ড. শেখ সালাহ্উদ্দিন আহ্মেদ
মানুষ সবসময় সুস্থ থাকে না, নানা কারণেই অসুস্থ হয়ে পড়ে মানুষ। অসুস্থ হলে মানুষকে চিকিৎসা নিতে হয়। চিকিৎসা না নিলে দুঃখ বাড়ে, জীবন অচল হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের সমাজে সবাই কি চিকিৎসা নিতে পারেন? চিকিৎসা প্রসঙ্গে চলে আসে সুচিকিৎসার প্রসঙ্গ, চলে আসে সামর্থ্যরে বিষয়টিও। বর্তমান সময়ে তো চিকিৎসা নিয়ে উত্থাপিত হচ্ছে নানা অভিযোগ। আমাদের সমাজে নানা পেশা আছে, তবে চিকিৎসা পেশার রয়েছে অন্যরকম মর্যাদা। কারণ এই পেশার সাথে শুরু থেকেই জড়িত রয়েছে সেবার দৃষ্টিভঙ্গিটিও। কিন্তু বর্তমান সময়ে একটি সাধারণ অভিযোগ হলো, চিকিৎসাক্ষেত্রে এখন সেবার মনোভাবের চাইতে ব্যবসার লালসাটাই প্রবল হয়ে উঠেছে। ভুয়া ক্লিনিক, ভুয়া ডাক্তারের মতো অপরাধমূলক কর্মকা- এখন চিকিৎসা অঙ্গনের সাথে জড়িয়ে গেছে। এসবের বাইরেও এখন লক্ষ করা যায়- হাসপাতাল ও ডাক্তারদের ব্যাপারে আস্থার সংকট। এসব বিষয় চিকিৎসা অঙ্গনের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করছে। তবে আমাদের সমাজে এখনও কিছু ভালো হাসপাতাল ও উত্তম চিকিৎসক রয়েছেন। এ কারণেই হয়তো আমাদের সমাজে চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনও মুখ থুবড়ে পড়ে যায়নি। চিকিৎসা প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ; আর সেটি হলো- মানসম্পন্ন ওষুধ। কারণ চিকিৎসক যত ভালো ব্যবস্থাপত্রই দেন না কেন, ওষুধ মানসম্পন্ন না হলে হিতে-বিপরীত হতে পারে। অর্থাৎ রোগীর অসুস্থতার মাত্রা আরও বেড়ে যেতে পারে।
গত ২১ এপ্রিল ‘বিপজ্জনক ৫৪ ওষুধ কোম্পানি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন মুদ্রিত হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ক্যান্সার প্রতিরোধী ওষুধ বানিয়ে আসছে দেশীয় ওষুধ কোম্পানি টেকনো-ড্রাগ। কোম্পানিটি তৈরি ও বাজারজাত করছে পেনিসিলিন ও সেফালোস্পিরিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক এবং হরমোনজাতীয় ওষুধও। অথচ ওই কোম্পানির তিনটি কারখানার একটিতেও মানসম্পন্নভাবে এসব ওষুধ তৈরি করা হয় না। উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটির কাছ থেকে এমন চিত্র পেয়ে ওই কোম্পানির পেনিসিলিন ও সেফালোস্পিরিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক ও হরমোনজাতীয় ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি বাতিলের সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। শুধু এই একটি কোম্পানিই নয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৭৬ সালের জিএমপি (গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস) নীতিমালা অনুসরণ করে মানসম্মত উপায়ে ওষুধ প্রস্তুত না করাসহ আরও কিছু কারণে গত ২০ এপ্রিল দেশের ২০টি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলসহ মোট ৫৪টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি। এসব সুপারিশ কার্যকরের জন্য পাঠানো হবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। ২ বছর আগে সংসদীয় কমিটির এমন এক তদন্তকেন্দ্রিক সুপারিশ অনুযায়ী সরকার ৬২টি প্রতিষ্ঠানের ওষুধ উৎপাদন বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। ওই ৬২ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তখন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল হয়েছিল। পরে একাধিক প্রতিষ্ঠান উচ্চ আদালত থেকে লাইসেন্স বাতিল আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ পেয়ে তাদের কাজ চালিয়ে যায়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এবার শাস্তির আওতায় আসা কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি আগের দফায়ও শাস্তির আওতায় ছিল। সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘জিএমপি নীতিমালা অনুসরণ না করলে উৎপাদিত ওষুধ মানসম্মত হয় না। ব্যবহারকারীর রোগ না সেরে বরং শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। যে ক্ষতি প্রাণঘাতীও হতে পারে এবং এ ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য সার্বিক বিবেচনায় পরিত্যাজ্য।’
সংসদীয় কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওষুধ মানসম্পন্ন না হলে তা শরীরের মারাত্মক ক্ষতিই করে না; বরং প্রাণঘাতীও হতে পারে। এমন বক্তব্য থেকে মানসম্পন্ন ওষুধের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। আমরা জানি, সংসদীয় কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের। তাদের অফিসিয়ালি আদিষ্ট হওয়ার পরই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বাজার থেকে ত্রুটিপূর্ণ ওষুধ প্রত্যাহারের ব্যবস্থা নেয়ার কথা। তবে ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বক্তব্য হলো, ‘সংসদীয় কমিটির সুপারিশ বা মন্ত্রণালয়ের আদেশে আমরা যেসব ব্যবস্থা নিয়ে থাকি, অনেক ক্ষেত্রেই পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালতের আদেশে আমরা সেখান থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হই। এখনও বারো/তেরোটি কোম্পানি আমাদের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আদালত থেকে আদেশ পেয়ে উৎপাদন ও বাজারজাত চালু রেখেছে। আমরা আমাদের সাধ্যমতো আইনি লড়াই করছি।’ এমন বক্তব্যে উপলব্ধি করা যায়, মানসম্পন্ন ওষুধ পাওয়ার ক্ষেত্রে দেশে সমস্যা রয়েছে। এ সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব যাদের ওপর অর্পিত হয়েছে, তাদের এখনও অনেক কিছু করণীয় আছে। আইনি লড়াইটা ঠিকভাবে করতে হবে। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জনসাধারণকে মানসম্পন্ন ওষুধ প্রদানের দায়িত্ব ও গুরুত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে হবে। আর যারা ওষুধের ব্যবসা করছেন, তাদেরও চাতুর্য পরিহার করে উপলব্ধি করতে হবে- ওষুধের ব্যবসা অন্য দশটি ব্যবসার মতো নয়। এখানে নীতিনৈতিকতা ও সেবার দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দিতে হবে। অর্থের লালসা প্রবল হলে তাদের অন্য ব্যবসায় সরে যাওয়া উচিত। কারণ মানসম্পন্ন ওষুধ পাওয়া জনগণের অধিকার। এক্ষেত্রে চাতুর্য, শঠতা ও দায়িত্বে গাফিলতি কোনোভাবেই ক্ষমা পেতে পারে না। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবাই উপলব্ধি করে কিনা- সেটাই এখন দেখার বিষয়।
গতবছর জাতীয় ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইনের আওতায় ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল ও পোলিও এবং কৃমিনাশক বড়ি খাওয়ানোর পর সারাদেশে হাজার হাজার শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম, গাজীপুর, বগুড়া, ভোলা, নরসিংদীসহ কয়েকটি স্থানে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল ও কৃমিনাশক বড়ি খাওয়ানোর পর শিশুদের বমি ও পাতলা পায়খানা হয়।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ইতিপূর্বে বাংলাদেশ সরকার কানাডিয়ান একটি প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুতকৃত ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল সংগ্রহ করত। এবারই প্রথম সরকার ভারতীয় একটি কম্পানির তৈরি ওষুধ সংগ্রহ করেছে। এ ক্রয় প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে ওই ভারতীয় ওই কম্পানিটির যোগ্যতা ও তাদের ওষুধের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। তা উপেক্ষা করেই সরকার ভারতের অলিভ হেলথ কেয়ার নামক একটি অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১০ কোটি ক্যাপসুল ক্রয় করা হয়েছে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ উঠে, মেসার্স অলিভ হেলথ কেয়ার অনভিজ্ঞ এবং ভিটামিনজাতীয় ক্যাপসুল সরবরাহের বিষয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায়ও এর নাম নেই। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটি ইতিপূর্বে অন্যকোনো দেশে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল সরবরাহও করেনি। এমনকি নিজ দেশ ভারতেও নয়। একদিকে অনভিজ্ঞ, অন্যদিকে সম্পূর্ণ নতুন ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দীর্ঘকালীন পূর্বসমর্থিত নয়- এমন একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ২ কোটিরও বেশি শিশুর জন্য ভিটামিন এ ক্যাপসুল ক্রয় করা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত তা নিয়ে সংশিষ্ট অনেককেই করেছে প্রশ্নবিদ্ধ।
দেশের শিশু স্বাস্থ্য নিরাপদ এবং উন্নত করতে ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ান খুবই গুরুত্ববহন করে। বিশেষ করে রাতকানা রোগ প্রতিরোধে ‘ভিটামিন এ’ ক্যাপসুল বড় ভূমিকা রেখেছে। অতি গুরুত্বপূর্ণ এ কর্মসূচিতে বাধা পড়লে শিশু স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পরবে। অনেক শিশু মারাও যাবে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনগণের পুষ্টির স্তুর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন এবং বিশেষত: আরোগ্যের প্রয়োজন কিংবা আইন দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যবিধ প্রয়োজন ব্যতীত মদ ও অন্যান্য মাদক পানীয় এবং স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’
বাংলাদেশে ওষুধের ট্রায়াল নিয়ে বিরাজ করছে বিপজ্জনক বিশৃঙ্খলা। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী কোনো ওষুধ মানুষের ব্যবহারের জন্য উš§ুক্ত করার আগে কার্যকারিতা পরীক্ষায় পূর্ণাঙ্গ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে ওষুধ বাজারজাতের আগে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল দেয়া হয় না। ৯০০টি প্রতিষ্ঠান ২২ হাজার ব্র্যান্ড নাম ব্যবহৃত করে প্রায় ১ হাজার ২০০টি জেনেটিক ওষুধ বাজারজাত করছে। সাতটি উন্নত দেশে চালু রয়েছে এমন প্রমাণ দেখাতে পারলে ওষুধ বাজারজাতের ক্ষেত্রে সরকারি অনুমোদন খুব সহজেই পাওয়া যায়। কখনো ব্যত্যয় ঘটলে কেবল সে ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কাগজপত্র হাজির করা হয়। এ ব্যাপারে সরকারের যে নজরদারি থাকা উচিত তা তার অস্তিত্বে খুঁজে পাওয়া ভার। ফলে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নামে কার্যত প্রহসনের আয়োজন হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারেও সংশয় রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের ব্যাপক অগ্রগতি ঘটলেও ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে যতটা কড়াকড়ি থাকা উচিত সে ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। দেশে যেমন মানসম্মত ওষুধ উৎপাদিত হচ্ছে তেমন নকল, ভেজালের পরিমাণও কম নয়। আমি মনে করি, ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনের ক্ষেত্রে সরকারকে আরও বেশি নজর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো হেরফের বাঞ্ছনীয় নয়। প্রতিটি ওষুধ মানুষের ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত করার আগে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী যাতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করা সরকারের কর্তব্য বলে বিবেচিত হওয়া উচিত।
ষ লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ল’ ইয়ার্স ফোরাম
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন