ঝিনাইদহের চারটি ইউনিয়নের ১৯ জন যুবক ৬ বছর ধরে নিখোঁজ। এর মধ্যে সদর উপজেলার হলিধানী ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর গ্রামের আব্দুল্লার ছেলে আব্দুল হামিদ, মৃত তোফাজ্জেলের ছেলে লাবলু রহমান জিতু ও আবুল কাসেমের ছেলে আরাফাত। একই ইউনিয়নের গাড়ামারা গ্রামের গোলাম রসূলের ছেলে রিপন, গোলাম মোস্তফা দুলালের ছেলে ফরিদ হোসেন, ইদ্রিস আলির ছেলে আবু বকর, শহর আলির ছেলে নাজমুল হক, নাছির উদ্দিনের ছেলে লালচাঁদ, বসির উদ্দিনের ছেলে মাসুদ রানা মচু, শাহী উদ্দিনের ছেলে আলমগীর ও লুৎফর রহমানের ছেলে অলিয়ার রহমান, ফুরসন্দি ইউনিয়নের মিয়াকুন্ডু গ্রামের সাহেব আলী মন্ডলের ছেলে ইউনুছ আলী, জলিল জোরদারের ছেলে বাচ্ছু জোয়ারদার, ময়েন উদ্দিন জোয়াদ্দারের ছেলে বিপুল জোয়াদ্দার ও আতিয়ার রহমান বিশ্বাসের ছেলে ওলিয়ার রহমান, ঘোড়শাল ইউনিয়নের পিরোজপুর গ্রামের বিশারত মন্ডলের দুই ছেলে তারিক মন্ডল ও উলফাত মন্ডল ও দিপু বিশ্বাসের ছেলে শহিদুল ইসলাম ও মধুহাটী ইউনিয়নের মহামায়া গ্রামের জালাল উদ্দীন। নিখোঁজ এ সব যুবকরা কোথায় আছে পরিবারের কেও জানে না। দালালদের খপ্পরে পরে সগর পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে এ সব যুবক নিখোঁজ হয়। কেও সাগরের বুকে ট্রলারে চেপে শুধু এটুকুই বলেছে “আমি মালায়েশিয়া যাচ্ছি অমুক দালালের কাছে টাকা পাঠাও”। এমন নিখোঁজ এক যুবক ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হালিধানি ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর গ্রামের আব্দুল হামিদ। তার মা হাজেরা বেগম সন্তানের জন্য ৬ বছর পথ চেয়ে বসে আছে। মসজিদ ও মাজারে কত মানত করেছে। রোজা ও নফল নামাজ পড়েছে। কিন্তু বুকের ধন হামিদ আজো ফিরে আসেনি। বুক চাপড়ে আহাজারী করতে করতে হাজেরা বেগম বলেন আকার (চুলা) আগুন নিভে যায়, কিন্তু বুকের আগুন নেভে না। হামিদের স্ত্রী লিপি খাতুন জানান, আমার কোলের মেয়ে জামিলার বয়স যখন এক বছর তখন স্বামী এক বিকালে হলিধানি বাজারে যাওয়ার নাম করে বের হয়, আর ফিরে আসেনি। ১৪/১৫ দিন পর একটি অচেনা নাম্বর থেকে মোবাইলের মাধ্যমে জানায় যে আমি মালয়েশিয়া চলে যাচ্ছি, জাহাজে উঠেছি পরে কথা হবে। মালায়েশিয়া গেলে টাকা দিতে হবে। এই বলে মোবাইল কেটে দেয়। যে সে বেঁচে আছে না মরে গেছে সেটাও জানি না। আমার ছোট মেয়ে জামিলার বয়স এখন ৬ বছর। হামিদের ৩ মেয়ে পিতার ফিরে আসার অপেক্ষায় দিন, মাস ও বছর পার করে দিচ্ছে। কিন্তু প্রতিক্ষার যেন শেষ হচ্ছে না। একই গ্রামের নিখোঁজ লাবলুর পিতা ছেলের শোকে দুই বছর আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তার ২ মেয়ে। পাশের বাড়ির নিখোঁজ আরাফাতের স্ত্রী হালিমা খাতুন জানায় তারও ৩ মেয়ে পিতার ছবি বুকে আঁকড়ে ধরে কান্নাকাটি করে। পানি পথে মালয়েশিয়া গিয়ে ফিরে আসা রামচন্দ্রপুর গ্রামের আব্দুল মতিন নির্মম অভিজ্ঞতা বর্ননা করে বলেন ট্রলারে যাওয়ার সময় দালালেরা ঠিক মত খাবার দেয় না। কেও অসুস্থ্য হয়ে পড়লে তাকে জীবিত সাগরে ফেলে দেয়। আবার কারো কারো থাইল্যান্ডের জঙ্গলে মুমুর্ষ অবস্থায় পুতে রাখে। এটা তিনি নিজে চোখে দেখেছেন। ঝিনাইদহ জেলা জুড়ে আরও অনেক যুবক মালয়েশিয়া পানি পথে যাওয়ার সময় নিখোঁজ থাকতে পারেন এমন আশংকাও রয়েছে। এসব পরিবারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গাড়ামারা গ্রামের লুৎফর রহমানের ছেলে আতিয়ার দালাল এদের অবৈধ পথে নিয়ে যেতে উৎসাহিত করে। ক্ষতিগ্রস্থরা আতিয়ারের নামে মামলা করলেও সে জামিনে মুক্ত হয়ে মলয়েশিয়ায় চলে গেছে। এই ৮ জনের মধ্যে দালাল আতিয়ারের ভাই ওলিয়ারও নিখোঁজ রয়েছেন। এছাড়া ঘোড়শাল ও ফুরসন্দি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম থেকে নিখোঁজ থাকা ৭ যুবকের কাছ থেকে তেতুলবাড়িয়া গ্রামের শামছুদ্দিন বিশ্বাসের ছেলে সবের আলী দালাল ও ঝিনাইদহ শহরের পবোহাটি গ্রামের মৃত মকবুল হোসেনের ছেলে আফাঙ্গির দালাল মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এ সব দালালরা থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার বিভিন্ন জেলে নিখোঁজ যুবকদের আটক থাকার মিথ্যা তথ্য দিয়ে কয়েক দফা টাকা হাতিয়ে নেয় ওই সব পরিবারের কাছ থেকে। অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার সময় নিখোঁজ থাকার কারণে আইন আদালতেও ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো তেমন কোন সুবিধা পায়নি। বিষয়টি নিয়ে ঝিনাইদহ জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের সহকারী পরিচালক সবিতা রানী জানান, যারা বৈধ ভাবে বিদেশে যান কেবল তাদের তথ্য তাদের কাছে থাকেন। অবৈধ ভাবে কেও গেলে বা মৃত্যুর শিকার হলে আমরা তাদের আইনগত সহায়তা দিতে পারিনা। আবার তাদের কোন তথ্যও আমাদের কাছে থাকে না। এ বিষয়ে ঝিনাইদহ সদর থানার ওসি মিজানুর রহমান খান বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার তথ্য প্রমান দিয়ে অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন