শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রাষ্ট্রায়ত্ত বৃহৎ শিল্প টিকিয়ে রাখা ও উন্নয়ন জরুরি

একেএম দেলোয়ার হোসেন | প্রকাশের সময় : ৮ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বন্ধ শিল্প একে একে বন্ধ শিল্প চালু করা হবে’। এর আগে শিল্পমন্ত্রী জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন যে, একে একে বন্ধ শিল্প চালু করা হবে। এসম্পর্কিত একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমাদের দেশে শিল্পের অতিত ইতিহাসটা খুব ভালো না। বিগত সরকারগুলো বিশ^ব্যাংক আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)’র কথায় ঢালাওভাবে বৃহৎ রাষ্ট্রীয় শিল্পগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। ১৯৭৫ পরবর্তী সরকার ১৯৮১ পর্যন্ত মোট ২৫৫টি রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয় যার মধ্যে ১১০টি ছিল বৃহৎ আকারের পাবলিক সেক্টর কর্পোরেশানের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৮২ সালের নতুন শিল্পনীতিতে বেসরকারিকরণের ওপর আরো জোর দেওয়া হয়, মাত্র ৬টি সেক্টর ছাড়া আর সমস্ত সেক্টরে বেসরকারি বিনিয়োগ অবাধ করে দেওয়া হয়। দেশীয় পুঁজিপতি ও বিদেশি সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের আস্থায় আসার জন্য অবিশ্বাস্য দ্রæত গতিতে বেসরকারিকরণ শুরু হয়। এক বছরের মাথায় ২৭টি টেক্সটাইল মিল ও ৩৩টি পাট কল পানির দরে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এছাড়া ১৬ মাসের মাথায় ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী ২১টি মাঝারি শিল্প বিক্রি করে দেওয়া হয়, যার ৭৮ শতাংশই ছিল লাভজনক এবং বিক্রি করার কিছুদিনের মধ্যেই যার ৮০ শতাংশ উৎপাদন হ্রাস ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বিশ্বব্যাংকের দলিল অনুসারে, ১৯৮২ সালের শিল্পনীতি অনুসারে পাট ও টেক্সটাইল মিল ছাড়াও আরো ৪৭৪টি শিল্প ও ২টি সরকারি ব্যাংক বেসরকারিকরণ করা হয় (সূত্র: জুট ইন্ডাস্ট্রি রিহ্যাবিলিটিয়েশান ক্রেডিট- প্রজেক্ট কম্পি¬শান রিপোর্ট, ১৯৯০)। স্বাধীনতার পরপর রাষ্ট্রীয় পাটকল ছিল ৬৮টি। শাসক শ্রেণির লুটপাট ও অবহেলায় পাটকলগুলোকে লোকসানি বানানো হয়। লোকসান কমানো ও পাটশিল্পের বিকাশের নামে বিশ্বব্যাংকের জুট ইন্ডাস্ট্রি রিহ্যাবিলিটিয়েশান ক্রেডিট প্রগ্রাম চলাকালে ১৯৮২ সালের নতুন শিল্পনীতির আওতায় ৩৫টি বেসরকারিকরণের পর রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল দাঁড়ায় ৩৩টি। এরপর ১৯৯৪ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশে জুট সেক্টর এডজাস্টমেন্ট ক্রেডিট (জেএসএসি) প্রোগ্রাম যখন হাতে নেওয়া হয় তখন ২৯ পাটকলের সম্পূর্ণ মালিকানাসহ পাট খাতের ৭৮ শতাংশ মালিকানা ছিল সরকারি খাতে। বিশ্বব্যাংকের ডকুমেন্ট অনুসারে, এই ঋণ প্রকল্পের ঘোষিত প্রধান উদ্দেশ্যগুলো ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ২৯টি পাটকলের মধ্যে ৯টি’কে পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া এবং ২টি পাটকলের ‘বাড়তি’ উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস বা ডাউন সাইজিং; রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো থেকে ২০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই; বাকি ২০টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের মধ্যে থেকে কমপক্ষে ১৮টি পাটকল বেসরকারিকরণ। এই কর্মসূচি নেওয়ার সময় বিশ্বব্যাংকের ডকুমেন্টেই স্বীকার করা হয়েছে, পাট খাতের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ নির্ভরশীল। তারপরও রাষ্ট্রীয় কারখানা বন্ধ করা, ডাউন সাইজ করা ও শ্রমিক ছাঁটাই করার পেছনে যুক্তি দেওয়া হয়েছিল, লস কমিয়ে শহুরে ও গ্রামীণ কর্মসংস্থানের একটি লাভজনক খাত হিসেবে পাট শিল্পকে প্রতিষ্ঠা করা। বলাই বাহুল্য, বিশ্বব্যাংকের অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের মতোই এই প্রকল্পও শেষ পর্যন্ত পাট শিল্পের বিশিল্পায়নই কেবল ঘটিয়েছে; যার মাধ্যমে পাট উৎপাদনকারী চাষি থেকে শুরু করে পাট শিল্পের শ্রমিক এমনকি বেসরকারি খাতও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক তার মূল্যায়ন প্রতিবেদনে কলকারখানা বন্ধ করে ২০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ‘সাফল্যে’ সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও স্বীকার করছে, বেসরকারি খাতের উৎপাদন ক্ষমতা আগের চেয়ে কমে মোট উৎপাদন ক্ষমতার ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে, জেএসসি প্রোগ্রাম শুরুর আগে যা ছিল ৩৫ শতাংশ। ১৯৯১ পরবর্তী সরকার আদমজী পাট কল থেকে শুরু করে অনেক বৃহৎ শিল্প বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের আওতাধীন ৪টি বৃহৎ চিনি ও প্রায় ২৪টির মতো সহযোগী খাদ্য শিল্প বন্ধ বা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়। উল্লেখ্য, বৃহৎ শিল্পগুলো শুধু বন্ধ বা বেসরকারি খাতে ছেড়েই দেয়া হয়নি, নিয়মিত সংস্কার বা বিএমআরই না করায় অনেক দিনের পুরাতন শিল্প স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতাও কমে যায়। যেমন, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অধীনস্থ চিনিকলগুলোর কথাই বলা যেতে পারে। কুষ্টিয়া চিনি কল ১৯৬১ সালে, কেরু অ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড ১৯৩৮ সালে, জয়পুরহাট ১৯৬০ সালে ঝিল বাংলা চিনি কল ১৯৫৭ সালে, ঠাকুরগাঁও চিনি কল ১৯৫৬ সালে, নর্থ বেঙ্গল চিনি ১৯৩৩ সালে, নাটোর চিনি কল ১৯৮২ সালে, পঞ্চগড় চিনি কল ১৯৬৫ সালে, পাবনা চিনি কল লিমিটেড ঈশ্বরদী ১৯৯২ সালে, ফরিদপুর চিনি কল ১৯৭৪ সালে, মোবারকগঞ্জ চিনি কল কালীগঞ্জ ১৯৬৫ সালে, রংপুর চিনি কল ১৯৫৪ সালে, রাজশাহী চিনি কল ১৯৬২ সালে, শ্যামপুর চিনি কল ১৯৬৫ সালে ও সেতাবগঞ্জ চিনি কল ১৯৩৩ সালে স্থাপিত হয়। এগুলো চলছে এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এধরনের একটি শিল্পের স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা ২৫/৩০ বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। কাজেই ৮০ বা ৮৪ বছরের একটি প্রতিষ্ঠান কী করে চলতে পারে? বহু আগেই সেগুলোর স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে বসে আছে। বিএমআর করে কোনোমতে সেগুলো ঠেলা-ধাক্কা দিয়ে চলছে। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক শিল্পের অবস্থা ভালো নয়। চিনি শিল্প হলো কৃষিভিত্তিক ভারি শিল্প। বর্তমানে এই শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৫০ লাখের অধিক মানুষ জড়িত। তবে বর্তমান সরকার চিনি শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য এরই মধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন, দীর্ঘদিনের পুরাতন চিনিকলগুলোকে সংস্কার, সহযোগী শিল্প গড়ে তোলা, আখচাষিদের উৎসাহিত করতে আখের দাম বৃদ্ধি, ই-পুর্জি চালু, সহজেই চাষিদের আখের মূল্য পরিশোধ ইত্যাদি
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন