রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

জিতল আওয়ামী লীগ হেরে গেল গণতন্ত্র

জামাল উদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতার ভবিষ্যত এক নতুন সন্ধিক্ষণে প্রবেশ করতে চলেছে। বহুল আলোচিত এই নির্বাচনের ঘোষিত ফলাফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তৃতীয় বারের মত বিশাল বিজয় অর্জন করলেও আওয়ামী লীগের মত একটি ঐতিহাসিক ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও কেমন যেন হতবিহবল হয়ে পড়েছে। কেমন যেন দ্বিধাকবলিত অবস্থা সর্বত্র। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য নাগরিকেরা বলতে গেলে গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতির এ অপমৃত্যুতে শোকসংতপ্ত। ব্যথা ভারাক্রান্ত। হতাশ। অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার মধ্যেও নির্বাচনের এমন ফলাফলের নেপথ্য ঘটনাবলী গোপণ থাকেনি। দলীয় সরকারের অধীনে প্রথমবারের মত একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য রাখার প্রতিটি ধাপেই নির্বাচন কমিশন, সরকার ও সরকারী দলের ব্যর্থতা নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নাই। পক্ষান্তরে নির্বাচনকে যদি রাজনৈতিক খেলার অংশ হিসেবে ধরি, তাহলে এ খেলার প্রতিপক্ষ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২৩দলীয় ঐক্যজোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট দৃশ্যমান প্রতিদ্ব›িদ্বতায় অবতীর্ণ হতেই ব্যর্থ হয়েছে। তবে গত ১২ বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানবাধিকারের প্রতি সরকার ও রাজনৈতিক পক্ষগুলোর চরম অবজ্ঞা, এবং এ সম্পর্কে উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সচেতন পর্যবেক্ষণ, মনোভাব ও প্রতিক্রিয়াকে যদি আমলে নেয়া হয়, তাহলে একাদশ জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও তার সম্ভাবনার জন্য অনেক বড় পরাজয় হিসেবেও গণ্য হতে পারে। গত কয়েক মাসে আমরা বিভিন্ন সময়ে বলেছি, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য করতে না পারলে সে নির্বাচনের বিজয় সরকারের জন্য যত হয়েই ধরা দিক না কেন, তা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য অনেক বড় পরাজয় হিসেবেই গণ্য হবে। সেই সাথে এই নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও ফলাফলের উপর বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অনেকাংশে নির্ভর করবে, এমন ভবিষ্যদ্বানী দেশি-বিদেশি নানা মহল থেকে করা হয়েছে। এমনিতেই বিনিয়োগ ও আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এক প্রকার দীর্ঘ মেয়াদী বন্ধ্যাত্বের মধ্যে পড়ে আছে। বিশেষত: আমাদের তৈরী পোশাক খাতসহ অর্থনৈতিক সহযোগীতা ও অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে অন্যতম মানদন্ড হিসেবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপস্থাপন করেছিল। এ নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া না গেলেও আমাদের আঞ্চলিক প্রতিবেশী ভারত ও চীনের তরফে নির্বাচনের ফলাফলে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দিত করার খবর পাওয়া গেছে। বিদ্যমান বাস্তবতায় বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি চৌপক্ষীয় ডাইমেনশন তৈরী হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, সরকার ও তার রাজনৈতিক শরিক মহাজোট, বিএনপির নির্বাচন ও আন্দোলনের মোর্চা ২০ দলীয় ঐক্যজোটসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমাদের অবস্থান এবং ভারত ও চীনের জটিল সমীকরণ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ হিসেবে অবস্থান করছে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ ও সাড়ে ১০ কোটি ভোটার। এই চৌপক্ষীয় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বলয়ের লড়াইয়ের লক্ষ্য একটি শান্তিপূর্ণ সমঝোতা ও সহাবস্থানের গতিপথ নির্ধারণের উপর বাংলাদেশের ভবিষ্যত নির্ভর করছে।
নিজ নিজ স্বার্থের নিরীখে দেশি-বিদেশী কুশীলবরা যে মতই দেন না কেন, নির্বাচনটি কেমন হয়েছে সে পারসেপশনের মূল ধারক এ দেশের জনগন। একইভাবে দেশে গণপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থান মূল বেনিফিসিয়ারি বা ভুক্তভোগীও দেশের জনগন। সরকারী মেশিনারিজ, গণমাধ্যম এবং ক’টনৈতিক বোঝাপড়াকে কাজে লাগিয়ে যে কোন সরকার বাস্তবতা ও পাবলিক পারসেপশনের বৈপরীত্যকে আপাত:ভাবে নিজের অনুকুলে নিয়ে আসতে সক্ষম হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসের বাস্তবতায় নির্বাচন নিয়ে যে কোন ধূ¤্রজাল বা মিসপারসেপশন আখেরে যে কোন দলের জন্য রাজনৈতিক বিপযর্য় ডেকে আনতে পারে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের পর থেকেই সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য করার একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ করেছিল। তিরিশে ডিসেম্বরের সে পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই তার মূল্যায়ণ শুরু হয়েছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কুশীলবরা যে যাই বলুন, দেশের প্রত্যেক ভোটার ও সচেতন নাগরিকই এই পরীক্ষার মূল পর্যবেক্ষক ও পরীক্ষক। এবং মানুষের এই পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ণ বাংলাদেশের আগামী রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করে দেবে। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক স্বার্থ ও দলীয় মনোভাব অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি করে থাকে। এ ক্ষেত্রে জনপ্রত্যাশা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মানদন্ডে নাগরিক সমাজের নিরপেক্ষ মূল্যায়ণ খুবই প্রয়োজনীয় বিষয়। জনে জনে গড়ে ওঠা জনতা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সত্যাশ্রয়ী, সাহসী ও সক্রিয় হতে না পারলে তারা সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক সরকার ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনা। বিভেদ-বিরোধাত্মক রাজনৈতিক বাস্তবতায় পক্ষগুলো পরস্পরকে ঘায়েল ও দুর্বল করার চেষ্টা করবে, এটা অস্বাভাবিক নয়। তবে সেখানে যদি রাজনৈতিক কারণে নাগরিক সমাজের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, তা সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাই শুধু নয়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়তে পারে। আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সামাজিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শান্তির জন্য বড় অন্তরায়ই হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অথবা সা¤্রাজ্যবাদী প্রতিবন্ধকতা। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে যে গৃহযুদ্ধ, হানাহানি ও রক্তপাত চলছে তার নেপথ্যের অন্যতম কারণই হচ্ছে সেখানে সুশাসনের অভাব ও সরকারের রাজনৈতিক লেজিটিমেসির সংকট। বেশীরভাগ রাজনৈতিক দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে একপাক্ষিকভাবে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই পশ্চিমারা বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক সংলাপ, সমঝোতা এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য বার বার তাগাদা দিয়ে আসছিল। এ ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার প্রয়াস ব্যর্থ হলেও একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে হঠাৎ করেই সরকার ও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার সংলাপটি ছিল নির্বাচন নিয়ে অনেক আশঙ্কা ও হতাশার মধ্যে আশার আলো। সে সংলাপের ফলাফল সবারই জানা। তবে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবের কোন দাবী মানতে রাজি না হওয়া সত্বেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর মৌখিক আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরী করে দিয়েছিল। তবে নির্বাচনে প্রার্থী ও ভোটারদের নিরাপদ অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করার মূল দায়িত্ব ছিল নির্বাচন কমিশন ও সরকারের। তারা তা নিশ্চিত করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
তিরিশ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন মধ্য আফ্রিকার দেশ কঙ্গোতে দীর্ঘদিন পর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন একাদশ জাতীয় নির্বাচনের জন্য ঘোষিত প্রথম তফশিলে নির্বাচনের তারিখ ঠিক করেছিল ২৩ ডিসেম্বর। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন একমাস পিছিয়ে দেয়ার দাবী করলেও নির্বাচন কমিশন মাত্র ৭দিন পিছিয়ে ৩০ শে ডিসেম্বর ভোটের তারিখ পুন:নির্ধারণ করে। ঠিক একইভাবে কঙ্গোতেও ২৩ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত ছিল। কিন্তু নির্বাচনের তারিখ ঘনিয়ে আসার মাত্র কয়েকদিন আগে ইভিএমসহ নির্বাচনের সরঞ্জামের একটি গোডাউনে আগুন লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেখানেও নির্বাচনের তারিখ ৭দিন পিছিয়ে ৩০ ডিসেম্বর করা হয়। দুই মহাদেশের দুটি দেশের ভিন্নতর বাস্তবতায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোটচিত্র মানের দিক থেকেও যথেষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। গৃহযুদ্ধ, জঙ্গিবাদ ও ইবোলা ভাইরাসের আতঙ্কের মধ্যেও যোসেফ কাবিলার ১৭ বছরের শাসন শেষে কঙ্গোর নির্বাচন ছিল অনেকটাই সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ। নির্বাচনের দিনে ইভিএম বিপত্তি নিয়ে উত্তেজনা এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২ জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে বলে জানা যায়। তবে প্রায় ৮ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুসিত মধ্য আফিক্রার দরিদ্র যুদ্ধকবলিত দেশ ডেমোক্রেটিব রিপাবলিক অব কঙ্গোতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও বিবদমান গ্রæপগুলোর মধ্যে সংঘাতে গত কয়েকমাসে অর্ধশতাকিত মানুষের প্রানহানী ঘটেছে। শত বছরের বেলজিয় ঔপনিবেশিকতা পেরিয়ে ১০৬০ সাল থেকে ও আভ্যন্তরীন জাতিগত সংঘাতের মধ্য দিয়ে পেরিয়ে আসা কঙ্গোর সাম্প্রতিক ইতিহাস একটি গণতান্ত্রিক পদযাত্রার পূর্বলক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। প্রায় দেড় দশক ধরে ক্ষমতাসী লরেল যোসেফ কাবিলার একানায়কতান্ত্রিক শাসনের ধারাবাহিতকতা ভেঙ্গে দিতে কঙ্গোলিজরা বার বার রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে নেমে এসেছে। ২০১৬ সালে কাবিলা সরকারের মেয়াদ পার হয়ে গেলেও নানা অজুহাতে ইতিপূর্বে একাধিকবার নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তিত হয়। মধ্য আফ্রিকার দেশ কঙ্গোর জনসংখ্যা মাত্র ৮ কোটি হলেও এর আয়তন বাংলাদেশের দ্বিগুনের বেশী বড়। তবে রাষ্ট্রের আয়তন বা জনসংখ্যা কোন দেশকে বিশ্বের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলতে পারে না। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিমন্ডলে রাষ্ট্রের জনগনকে জনশক্তিতে পরিনত করা এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ও সম্পদকে কাজে লাগাতে পারলেই যে কোন রাষ্ট্র বিশ্বশক্তি হিসেবে আন্তর্জতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেতে পরে। আন্তজাতির্ক বিচারে স্বল্প আলোচিত দুই মহাদেশের দুইটি দেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিশ্ব মিডিয়া বা আন্তর্জাতক সম্প্রদায়ের তেমন আগ্রহ থাকার কথা না থাকলেও এই মুহুর্তে প্রায় একই সময়ে অনুষ্ঠিতব্য ডিআরসি ও বাংলাদেশের নির্বাচন পশ্চিমা মেইন স্ট্রীম গণমাধ্যমগুলোতেম যথেষ্ট গুরুত্ব সহাকারে আলোচনায় উঠে আসতে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের গণদাবী সংবিধানের সন্নিবেশিত হলেও যারা বছরব্যাপাী আন্দোলন করে দাবী আদায় করে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতায় এসে সংবিধান পরিবর্তন করে নিজেদের অধীনে দশম নির্বাচনে বিরোধীদলকে নির্বাচনের বাইরে রেখে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ৫ বছর ক্ষমতায় থেকেছে। অত:পর সুষ্ঠু অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রতিশ্রæতি দিয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত ও লজ্জাজনক বিতর্কিত নির্বাচন উপহার দিল। অন্যদিকে একনায়ক যোসেফ কাবিলা ইচ্ছা করলে সংবিধান পরিবর্তন করে আবারো নির্বাচনে অংশ নিয়ে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের সুযোগ না নিয়ে বিরোধীদলগুলোর মধ্য থেকে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে স্বচ্ছ নির্বাচনের প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছেন।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’র রূপকার সরকার নির্বাচনের আগে ও পরে ২ দিন ইন্টারনেটের গতি ও সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিঘি্নত করে সারাদেশের নির্বাচনী অনিয়ম-সন্ত্রাসকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখার চেষ্টা করেছে। গুজব রটনা এবং মিথ্যা প্রচারনা বন্ধের অজুহাতে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা হলেও সাধারণ মানুষের ধারণা কিন্তু ভিন্য রকম। যদিও ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পুরোপরি নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করে দেয়ার ক্ষমতা এখন যে কোন দেশের সরকারের জন্যই সীমিত। সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের নানাবিধ আইনগত ও লজিস্টিক ব্যবস্থা আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেও আছে। নির্বাচনের দিনও ওয়াই-ফাইয়ের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল নেটওর্য়াক সুবিধা সীমিত আকারে সক্রিয় ছিল। নির্বাচনের পরের দিন কিছুক্ষণের জন্য মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু হওয়ার পর দেখা গেল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন অ্যাপের গ্রুপ ও আইডি থেকে অসংখ্য ছবি, ভিডিও ছবি ছড়িয়ে পড়েছে তাতে বুঝতে কারোই বাকি থাকে না, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের অন্তরালে সারাদেশে আসলে কি ঘটেছে। আমি নিজেও ভোট উৎসবের ইমোশন নিয়ে নির্বাচনের আগের দিন সন্ধ্যায় সপরিবারে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম ভোট দিতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ থাকলেও সন্ধ্যা থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যালটে সিল মারার খবর পাচ্ছিলাম। রাত ২ টা পর্যন্ত দেশের প্রায় সব অঞ্চল থেকেই প্রায় একই ধরনের খবর পাওয়া গেল। এ ধরনের পূর্বাভাস আগে থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল কেউ কেউ ফোন করে বলেছিল, ভোট দিতে এসে লাভ নাই। এ কারণেই নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর কমান্ডারকে ফোন করে তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে, আপনি নির্ভয়ে ভোট দিতে যেতে পারেন। তবে নির্বাচনের দিন বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদী বেষ্টিত বক্তাবলী ও আলীরটেক ইউনিয়নের ১৭টি ভোটকেন্দ্রের কোথাও সেনাবাহিনী বা বিজিবি’র টহল টিম দেখা গেল না। ভোটকেন্দ্রগুলোতে ধানের শীষের কোন এজেন্ট ছিল না। কোথাও কোথাও ধানের নৌকার কর্মীরাই ধানের শীষের এজেন্ট হয়ে বসেছিল বলে জানা গেছে। সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে আমার ভোটকেন্দে গিয়ে দেখলাম,নির্বাচনের কোন উত্তাপ নেই, নৌকা ছাড়া অন্য কোন পোস্টার নেই, কর্মী নেই, পোলিং এজেন্ট নেই, পুলিশ- আনসারের কতিপয় সদস্য অলস বসে আছে, প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার, পোলিং এজেন্ট হিসেবে যারা সেখানে ছিল তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সমন্বিত উদ্যোগে কাজ করছে। বাকি যে সব অভিযোগের কথা জানতে পারলাম তা শোনা কথা হিসেবে এখানে নাই বা বললাম। কোন কোন স্থানীয় নেতা রাতে সিল মেরে বাক্স ভরার কথা কোন রাখ-ঢাক না করেই স্বীকার করার সাক্ষী আমি নিজেই। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যে ধরনের তথ্য পাচ্ছিলাম আমার নিজের এলাকায় একই ধরনের তথ্য পেলাম। দেশের সামগ্রিক বাস্তবতা ও জাতীয় রাজনীতির ইস্যু যাই হোক, আমার নির্বাচনী এলাকায় নৌকার প্রার্থী বর্তমান এমপি এলাকায় শুধু নয়, সারাদেশে পরিচিত, গত ৫ বছরে তিনি শত শত কোটি টাকার অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করেছেন। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হলে তিনি যে সব উন্নয়নের প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন তা’ও ভোটের মাঠে যথেষ্ট সমীহ পাওয়ার দাবী রাখে। পক্ষান্তরে ধানের শীষের প্রার্থীকে এলাকার কেউ চিনে না। তিনি বিএনপির কেউ নন, গত ৫-১০ বছরে কোন সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মকান্ডে তাকে দেখা যায়নি। এই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পরও তিনি সেখানে যাননি। এমন একজন প্রার্থীর বিপরীতে একজন ডাকসাইটে রাজনৈতিক প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দিতাই চলে না। আমার ধারণা দেশের সুষ্ঠু, অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য ভোট হলেও তিনি হয়তো পাস করতেন। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়া এবং অসম নির্বাচনী মাঠে দেশের অধিকাংশ আসনে পাস করে আসা সরকারী দলের জন্য খুব বেশী কঠিন হত বলে আমি মনে করিনা। তাহলে দেশের আড়াই কোটি নতুন ভোটার সহ ১৬ কোটি মানুষ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রত্যাশা এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গিয়ে অতি উৎসাহী প্রশাসন, মহাজোটের প্রার্থী ও নেতা-কর্মীরা এমন একটি নির্বাচনী নাটক মঞ্চস্থ করতে গেল কেন? কোনো কোনো বিজয় পরাজয়ের চেয়েও লজ্জার। কোনো কোনো পরাজয় বিজয়ের চেয়েও গৌরবের। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মহাজোট কাঁটায় কাঁটায় সরকার গঠন করলে কিংবা সরকার গঠনের মত আসন না পেলেও শেখ হাসিনা দেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠা ও ইতিহাসের অনন্য উচ্চতায় স্থায়ী আসন করে নিতে পারতেন। তিনিই হতে পারতেন বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের সত্যিকারের প্রতিষ্ঠাতা ও রূপকার। সে সুযোগ এখন হাতছাড়া হয়ে গেছে। আমি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে যে পরিবেশ দেখেছি তাতে ভোট দেয়ার আগ্রহ উবে গিয়েছিল। অসংখ্য মানুষ ভোট দিতে পারেনি। আস্থাহীনতার কারণে আমারো ভোট দেয়া হল না। এমন নির্বাচন চাইনি। আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের অনেক নেতাকর্মীর সাথে কথা বলে বুঝেছি, তারাও এমন নির্বাচন চায়নি। কিছু সংখ্যক দলকানা ব্যক্তি ছাড়া দেশের ১৬ কোটি মানুষ সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন দেখতে চেয়েছিল। জাতীয় এ ব্যর্থতার দায় নির্বাচন কমিশন ও সরকারের।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
jack ali ২ জানুয়ারি, ২০১৯, ৪:৫৭ পিএম says : 1
Our Rulling party is the the Best party in the world-----what ever things they touch---it turn to gold---They will take us with our country for space travel----
Total Reply(0)
মুক্তা আহমদ ৩ জানুয়ারি, ২০১৯, ৪:৪৫ এএম says : 0
স্বাধীনতার ৪৭ বছরের পরে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে জে পাকিস্তানের সঙ্গে ছিলাম অনেক ভালো ছিলাম
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন