হেলেনা জাহাঙ্গীর
দেশের মেয়েরা আবারও ফুটবলের আঞ্চলিক শিরোপা জয় করেছে। ১ মে তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবেতে তারা ভারতের মেয়েদের ৪-০ গোলে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ মেয়েদের ফুটবলে আঞ্চলিক শিরোপার অধিকারী হয়েছে। এশিয়ার দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের বয়সভিত্তিক বালিকা টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে প্রতিটি খেলায় দাপটের সঙ্গে খেলে।
প্রথম পর্বে শক্তিশালী ভারতকে তারা হারিয়েছে ৩-১ গোলের ব্যবধানে; নেপালের বিরুদ্ধে তারা মেতে উঠেছিল গোলোৎসবে। হিমালয় কন্যাকে ৯-০ গোলে হারায় বাংলাদেশের ছোটমণিরা। তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবের মাঠেও স্বাগতিক দেশের বিরুদ্ধে তারা জিতেছে ৯-১ গোলের বিশাল ব্যবধানে। ফাইনালে উত্তীর্ণ হয়ে ভারতকে তারা আবারও হারিয়েছে আগের চেয়েও দাপটের সঙ্গে ৪-০ গোলের ব্যবধানে। পুরো টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের মেয়েরা ২৫টি গোল করেছে, নিজেরা হজম করেছে মাত্র দুটি গোল। অনূর্ধ্ব-১৪ মেয়েদের এই জাতীয় দলটির ৮ জনই ছিল ময়মনসিংহের অজপাড়াগাঁ কলসিন্দুর মেয়ে। শিরোপার লড়াইয়ে যাদের ৬ জন খেলেছে জাতীয় দলের হয়ে। এ গ্রামেরই মেয়ে তহুরা হ্যাটট্রিক করে নিজেদের জাত চিনিয়েছে। পরিচর্যা করলে গ্রাম বা স্কুল পর্যায়ের ফুটবল দলও যে প্রকারান্তরে জাতীয় দলে পরিণত হতে পারে গারো পাহাড়ের পাদদেশের কলসিন্দুর গ্রামের মেয়েরা তা প্রমাণ করে দিয়েছে।
ফুটবলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যখন দুনিয়ার সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর একটি তখন অজপাড়াগাঁয়ের ছোট ছোট মেয়েরা পুরো জাতিকে জানিয়ে দিয়েছে কোন পদ্ধতিতে দেশের ফুটবলকে এগিয়ে নেওয়া যাবে। দেশের প্রতিটি স্কুলে যদি স্কুল পর্যায়ের ফুটবল দল গড়ে তুলে সঠিকভাবে পরিচর্যা করা হয় তবে পিছিয়ে পড়ার লজ্জা শুধু কাটিয়ে ওঠা নয়, বাংলাদেশ দলের পক্ষে ফুটবলে অন্তত এশীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া সম্ভব। এ জন্য দরকার কিশোর-কিশোরী পর্যায় থেকেই পরিচর্যা। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, স্পেনের মতো দেশগুলো বিশ্বসেরা হয়ে উঠেছে সার্বক্ষণিক পরিচর্যার গুণে। সাফল্য পেতে হলে বাংলাদেশকেও সে পথ ধরতে হবে। আঞ্চলিক শিরোপা জয়ী বাংলাদেশের মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৪ দলকে আমাদের অভিনন্দন। ভবিষ্যতে তারা দেশ ও জাতির মুখ আরও উজ্জ্বল করবে আমরা এ আশাই করছি।
ফুটবল মানেই উম্মাদনা, অন্যরকম শিহরণ জাগানিয়া কিছু। হয়তো ক্রিকেট এখন বেশি আলোড়ন তোলে মানুষের মনে, কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, পরিপূর্ণ আবেগ, ক্ষুরধার মস্তিষ্কে মানুষ ফুটবলটাকেই বেশি উপভোগ করে। আজ যে আমরা খেলায় ‘বহুজাতিক’ আনন্দ দেখতে পাই, তার শুরুটাও কিন্তু ফুটবল দিয়ে।
বাংলাদেশেও সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। তবে মানুষ স্বভাবগত কারণেই সাফল্যের পূজারি। সাফল্য না পেলে জনপ্রিয়তা ধরে রাখা যায় না। বাংলাদেশেও তাই হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে সার্কভুক্ত দেশগুলো নিয়ে সাফ গেমস শুরু হলে বাংলাদেশের ফুটবলে লক্ষ্য নির্ধারণ হয় সাফ স্বর্ণপদক। অর্জনযোগ্য লক্ষ্য। উপমহাদেশে সেরা ফুটবল শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হয় কেবল ভারতকে। অথচ ভারতের অনুপস্থিতিতে ১ম সাফ গেমসে নেপালের কাছে ফাইনালে হেরে যায় বাংলাদেশ। প্রথমবারই শুধু নয়, সাফ গেমস ফুটবলে ব্যর্থতা নিয়মিত হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের জন্য। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ফুটবলের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। বিশ্বকাপ খেলার হাতছানি থাকায় গত শতাব্দীর নব্বই দশকের শুরুতে ফুটবলের জায়গা দখল করে নেয় ক্রিকেট। ফুটবলে দর্শকপ্রিয়তা কমতে থাকে।
আজ আমরা অস্ট্রেলিয়া, ভারত, পাকিস্তান কিংবা ওয়েস্টইন্ডিজ ক্রিকেট দলের ভক্ত, কিংবা এসব দেশের পতাকা নিয়ে নিজের দেশের মাঠে প্রবেশ করি, আনন্দে উদ্বেলিত হই এসব খুব নিকট অতীত। কিন্তু ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, হল্যান্ড কিংবা জার্মানি, স্পেনের ভক্ত হয়ে বাড়িতে বাড়িতে প্রিয় দলের পতাকা উড়ানো, সারারাত জেগে খেলা দেখা, পরদিন আবার সেই খেলা নিয়ে তুমুল আড্ডায় মেতে ওঠা, এসব কোন খেলায় আছে বলুন? হ্যাঁ, এসব শুধু ফুটবলেই সম্ভব।
কাজী সালাউদ্দিন, এমেকা, জাকারিয়া পিন্টু, অমলেশ, কিংবা সাব্বির, কায়সার হামিদ, প্রয়াত মোনেম মুন্নাÑএ নামগুলো বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে অবিস্মরণীয় নাম। যখনই বাংলাদেশের ফুটবলের প্রসঙ্গ উঠে কিংবা উঠবে তখনি এ নামগুলো ঘুরেফিরে আসবেই। কেননা স্বাধীনতা-উত্তর কালে আমরা বাংলাদেশে যে ফুটবল জাগরণ দেখতে পাই তাতে এদের অবদান অসামান্য।
এই তো কদিন আগেও বাংলাদেশের জনপ্রিয় খেলার কথা উঠলে ফুটবলের নামডাক শোনা যেত। আর এখন? কারো কারো মতে, ফুটবল এখন ‘কোমায়’। মানতেই হবে এ অবনমন একদিনে হয়নি, ধীরে ধীরে হয়েছে। বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন ঘরোয়া ফুটবলের ম্যাচগুলোতে প্রচুর দর্শক সমাগম হতো আর আবাহনী মোহামেডামের ম্যাচ হলে তো কথাই নেই। এখন যেমন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাথে নিজ দেশে কোনো টেস্ট প্লেয়িং দেশের সাথে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হলে দর্শক উপচে পড়ে, খেলা শুরু হওয়ার ৪-৫ ঘণ্টা আগে থেকে টিকিট নিয়ে দর্শকরা অপেক্ষা করে থাকে, ঠিক তেমনি অবস্থা আমরা দেখেছিলাম বাংলাদেশের এককালীন ঘরোয়া ফুটবলে।
আবাহনী-মোহামেডান খেলার দিন তো যার যার সমর্থক গোষ্ঠীর ব্যানারে দূরদূরান্তে থেকে ব্যানার নিয়ে স্টেডিয়ামে আসত দর্শকরা। যা এখন ভাবলে অবিশ্বাস্য মনে হবে। তবে আশার কথা এই যে, কিছুটা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে ইদানীং। সালাউদ্দিন, সালাম মুর্শেদি, বাদল রায়ের মতো তারকা ফুটবলাররা এখন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের হাল ধরেছেন। তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আশা করি বাংলাদেশের ফুটবল এগিয়ে যাবেই।
ষ লেখক : চেয়ারম্যান, জয়যাত্রা ফাউেন্ডশন
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন