আন্তর্জাতিক শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস ২০২১ পালন করা হলো। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ ও শিশুদের লেখাপড়ায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে International Labour Organization (ILO) ১৯৯২ সাল থেকে শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটি পালনের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার শিশুশ্রম প্রতিরোধ ও লেখাপড়া চালু রাখার জন্য বহুমুখী কর্মসূচী চালু রেখেছে। সরকার ইতিমধ্যে শিশু অধিকার সনদ ও ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বিষয়ক আইএলও কনভেনশনে অনুসমর্থন করেছে। এছাড়া সরকার শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যে জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি-২০১০ প্রণয়ন করেছে। এছাড়া মুজিববর্ষ উপলক্ষে দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘মুজিববর্ষের আহবান শিশু শ্রমের অবসান’। সরকার প্রতিপাদ্যকে লক্ষ্য করে শিশুশ্রম নিরসনে কাজ করে যাচ্ছে। জাতিসংঘ ২০২১ সালকে শিশুশ্রম নিরসন বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এবার শিশুশ্রম প্রতিরোকল্পে শিশুদের সার্বিক বিকাশ নিশ্চিত করতে এবং এসডিজি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম ও ২০২৫ সালের মধ্যে দেশকে পরিপূর্ণ শিশুশ্রম মুক্ত করার কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার শিশুশ্রম নিরসনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা, বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘ, আইএলও এবং ইউনিসেফ গত ২০ বছরে শিশুশ্রম প্রতিরোধে যে ভূমিকা রেখেছিলো এবং কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করেছিলো তা এখন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। করোনাকালীন এই বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে শিশুশ্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধিও হার খুবই বেশি। সম্প্রতি আইএলও এবং ইউনিসেফ জানিয়েছে কোভিড-১৯ মহামারিতে অতিরিক্ত ৯০ লাখ শিশু ঝুঁকির মুখে পড়েছে। বিশ^ব্যাপী বর্তমান শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ১৬ কোটি। এছাড়া এই মহামারির কারণে তুলনামূলক অনুন্নত দরিদ্র দেশগুলোতে আরও লাখ লাখ শিশু ঝুঁকিতে আছে। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে জানিয়েছে, ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধির কারণে অনেক শিশু পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে শিশুশ্রম ঝুঁকে পড়েছে। (সূত্র: চাইল্ড লেবার গ্লোবাল এস্টিমেটস ২০২০ ট্রেডস এন্ড দ্যা রোড ফরওয়ার্ড)
আইএলও এবং ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, শিশুশ্রম নিয়ে অতীতের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে করোনাকালীন দুর্যোগ প্রবল হুমকির স্বরূপ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় দেড় বছর বন্ধ আছে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন সমাজের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সন্তানেরা লেখাপড়া করে তেমনি দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের সন্তানেরাও লেখাপড়া করে। সরকারের বিনা বেতনে অধ্যয়ন ও বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ প্রকল্পের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হলো শ্রমজীবী পরিবারের শিক্ষার্থীরা। শ্রমজীবী পরিবার তাই তাদের সন্তানদের শিশু শ্রমে না পাঠিয়ে স্কুলগামী করেছিল। অথচ, কোভিড-১৯ মহামারির ছোবলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুদের বিভিন্ন কারখানা, হোটেল, ওয়েল্ডিং কারখানা, সড়ক ও পরিবহণ, যন্ত্রাংশ নির্মাণ কারখানা, তামাক কারখানা, ব্যাটারিচালিত ভ্যান-রিক্সা চালানোতে নিয়োজিত করছে। যেহেতু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি এবং শিশু শ্রমের চাহিদা প্রচুর তাই অভিভাবক ও কারখানার মালিকেরা শিশু শ্রমে শিশুদের বাধ্য করছে। অনলাইনভিত্তিক শিক্ষাকার্যক্রম চলমান থাকলেও শ্রমজীবী পরিবারের শিশুরা সেই কার্যক্রম থেকে পিছিয়ে আছে। কার্যত ২০২০ সাল থেকেই তারা লেখাপড়া ও একাডেমিক সকল কার্যক্রম থেকে ছিটকে পড়েছে। সমাজের এই অংশের শিশুরা এখন উদ্বেগজনকহারে শিশুশ্রমে ঝুঁকছে। করোনাকালীন মহামারির সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ও কলকারখানা চালু থাকায় শিশুশ্রম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে মনে করি। পরিবারের কিছুটা আর্থিক সচ্ছলতা ও নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে শিশুশ্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০১৩ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ১৭ লাখ শিশু বিভিন্ন ধরনের শ্রমের সাথে যুক্ত। অন্যদিকে গবেষণায় জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দারিদ্রের হার ১ শতাংশ বৃদ্ধি শিশুশ্রমের কমপক্ষে ০.৭ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটায়। করোনা মহামারিতে আমাদের দেশের প্রায় ২.৫০ কোটি মানুষ নতুনভাবে দরিদ্র হয়েছে। ফলে এই দরিদ্রতার সাথে সাথে শিশুদের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। ফলে শিশুশ্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। শিশুরা এখন লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। এই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা সরকারের হাতে আছে কিনা জানা নেই। তবে আমাদের মতো দরিদ্র দেশের জন্য এই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরা যদি শিশুশ্রমে একবার নিয়োজিত হয়ে যায় তবে আগামী দশকে শিক্ষার হার নিম্নমুখী হবে। ফলে বাংলাদেশে শিক্ষার উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে শিশু শ্রম সম্পূর্ণ নির্মূল করার কর্মসূচী পরিপূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়ে যাবে। এর ফলে সমাজের একাংশ জাতীয় উন্নয়নের মূল স্রোতধারা থেকে ছিটকে যাবে।
এখন প্রয়োজন ইতোমধ্যে যে সকল শিশু বিভিন্ন কারখানায় কাজ করছে তাদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করে শিশু শ্রমের কারণ উদ্ঘাটন করা। যদি শিশুশ্রম অর্থনৈতিক কারণে যুক্ত থাকে তাহলে সরকার সেসব পরিবারকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করতে পারে। মনে রাখা দরকার শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রক্ষায় যেমন হাজার কোটি টাকা ঋণ সহায়তা, অনুদান প্রদান করে সেগুলো সচল রাখা প্রয়োজন তেমনি শিশু শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতেই হবে। জাতির মেধাবিকাশ শিশু শ্রমের বদলে শিশু শিক্ষা কার্যক্রম অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।
আইএলও, ইউনিসেফ, জাতিসঙ্ঘ নীতিমালার আলোকে সরকারকে নতুন করে শিশুশ্রম প্রতিরোধে রূপকল্প দাঁড় করাতে হবে। আইএলও এর গবেষণাপত্র ও রিপোর্টকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে সেই আলোকে নতুন ভাবে নীতিমালা প্রনয়ণ করতে হবে। দেশের শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) অনুযায়ী, শিশুশ্রমের নিয়োগের মধ্যে বলা আছে ১২ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের হালকা শ্রমে নিয়োজিত করা যাবে। অথচ, অত্র আইনে হালকা শ্রমের কোনো সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। ফলে আইন সংশোধন করে হালকা শ্রমের খাতগুলো আলাদা করে দিলে শিশুশ্রম চিহ্নিত করা সহজ হবে। সরকারের গৃহীত সকল নীতি ও আইন যথাযথ কর্মপরিকল্পনার আওতায় এনে কার্যকর ও বাস্তবায়ন করতে হবে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত ভিশন-২০২৫ কে বাস্তবায়ন করতে হবে। শিশুশ্রম বিষয়ে শ্রমজীবী এলাকায় সেমিনার, সভা করে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। এই করোনাকালীন সময়ে আর্থিক অসচ্ছল শিক্ষার্থীর প্রয়োজনীয় বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন এনজিও সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে। শিশুশ্রম রোধে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের গণ সচেতনতা, প্রতিরোধ, শিশু আইন বাস্তবায়ন ও সরকারী বেসরকারি সংস্থাগুলোর ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। তাহলে মুজিববর্ষের আহবান, শিশু শ্রমের অবসান বাস্তব রূপ পাবে।
মধ্যবিত্ত শ্রেণির সন্তানেরা লেখাপড়া করে তেমনি দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের সন্তানেরাও লেখাপড়া করে। সরকারের বিনা বেতনে অধ্যয়ন ও বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ প্রকল্পের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হলো শ্রমজীবী পরিবারের শিক্ষার্থীরা। শ্রমজীবী পরিবার তাই তাদের সন্তানদের শিশুশ্রমে না পাঠিয়ে স্কুলগামী করেছিল। অথচ, কোভিড-১৯ মহামারির ছোবলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুদের বিভিন্ন কারখানা, হোটেল, ওয়েল্ডিং কারখানা, সড়ক ও পরিবহন, যন্ত্রাংশ নির্মাণ কারখানা, তামাক কারখানা, ব্যাটারিচালিত ভ্যান-রিকশা চালানোতে নিয়োজিত করছে। যেহেতু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি এবং শিশু শ্রমের চাহিদা প্রচুর তাই অভিভাবক ও কারখানার মালিকেরা শিশু শ্রমে শিশুদের বাধ্য করছে। অনলাইনভিত্তিক শিক্ষাকার্যক্রম চলমান থাকলেও শ্রমজীবী পরিবারের শিশুরা সেই কার্যক্রম থেকে পিছিয়ে আছে। কার্যত ২০২০ সাল থেকেই তারা লেখাপড়া ও একাডেমিক সকল কার্যক্রম থেকে ছিটকে পড়েছে। সমাজের এই অংশের শিশুরা এখন উদ্বেগজনকহারে শিশুশ্রমে ঝুঁকছে।
সরকারের ইতোমধ্যে গৃহীত শিশুশ্রম প্রতিরোধে যাবতীয় কার্যক্রম খুবই ফলপ্রসূ ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ সময়ে অন্যান্য সেক্টরের ন্যায় শিশুশ্রম প্রতিরোধে যুগোপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশু শ্রমিকদের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনা হবে সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারের শিশুশ্রম রোধে প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত তাদেরকে শিক্ষা কার্যক্রমের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা। অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম থেকে তারা কার্যত বঞ্চিত। তাই কীভাবে তাদের শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনা যায় তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। সেক্ষেত্রে শ্রমজীবী শিক্ষার্থীদের এলাকায় প্রজেক্টরের মাধ্যমে নিয়মিত পাঠদান কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে। ফলে তারা শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত থাকলে শিশুশ্রমে ঝুঁকবে না।
লেখক: লেকচারার, আইন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা
asadlaw@ku.ac.bd
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন