শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মুক্তাঙ্গন

সর্বস্তরের ব্যক্তির জন্য নিষিদ্ধ হোক প্রাইভেট-কোচিং

প্রকাশের সময় : ১১ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শরীফুর রহমান আদিল
গত মাসের প্রথম দিকে সরকার জাতীয় শিক্ষা আইন-১৬ এর খসড়া মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে মতামত দেওয়ার জন্য প্রকাশ করে। এতে বেশ কিছু ভালো দিক থাকলেও এর কিছু ধারা-উপধারা নিয়ে শিক্ষক ও এর সাথে সংশ্লিষ্টদের মাঝে রয়েছে মতানৈক্য, এমনকি সৃষ্টি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ। এর কারণ হলো দুটিÑ প্রথমটি হলো, নোট কিংবা গাইড সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ না করা এবং পরেরটি হলো কেবল শিক্ষকদের জন্য প্রাইভেট-কোচিং নিষিদ্ধ করা।
সরকার প্রায়ইশ নোট ও গাইড বইকে নিষিদ্ধের কথা জানালেও শিক্ষা আইন-১৬ তে তা নিষিদ্ধ করা হয়নি। শিক্ষা আইনের প্রথম অধ্যায়ের ৭নং ধারার ৬নং উপধারা, ৩য় অধ্যায়ের ২১নং ধারার ৫, ৬নং উপধারায় নোট, গাইড বই সম্পর্কে যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তাতে এনসিটিবির অনুমোদন সাপেক্ষে সহায়ক বই প্রকাশের কথা বলে উপরন্তু একে অন্য নামে চালানোর অনুমতি কিংবা বৈধতা দেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রশ্ন হলোÑ নোট বই বা গাইড সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে সমস্যা কোথায়? সেক্ষেত্রে সহায়ক শিক্ষা উপকরণ কিংবা সহায়ক পুস্তক এসব বলার মানে কী?
প্রাইভেট কিংবা কোচিং নিয়ে কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নেতিবাচক সংবাদ প্রচার হয়ে আসছে। এর মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্লাসে শিক্ষকের মনোযোগ দিয়ে ক্লাস না নেওয়া, ইচ্ছাকৃত ফেল করানো কিংবা প্রাইভেট পড়ার জন্য বাধ্য করা। এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে এবং শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ধ্বংস করার আশঙ্কায় সরকার প্রাইভেট কোচিং নিষিদ্ধ ঘোষণা করছে। আমরা জানি, প্রাইভেট কিংবা কোচিং সেন্টারে সব বিষয়কে পড়তে হয় না বরং হাতেগোনা দু-একটি বিষয়ের প্রাইভেট পড়তে হয়। আর এ বিষয়টি নিষিদ্ধ না করার পেছনে এসব বিষয়ের শিক্ষকদের ভূমিকা অগ্রগণ্য বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে। তবে আশঙ্কার বিষয় হলো, দেশের সব জায়গায় বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী দিন দিন কমে আসছে, আর গ্রামাঞ্চলে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর সঙ্কট তো প্রকট। এর অন্যতম এক কারণ হলো প্রাইভেট কিংবা কোচিং। কেননা বিজ্ঞানের প্রায় সব বিষয়ের প্রাইভেট কিংবা কোচিং করানোর এক অশুভ প্রবণতা পূর্ব থেকেই বিদ্যমান। আর অভিভাবকরা তাদের সার্মথ্য না থাকায় তাদের সন্তানদের বিজ্ঞানে পড়ানোর সাহস করছেন না। তাদের ধারণা বিজ্ঞান বিভাগে পড়ানোর অর্থই হলো সারা বছর দুই-তিনজন প্রাইভেট টিউটর কিংবা কোচিংয়ে পড়ানোর ব্যবস্থাÑযা তাদের পক্ষে অসম্ভব! আবার এই প্রাইভেট কিংবা কোচিংয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে ভালো পাঠদান না করানোর অভিযোগও পাওয়া যায়।
আমরা একদিকে শিক্ষকদের মান কিংবা মর্যাদা বাড়ানোর সংগ্রাম করছি, অন্যদিকে আমরা শিক্ষকরাই আবার প্রাইভেট কিংবা কোচিং করানোর মতো হীন কাজ ছাড়ার বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছি? যা সত্যিই লজ্জাজনক। এই প্রাইভেট আর কোচিংয়ের বিড়ম্বনায় শিক্ষকরা তাদের মূল সম্মান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কেননা, শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের লেকচার মনোযোগ দিয়ে শুনছে না কোচিং কিংবা প্রাইভেট শিক্ষকের ওপর ভরসা রেখে! এ কারণে অনেক ক্ষেত্রে প্রবীণ শিক্ষকগণ তাদের শ্রেণীকক্ষে পাঠদানে আর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রাইভেট শুধু শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে না বরং পুরো শিক্ষক সমাজকেও অপমানিত করছে। আর দেশকে করছে বিদ্যাহীন। কেননা, এসব কোচিং কিংবা প্রাইভেটে আলোচনা কিংবা পড়ানো হয় কেবলমাত্র পরীক্ষায় আসার মতো উপযোগী কয়েকটা প্রশ্ন। ফলে শিক্ষার্থীরা পাস করছে কিন্তু তারা তাদের শ্রেণীকক্ষের যে পা-িত্যপূর্ণ লেকচার তা থেকে এসব শিক্ষার্থী বঞ্চিত হচ্ছে। শিক্ষার্থী ক্লাসে মনোযোগ দিচ্ছে কিনা, কিংবা শিক্ষার্থী ক্লাসে আসছে না কিন্তু এসব শিক্ষার্থী আবার ঠিকই জিপিএ এ+ পাচ্ছে। এটা কীভাবে সম্ভব? এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশে নোট-গাইড কিংবা প্রাইভেট-কোচিং সেন্টারের কল্যাণে এটি সম্ভব হচ্ছে। তবে জনমনে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে এ+ পাওয়া এসব শিক্ষার্থী কি গুণগত শিক্ষা অর্জন করেছে? আবার এও প্রশ্ন জাগে, এসব শিক্ষার্থী কি তাদের সমান যারা সারা বছর ক্লাসে গিয়ে শিক্ষকের পাঠদান মনোযোগ দিয়ে শুনে অবশেষে পরিশেষে এ+ পেয়েছে? মনে এসব বিষয় উপলব্ধি করেই জনৈক এক প্রাবন্ধিক মন্তব্য করেছিলেনÑ কেবল পাস করলেই বিদ্যা অর্জন হয় না। আমাদের শিক্ষার্থীরাও কি তাই হচ্ছে? আসলেই মনে হয় তাই, নাহলে কেন ঢাকা, জগন্নাথ কিংবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় যথাক্রমে মাত্র ৭, ৯ এবং ১৬ শতাংশ পাস করবে? অথচ এসব প্রতিষ্ঠানে আবেদনকারীদের মধ্যে কেবলমাত্র জিপিএ-৫ এর সংখ্যাই ছিল প্রায় ৬২ শতাংশ! এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে আমাদের দেশের শিক্ষার মানের একটা প্রতিচ্ছবি ভেসে আসছে। আর এ জন্য কোচিং-প্রাইভেট কিংবা নোট-গাইড বই কোনো অংশেই কম দায়ী নয়।
নোট কিংবা গাইড বই শিক্ষককে করে তুলছে অলস ও কর্মবিমুখ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, নোট কিংবা গাইড থাকায় শিক্ষকরা তাদের গবেষণামূলক নিবন্ধ তৈরি থেকে বিরত থাকছেন। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরেকটু স্পষ্ট হওয়া সম্ভব হবেÑ মডেল টেস্ট কিংবা সাময়িক পরীক্ষায় স্ব স্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজেরা প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়ে থাকেন কিন্তু দেখা গেছে অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এসব গাইড কিংবা নোট বইয়ের মডেল টেস্ট হুবহু প্রশ্ন তুলে দিয়ে কিংবা ফটোকপি করে দিয়েই এসব পরীক্ষা নিচ্ছেন। তবে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের পাঠদানের গুরুত্ব কি আর থাকল? আবার অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে বাজারে প্রচলিত নোট কিংবা গাইড বইয়ের ফলে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে আশঙ্কাজনকভাবে। সরকার একদিকে মুখস্থ বিদ্যাকে নিরুৎসাহিত করে শিক্ষার্থীদের মনে সৃজনশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে প্রচলন করেছে সৃজনশীল পদ্ধতি। কিন্তু এসব গাইড-নোটবই কিংবা প্রাইভেট কোচিং সরকারের নেওয়া তথা জাতিকে সৃজনশীল করার উদ্দেশ্যকে অন্ধকারে ছুড়ে মারছে।
তবে একটা আশঙ্কার দিক হলো, গত ৪ঠা মে মাউশি থেকে প্রাইভেট কিংবা কোচিং সম্পর্কে যে পরিপত্র জারি হয়েছে কেবল এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এটি অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে। যার ফলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের জেল-জরিমানা এমপিও বাতিল কিংবা চাকরিচ্যুতের মতো শাস্তির কথা বলা হয়েছে কিন্তু সরকারি শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এটি কেবল অসদচারণ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, যা ১৯৮৫ সালের বিধি অনুযায়ী শাস্তির কথা বলা হয়েছে, যা শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করছে । এ দৃষ্টিকোণ থেকে এক দেশে একই কাজের জন্য দুই ধরনের আইন প্রণীত হলো কিংবা সর্বজনীন আইন প্রণয়ন হলো না! আবার প্রাইভেট-কোচিং কেবলমাত্র শিক্ষকদের বেলায় বন্ধের কথা বলা হয়েছে কিন্তু সর্বস্তরে যে কোনো ব্যক্তি কিংবা শিক্ষার্থীর বেলায় তা বলা হয়েছে কিনা তা স্পষ্ট নয়। আবার যদি সবার ক্ষেত্রে তা বলা হয়ে থাকে তবে তাদের জন্য কী ধরনের শাস্তি প্রদান করা হবে সে সম্পর্কে পরিপত্র, জাতীয় শিক্ষা আইনের খসড়া কিংবা অন্য কোথায় তা বলা হয়নি। আর যদি এটি সর্বজনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য না হয় তবে সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষকদের ওপর এটি কোনো ধরনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ? আর কেনই বা শিক্ষকদের ওপর সরকারের এই আক্রোশ? তাই জাতীয় জীবনে সৃজনশীলতা আনয়ন করতে হলে সর্বজনীন আইন প্রণয়ন করে প্রাইভেট-কোচিং নোট কিংবা গাইডবই নিষিদ্ধ করতে হবে এবং কেবল শিক্ষকদের জন্য নয় বরং যে কোনো নাগরিকের জন্য প্রাইভেট কিংবা কোচিং বন্ধের পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় শিক্ষক এবং অন্য যেসব নাগরিক প্রাইভেট কিংবা কোচিংয়ে যুক্ত তাদের সাথে সমাজে এক ধরনের মনোমালিন্য সৃষ্টি হবে। আর শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত করার যে পদক্ষেপ সরকার হাতে নিয়েছে তাতে সফল হতে হলে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন করে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণের ত্বরিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
ষ লেখক : প্রভাষক, দর্শন বিভাগ, ফেনী সাউথ ইস্ট ডিগ্রি কলেজ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন