সৈয়দ শামীম শিরাজী, সিরাজগঞ্জ থেকে
সিরাজগঞ্জ জেলার ৯টি উপজেলার ১১টি থানায় ইরি-বোরো মৌসুমি ধান কাটা ও মাড়াই চলছে। ঋণগ্রস্ত প্রান্তিক কৃষকদের ঘাম ঝরানো ফসল যাচ্ছে মহাজনের গোলায়। অপরদিকে নতুন ধানের দরপতন, শ্রমিকের মূল্য বেশি, শ্রমিক সঙ্কট, ঝড়বৃষ্টির আশঙ্কায় কাঁচাপাকা ধান কাটা প্রভৃতি নানাবিধ প্রতিকূল পরিবেশের কারণে এবার কৃষকদের মুখে হাসি নেই। দুঃখের আগুনে পুড়ছেন তারা। উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার মৎস্য ভা-ার নামে খ্যাত সিরাজগঞ্জসহ চলনবিল অঞ্চলে ইরি-বোরো ধানের বাম্পার ফলন হলেও নানাবিধ সমস্যার কারণে কৃষকদের মুখে নেই হাসির ঝিলিক। প্রান্তিক কৃষকরা ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করেছিল। তাদের ঋণ পরিশোধ করতে সব ফসল চলে যাচ্ছে মহাজনদের গোলায়। ধানের দাম কমে যাওয়া, শ্রমিকের সঙ্কট ও শ্রমের মূল্য বেশি, অভাবের কারণে আগাম কাঁচাপাকা ধান কাটা প্রভৃতি নানাবিধ কারণে কৃষকদের এবার লোকসান গুনতে হচ্ছে। বর্তমানে এক মণ ধানের মূল্য ও একজন দিনমজুরের (কামলা) দিন হাজিরা সমপরিমাণ হওয়ায় কৃষকরা বিপাকে পড়েছেন। গত মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে জেলার সর্বত্র ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হওয়ায় কামলা সংকট ও মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়ও শ্রমিক মিলছে না। কারণ সম্পর্কে স্থানীয় কৃষকরা জানান, অসহ্য গরম, লু-হাওয়ায় মাঠে যেমন কাজ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে, তেমনি দীর্ঘদিন বৃষ্টিপাত না হওয়ায় যে কোনো মুহূর্তে ঝড় ও প্রচ- শীলা বৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে মনে করে অনেক কৃষকই ক্ষেতের কাঁচাপাকা ধান আগাম কাটার জন্য শ্রমিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। মৎস্য ভা-ার নামে খ্যাত সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে উঠছে ধান, কমছে দাম। হতাশায় ভুগছে কৃষককূল। কৃষির প্রতি অনীহা বাড়ছে কৃষকের। চলনবিল জনপদের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষের জীবিকা কৃষিনির্ভর। তাদের একমাত্র ফসল বোরো ধান। তাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে প্রতি বিঘা জমিতে ধান চাষ করতে খরচ পড়েছে ২২ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা। এরমধ্যে জমি সেচ, বীজ বোনা, সার দেয়া ও শ্রমিকের মজুরিসহ বিভিন্ন ধরনের খরচ রয়েছে। আর ধান কাটানো থেকে গোলায় উঠানো পর্যন্ত প্রতি একরে আরও খরচ পড়েছে ১৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা অর্থাৎ ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা খরচ করে দাম পাচ্ছে ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি বিঘায় লোকসান হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। কৃষকভেদে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। কোনো কোনো কৃষক এক থেকে দুই বিঘা বা তার চেয়ে কম জমিতে ধান চাষ করেছেন। যাদের আবার একমাত্র সম্বল এই একটি ফসল। এ শ্রেণীর মানুষের সংখ্যাই বিল-অঞ্চলে বেশি। এরা যখন ফসল ফলিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন তখন স্বাভাবিকভাবেই জীবন-জীবিকার তাগিদে ভিন্ন পথ খোঁজা শুরু করে দিচ্ছেন। এদিকে বিপাকে পড়েছেন বর্গা চাষিরা। তারা জমির মালিকের ভাগ দেয়ার পর নিজেদের তেমন কিছুই থাকছে না। এদের মধ্যে যারা মহাজনের ঋণ নিয়েছেন তাদের ফসল মহাজনের গোলায় চলে যাচ্ছে। অত্র গ্রামের বর্গা চাষি আব্দুল মালেক জানান, চিন্তা করছি, সামনে আর ধান ক্ষেত করব না। ক্ষেত ছেড়ে দেব। ক্ষোভের সাথে তিনি আরও জানান, এবার বৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টি থেকে ইরি-বোরো ধান রক্ষা হলেও রক্ষা হচ্ছে না চাতাল মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগী মহাজনদের কাছ থেকে। হাটবাজারে ধান উঠলেও ক্রেতা না থাকায় বিক্রি না হওয়ার সুযোগ নিচ্ছে চাতাল মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগী মহাজনরা। অপরদিকে আব্দুল লতিফ জানান, গত বছর ধান কাটতে প্রতি একরে খরচ পড়েছে দুই হাজার টাকা, চলতি বছর খরচ হচ্ছে ৪ হাজার টাকা। শ্রমিকের মজুরি ৫০০ টাকা আর ধানের মণ ৪০০ টাকা। এক মণ ধান বিক্রি করে ১ কেজি ইলিশ মাছ কেনা যায় না। এ দুঃখ রাখার জায়গা কোথায়? সিরাজগঞ্জ সদর অঞ্চলের আদর্শ কৃষক রাজ্জাক, রেজা, জসিম, বেলাত ও জালাল জানান, প্রান্তিক কৃষকরা যারা শুধু ব্যাপক ঋণ ও সুদে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করেছেন তারা চোখের জলে গা ভাসাচ্ছেন। কেননা তারা ধান বিক্রি করে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতেই অপারগতা প্রকাশ করছেন। আর যারা চড়া সুদে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন, ঘাম ঝরানো সেই ফসল তাদের ঋণ শোধ করতেই মহাজনের বাড়িতে পৌঁছে দিতে হচ্ছে। নিজেদের উদ্বৃত্ত আর কিছুই থাকছে না। মৌসুমের শুরুতে ধানের দাম বৃদ্ধি পেলে কৃষকদের এমন দুর্দশা হতো না। এদিকে সরকার প্রতি কেজি ধান ২৩ টাকা হারে ক্রয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট খাদ্য বিভাগকে নির্দেশ দিলেও অনেক স্থানেই যেমন ন্যায্যমূল্য সরকারিভাবে ধান কেনার অভিযান শুরু হয়নি। অন্যদিকে কোনো কোনো স্থানে শুরু হলেও তাতে প্রান্তিক কৃষকরা সুযোগ পাচ্ছেন না। তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে এবং উৎকোচ দাবি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক কৃষক জানান, সরকারিভাবে ধান ক্রয় অভিযানে ধান যতই শুকিয়ে নেয়া হোক না কেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মেশিনে দিয়ে দেখে উৎকোচ না দেয়ার কারণে নিচ্ছে না। বলা হচ্ছে, শুকানো ঠিক হয়নি। অথচ কম শুকানো ধান উৎকোচের মাধ্যমে কেনা হচ্ছে বলে কৃষকরা অভিযোগ করেছেন। আসলে কৃষকদের কোনো সুখ নেই বলে জনৈক প্রান্তিক কৃষক মন্তব্য করেন। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ সূত্রে জানা গেছে, সিরাজগঞ্জ জেলায় প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধানের চাষাবাদ করা হয়েছে। আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৯ লাখ মেট্রিক টন ধান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন