‘জাগা জমি নি, ঘর দোর নি। কাজ দেয় না কেউ। অর্থকড়ি নি তা বাচপো কেম্যায়, কী খাব? তারও ঠিক নি। এ কষ্টের শেষ কনে? নাম তো অনেকবার লিখল। কিচ্ছু তো দ্যালো না। এলাকার লোকেরাও ভালো চকি দেখে না। স্বামীর বাঘে নেছে তাই মানুষ ঘেন্যার চকি দ্যাখে। মিশতি চায় না। পাশে দাঁড়ায় না।’ কথাগুলো বলছিলেন সত্তর বছরের বৃদ্ধা এক সংগ্রামী নারী ‘বাঘ বিধবা’ সোনামনি। তিনি থাকেন জেলার শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জ বাজারের পেছনে জেলেপাড়ায়। বলতে গেলে একাকী জীবন কাটছে তার। বাল্যকালে এই সোনামনির বিয়ে হয়। বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় ১৯৯৯ সালে সুন্দরবনে মৎস্য শিকারে গেলে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায় তার স্বামী। মাত্র একমাস বয়সী শিশুসহ স্বামীর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় শ্বাশুড়ি। সমাজ সোনামনিকে ‘অপয়া’ বলে আখ্যা দেয়। যেন তার অপরাধের কারণে স্বামীকে বাঘে নিয়েছে।
এভাবে দিন যেতে থাকে। কিছুদিন পরে দেবরের সঙ্গে বিয়ে হয় সোনামনির। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে ২০০২ সালে দ্বিতীয় স্বামী সুন্দরবনে মৎস্য শিকরে গেলে বাঘের আক্রমণে প্রাণ দিতে হয় তাকেও। দুই স্বামী বাঘের পেটে যাওয়ার পর সোনামনিকে স্থানীয়রা ‘স্বামীখেকো’ আখ্যা দিয়ে সমাজ থেকে আলাদা করে দেয়। এতে সমাজে চলাফেরা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। সমাজ তাকে অপয়া, অলক্ষ্মী বলে আখ্যা দেয়। শ্বাশুড়ি তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখেন, যাতে সকালে ঘুম থেকে উঠে সোনামনির মুখ দেখতে না হয়।
সোনামনির প্রথম স্বামীর একটি সন্তান ও দ্বিতীয় স্বামীর তিনটি সন্তান। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলে মেয়েরা সবাই বিবাহিত এবং আলাদা আলাদা। কিন্তু মাকেও তারা দেখে না। বর্তমানে সংসার কিভাবে চলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার আর সংসার! আমি একলা না! গাঙে (নদীতে) জাল টানি মাছ, কাঁকড়া ধরি, ঘেরে মাটি কাটার কাজ করি। যখন যে কাজ পাই তা করি। এভাবে চুলতিছে। তবে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমি বিধবা তা তোমরা জানো কিন্তু আমাগে চেয়ারম্যান, মেম্বাররা তা জানে না।
বেসরকারি সংস্থা লিডার্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাঘের আক্রমণে মারা গেছে পাঁচ শতাধিক বনজীবী। ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাঘের আক্রমণে কারো নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে ২০১৭ সালে তিনজন নিহত ও একজন আহত হওয়ার খবর জানা গেছে। আর সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় প্রায় এক হাজার ৫০০ বাঘ-বিধবা নারী রয়েছেন। একজন সোনামনির গল্প থেকেই হাজারো বাঘ বিধবা নারীর জীবন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। একের পর এক ঘটনা বলছিলেন। কত সাংবাদিক যে তার গল্প শুনতে গেছেন- তার হিসেব নেই। নিজের জীবনে পরিবর্তনের ছোঁয়া না লাগলেও সোনামনি এখন একজন ‘তারকা’।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন