ১৩ কিংবা ১৪ বছর। কিন্তু পরবর্তীতে তারামনের সাহস ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মুহিব হাবিলদার তাঁকে অস্ত্র চালনা শেখান। একদিন দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় তারামন ও তার সহযোদ্ধারা জানতে পারেন পাকবাহিনীর একটি গানবোট তাদের দিকে আসছে। তারামন তার সহযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে অংশ নেন এবং শত্রুদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন। এরপর তারামন অনেক সম্মুখযুদ্ধে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অংশ নেন। অনেক বার তাদের ক্যাম্প পাকবাহিনী আক্রমণ করেছে, তবে ভাগ্যের জোরে তিনি প্রতিবার বেঁচে যান। যুদ্ধ শেষে ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবিকে তার সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীরপ্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। নিভৃতে থাকা এই মানুষটিকে খুঁজে পেতে দীর্ঘ ২২ বছর লেগে যায়। ১৯৯৫ সালে ময়মনসিংহের একজন গবেষক প্রথম তাকে খুঁজে বের করেন। নারী সংগঠনগুলো তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেই সময় তাকে নিয়ে পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়। অবশেষে ১৯৯৫ সালের ১৯শে ডিসেম্বর এক অনাড়ম্বর পরিবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে তারামন বিবিকে বীরত্বের পুরষ্কার তার হাতে তুলে দেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন