আবদুল ওয়াজেদ কচি, সাতক্ষীরা থেকে
‘কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।’- প্রখ্যাত এই খনার বচনটি মানুষের অন্তরে গেথে আছে বহু কাল ধরে। বচনটি পরিবর্তন না হলেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে তাঁতে। উৎপাদনেও এসেছে পরিবর্তন। তাই ‘তাতেই কাপড়, তাতেই ভাত’র স্থলে এখন ‘তাঁতেই গজ ব্যান্ডেজ, তাঁতেই ভাত’ বললেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কেননা সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার নলতায় তাঁতে উৎপাদিত হচ্ছে উন্নতমানের গজ ব্যান্ডেজ। আর উৎপাদিত গজ ব্যান্ডেজ যাচ্ছে রাজধানী ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রামসহ সারাদেশে।
নলতা ইউনিয়নের নলতা শরীফ এলাকায় ঢুকতেই কানে শব্দ আসে খট খট খটা খট....। এক বাড়ি নয়, দু’বাড়ি নয়, পাশাপাশি প্রায় সব বাড়িতেই একই শব্দ। প্রত্যেক বাড়িতে চলছে আধুনিক বিদ্যুৎচালিত তাঁত ‘পাওয়ার লুম’। পাশাপাশি দু’তিনটি পাওয়ার লুম পরিচালনা করছেন একেকজন। কেউবা বুনছেন সুতা। ১০ বছর আগেও এখানকার কারিগররা হস্ত পরিচালিত তাঁতে বুনতেন শাড়ি, গামছা ও লুঙ্গি। কিন্তু এখন সবাই বুনেন গজ ব্যান্ডেজ। আর তার উপরই নির্ভর করে খনার ‘তাতের ভাত’ অর্থাৎ জীবন-জীবিকা। ইলিয়াস কারিগর। পারিবারিকভাবেই তাঁতের সঙ্গে পরিচিত তিনি। ১৮ বছর ধরে নিজ বাড়িতেই আপন মনে তাঁত বুনছেন ইলিয়াস কারিগর। জানালেন, বাপ-দাদারা সবাই তাঁত বুনতেন। তখন শাড়ি, গামছা, লুঙ্গি তৈরি হতো। জেলাব্যাপী নলতার গামছার নাম ছিল। আমিও কাজ শিখে প্রায় আট বছর শাড়ি, গামছা, লুঙ্গি তৈরি করেছি। কিন্তু ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। এলাকার সবাই চলে আসি গজ ব্যান্ডেজে। শাড়ি, গামছা, লুঙ্গি তৈরিতে কোন সমস্যা ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন আর সেই রং, সুতা আসে না। রং করলে স্থায়ী হয় না। তাই সবাই গজ ব্যান্ডেজের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এখন মহাজনরা নারায়ণগঞ্জ থেকে সুতা এনে আমাদের দেয়। আমরা শুধু তৈরি করি এবং সে অনুযায়ী মজুরী পাই। অনেকটা পারিবারিকভাবেই এ পেশায় এসেছেন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী শরীফ খান। তিনি বলেন, সুতা মহাজন দেয়। আমরা শুধু কাজ করি। মেশিনও আমাদের। প্রতিটি ৩৬ হাতের গজ ব্যান্ডেজ তৈরি করে ১৮ টাকা পায়। একা তিনটি মেশিন চালানো যায়। প্রত্যেকটি মেশিনে দিনে ৬/৭টি গজ ব্যান্ডেজ হয়। এই এলাকার শওকত কারিগর বলেন, এখন তো আর হাতের তাঁত নেই। একেকটা মেশিন (পাওয়ার লুম) ২৪ হাজার টাকা দাম। ওই কিনে কাজ করি। তিনটি মেশিনে প্রতিদিন গড়ে তিন’শ টাকা পাই। আগে আয় বেশি হতো উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন ৩৬ হাত লম্বা গজ ব্যান্ডেজ তৈরি করে মাত্র ১৮ টাকা পাই। কিন্তু তাঁতে উৎপাদিত শাড়ির দাম বেশি ছিল। যদিও এখন উৎপাদন বেশি, কষ্ট কম। মেশিন চালিয়ে একটু দেখাশুনা করলেই হয়। শওকত কারিগরের সাথেই কাজ করছিলেন তার স্ত্রী লতিফা। তিনি বাধছিলেন সুতা। সুতা বাধার জন্য তিনি পান একশ টাকা। মেশিনে কষ্ট কম বলে শওকত কারিগর কিংবা লফিতার মতো প্রায় পাঁচ শতাধিক দম্পতি পারিবারিকভাবেই জড়িয়ে পড়েছেন আধুনিক তাঁতের গজ ব্যান্ডেজ তৈরির কাজে। পরিবারের সবাই মিলে কাজ করেন পাওয়ার লুমে। এ বিষয়টিই বেশ ইতিবাচকভাবে বলছিলেন ইয়াসিন কারিগর। তিনি জানান, এলাকার বেকার ছেলেরা এখন পাওয়ার লুমে কাজ করে। বেশ আয়ও হয়। এ কাজে কোন ঝামেলা ঝনঝাট নেই। তবে, আধুনিক পাওয়ার লুমে যে কোন সমস্যা নেই তা কিন্তু নয়। বিদ্যুৎ না থাকলে বন্ধ হয়ে যায় নলতা শরীফ এলাকার গজ ব্যান্ডেজ তৈরির এই কর্মযজ্ঞ। রয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীদের থাবাও। এলাকায় মহাজন বলে পরিচিত শ্যাম চন্দ্র পাল জানান, তার কারখানায় ২৫টি পাওয়ার রুম রয়েছে। ৮/৯জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করে। নারায়ণগঞ্জ থেকে সুতা এনে প্রায় প্রত্যেক পরিবারেই সরবরাহ করেন তিনি। একই সাথে তার কারখানায়ও কাজ চলে। তিনি বলেন, সুতা এনে গজ ব্যান্ডেজ তৈরি করাতে প্রত্যেক পিসে ১৮ টাকা দিতে হয়। তারপর ব্যান্ডেজগুলো ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করে পাঠানো হয় ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রামসহ সারাদেশে। আমরা সুতার দাম ধরে দু’তিন টাকা লাভ করে ছেড়ে দেই। কিন্তু সরকার যদি সরাসরি আমাদের কাছ থেকে মাল নেয়, তাহলে আমরাও বাঁচবো, ক্ষুদ্র কারিগররাও বেশি মজুরি পাবে। সরকার তো আমাদের কাছ থেকে মাল নেয় না। আমরা দেই বড় বড় কোম্পানিকে। তারা দেয় সরকারকে। বঞ্চিত হয় আমরা। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন