ট্রেনে-বাসে, বাসস্ট্যান্ড-স্টেশনে পালিশওয়ালা ছেলেটিকে দিয়ে জুতো ঝকঝকে করিয়ে নেওয়ার পর আপনাদের কারোর যদি ভাঙানিটা না নিয়ে দু’পয়সা বেশি দিতে ইচ্ছে জাগে, অথবা নোংরা-নর্দমা থেকে পলিথিন-কাগজ কুড়ানো মেয়েটিকে দেখে করুণা হয়, অথবা জঞ্জালের গাদায় ছাই সরিয়ে কয়লার কুচি বার করা ছেলেমেয়গুলোকে ওভাবে খাটতে দেখে বাঁচাতে মন চায়, তবে এ লেখা আপনাদের জন্যই। জুতো পালিশ, কাগজ কুড়োনো, বনজঙ্গল থেকে জ্বালানি সংগ্রহ, জিনিষপত্র বিক্রির মতো কাজে যুক্ত শিশুদের অবস্থা তো মন্দের ভালো। স্বনিযুক্ত শ্রমিক হিসেবে কিছুটা স্বাধীনতা অন্তত ভোগ করে। কিন্তু আপনারা কি জানেন, কলকারখানায়, কুটিরশিল্পে আরো কত বেশি সংখ্যক শিশুকে অক্লান্ত শ্রমের শৃঙ্খলিত জীবনযাপন করতে হয়? শিশুশ্রম কত শিশুর নিষ্পাপ শৈশব কেড়ে নিয়েছে? সংখ্যাটা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। পৃথিবীর প্রতি ৬ শিশুর মধ্যে ১ একটি শিশুশ্রমিক। এদের দুর্দশা জানলে আপনি আরো একটু সহানুভুতিশীল হবেন, আশা করা যায়।
শিশুশ্রম আমার আপনার লজ্জা। চলমান সভ্যতার গায়ে কলঙ্কের দাগ। আমরা সবাই মিলে এই কলঙ্ক বহন করে চলছি উন্নত সভ্যতার চূড়ায় দাঁড়িয়েও। নইলে চাঁদে, মঙ্গলে যাওয়া মানুষের সন্তান কেন দুটি অন্নের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য হবে? জীবনে একবারই আসা শৈশবটাকেই বেঁচে খেতে হবে কেন? হ্যাঁ, পৃথিবীর ২৪ কোটি ৬০ লক্ষ শিশু শ্রমিকের মধ্যে ৭ কোটি ৩০ লক্ষ, যাদের বয়স ১০ বছরের কম। আমার আপনার নিজের সন্তান, শিশুটি যখন আদরে আদরে দ্রবিভূত, তখন বছরে ২২,০০০ শিশু মারা যায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, আইএলও’র হিসাব চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে বাংলাদেশ কার্পেট শিল্পে ২০০০ শিশুর রক্ত, ঘাম মিশছে ১২ ঘণ্টা ধরেই। কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতে, আমাদের দেশে ১৫ লক্ষ শিশু ক্রীতদাসের মতো গৃহস্থলীর কাজে নিযুক্ত আছে। আর অন্যান্য নানা ক্ষেত্রে আছে আরো তিন লক্ষ এ ধরনের শিশুশ্রমিক।
পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিশু শ্রমিক আছে আমাদের মতো এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে। ৫-১৪ বছর বয়সী প্রায় ১২.৭ কোটি অর্থাৎ বিশ্বের শিশুশ্রমিকের ৬০ শতাংশ কাজ করে হোটেল রেস্তোরাঁয়, ৭ শতাংশ গৃহস্থ বাড়িতে পরিচালক-পরিচারিকা হিসেবে, ৪ শতাংশ আছে পরিবহন-যোগাযোগ ক্ষেত্রে, ৩ শতাংশ নির্মাণ শিল্প, খনিতে পাথর কাটার কাজে। তবে আইএলও এ তথ্যও জানিয়েছে যে, বিশ্বে শিশু শ্রমিকের ৮০ শতাংশই নিযুক্ত পুরোনো সেই কৃষিক্ষেত্রেই। তার মানে চাষবাসে ফসল উৎপাদনে, প্রাণিপালনে, শিকারে, মাছ ধরায়। পরস্পরাগতভাবে এ কাজ তারা করেই চলেছে।
একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো, পৃথিবীর শিশু শ্রমিকদের মাত্র এক শতাংশ আছে শিল্পোউন্নত দেশগুলোতে। এই তথ্য থেকে আমরা খুব সহজেই শিশুশ্রম প্রথার কারণগুলো বুঝতে পারি। শিল্পোন্নত প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতে এ সমস্যা নেই, কারণ উন্নত আর্থ সামাজিক কাঠামো। কিংবা হয়তো সেই ব্যবস্থা, যা দিয়ে আমাদের শিশুদের শ্রম ওদের শিশুদের বিলাশ-ব্যসন পণ্য সামগ্রীতে ব্যবহৃত! এই নির্মম ব্যবস্থায় সাম্রাজ্যবাদী শোষণের কী কোনো ভূমিকা নেই? অতিরিক্ত অর্থনৈতিক শোষণ, ধনী দরিদ্রের মধ্যে আকাশ-পাতাল বৈষম্য, সামাজিক অস্থিরতা, প্রাপ্তবয়স্কদের বেকার জীবন, কর্মহীনতার মতো দারিদ্র্য সৃষ্টিকারী শর্তগুলোও শিশুশ্রম প্রথার জন্যও দায়ী। কারণগুলো আকাশের উল্কাপাত থেকে নয়, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা থেকেই উদ্ভূত। দারিদ্র্যই মূলত দায়ী। শিশুরা শ্রমিক হিসেবে অধিকাংশই অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিযুক্ত হয়। এর ফলে এদের অধিকার, সুযোগ সুবিধা, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়গুলো শ্রম সংক্রান্ত বিভিন্ন আওতার বাইরে থেকে যায়। এতে সুবিধা হয় নিয়োগকর্তা মালিকদের। কারণ এইসব শিশুদের মজুরি কম। তারা বাধ্য নয়, নমনীয়। শাসন করতে সুবিধে। দাবিদাওয়া নেই বললেই হয়, অথচ কাজ করার ক্ষমতা বড়দের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এরা ফাঁকি দিতে শেখেনি। সবচেয়ে বড় কথা, এদের ‘ইউনিয়ন’ নেই, তাই ঝামেলাও নেই। শিশু শ্রমিকদের তাই মালিকদের এত পছন্দের। শিশু শ্রমিকদের চাহিদা তাই এত বেশি। আবার কিছু অভিভাবকের অসচেতনতা, নিজেদের কুঁড়েমি, নেশাগ্রস্ততা, শিশুদের নিজেদের কাঁচা টাকার প্রতি লোভ এসবও আছে। কিছু মা-বাপ নিজেরা কম খেটে বা না খেটে সন্তানদের পাঠায়। মালিক বা দালালদের কাছে অগ্রিম টাকা নেয় কেউ কেউ তো শিশু সন্তানদের রোজগারের পয়সায় নেশাভাঙও করে। দরিদ্র ও অসচেতন এসব অভিভাবকের নেতিবাচক ভূমিকা শিশু শ্রমিক ব্যবস্থা জিঁইয়ে রাখে। শুধু তাই নয়, প্রচন্ড অর্থলোভী বিকারগ্রস্থ কিছু মানুষ শিশুদের দিয়ে মাদক পাচার, চোরাচালান এরমতো চরম ঝুঁকির কাজও করিয়ে নেয়। তাই তো শিশুশ্রম নিয়ে এত ভাবনা। তাই তো উদ্বেগ। তাই তো কিছু করার আকুতি। কিন্তু কে করবে? উত্তর হয়তো আসবে: কেন, রাষ্ট্রব্যবস্থা! রাজনৈতিক নেতারা কী করছেন! এমন দুঃসহ অবস্থা পরিবর্তনে কিছু করার নেই? দেশে আইন নেই? আছে। কিন্তু তা সত্তে¡ও এই অবস্থা। কারণ শিশুশ্রম এমন এক ব্যস্ত সমস্যা যার চটজলদি সমাধান আইন করেও সম্ভব নয়। রাষ্ট্রনৈতিক কর্তারা যে কিছুই করছেন না, তা কিন্তু নয়। শিশুশ্রম নিয়ে রাষ্ট্রনৈতিক ভাবনারও এক ক্রমান্বয়িক ইতিহাস আছে বৈকি! আছে আইন এবং আইন তৈরির উপাখ্যান। আমাদের পেনাল কোডে বিভিন্ন ধারায় শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা আছে। সগর্বে কাগজের পৃষ্ঠায় আছে মতো শ্রম আইন, ন্যূনতম মজুরি আইন। এইসব আইন কার্যকর হলেই তো শিশুশ্রম প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যেত। কিন্তু তা যে হয়নি, সেটা তো আমরা সবাই দেখছি। শিশুশ্রম প্রথা রুখবার জন্য আন্তর্জাতিক স্তরেও বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যেমন-আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের (আই এলও) ‘ন্যূনতম বয়স সংক্রান্ত আইন’ এর ১৩৮ নম্বর ধারা। চালু আছে শিশুশ্রম নিরোধ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কর্মসূচি (International Programme on the Elimination of Child labour IPEC) বা আইপিসি-যার উদ্দেশ্য শিক্ষার প্রসার ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির এই প্রথা বিলোপ করা। রয়েছে শিশুর অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘের আইন (Convention on the Rights on the Child) আছে আইএলও পরিচালিত চাইল্ড লেবার অ্যাকশন সাপোর্ট প্রোজেক্ট (CLASP)। এর উদ্দেশ্য হলো দেশে দেশে জাতীয় সরকারগুলোর পরিকল্পনা গ্রহণ ও রূপায়নের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলা। সারা পৃথিবীর এইসব অবহেলিত নিপীড়িত শিশুদের সমস্যা নিয়ে ১৯৯০ সালে যে বিশ্ব শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় থাকে শিশুদের অস্তিত্ব, নিরাপদ ও বিকাশের জন্য একটি ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। শিশুশ্রমদের ইতিহাসে এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর সমস্ত দেশকে আহ্বান জানানো হয়। বিপজ্জনক কাজে নিযুক্ত ও শোষিত শিশুদের সুস্থ ও উন্নত জীবন যাপনের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য একটি কর্ম পরিকল্পনাও নেওয়া হয় এখান থেকে। এরপর ১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ ও অন্যান্য বিকাশশীল দেশগুলোর শ্রম মন্ত্রীদের এক বিশ্ব সম্মেলনে শিশু শ্রমকে একটি ‘চরম নৈতিক অপরাধ’ এবং মানবিকতা ও আত্মমর্যাদার প্রতি অত্যন্ত অবমাননাকর বলে বর্ণনা করা হয়। এই সম্মেলনেও শিশুশ্রম নির্মূল করার জন্য কর্ম পরিকল্পনা নেওয়া হয়। পরের বছর ১৯৯৬ সালে জোট নিরপেক্ষ ও সার্ক সদস্যভূক্ত দেশগুলোর দুটি পৃথক বৈঠকে এ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রথমটিতে বিপজ্জনক কাজে শিশু শ্রমিক বন্ধ ও দ্বিতীয়টিতে ২০১০ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে শিশুশ্রম নির্মূল করার কথা ঘোষণা করা হয়।
শিশুদের শোষণ-বঞ্চনার বর্ণনা শেষ করা যাবে না। তার ওপর আছে কাজের জায়গায় পরিবেশের দুঃসহ অবস্থা। নোংরা, ঘিঞ্জি, গরম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শিশুদের কাজ করতে হয় রাতে থাকার জায়গাও হয় না। কোনো ছাউনি বা কাজের জায়গায় দম-বন্ধ করা কোণাটুকুই। অগ্রিম নেওয়া থাকলে মজুরি দেওয়া হয় আরো কম। পরিশোধ করার হিসাব ইচ্ছাকৃত কারচুপিও করতে ছাড়ে না অনেক মালিক বা তার দালাল। সীমাহীন দুর্দশার সেসব কাহীনি সত্যি অবর্ণনীয়, অমানবিক। একসময় বলা হতো বড়োদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, মহিলাদের ক্ষমতায়ন, সর্বশিক্ষার আয়োজন, উপযুক্ত আইন করলে এই প্রথা নির্মূল হবে। ১০০ দিনের কাজ, বিভিন্ন ভাতা ইত্যাদির মাধ্যমে দুর্বল পরিবারগুলোকে নিরাপত্তা যোগানের কাজ কিছুটা হলেও কার্যকর হয়েছে। পুরনো কিছু দাবি-দাওয়া ইতোমধ্যে পূরণ হয়েছে। কিন্তু শিশু শ্রমিকদের সংখ্যা কমেছে কি? কিছুটা যে কমেছে তা আমরা জানি। কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ কবে হবে? হবে, যদি আমরা সবাই মিলে মাথা ঘামাই। যদি জুতো পালিশের সেই শিশুটির খুঁজ না করে ওই পালিশ বুড়োকে দিয়ে করাই, যদি শিশুর রক্ত ঘামে গড়া পণ্যে নিজেদের ভোগবিলাস না বাড়াই, যদি একটি সহানুভূতিশীল সামান্য কিছু করি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন